চীন কি তাইওয়ান দখল করে নেবে?

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং আর তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং আর তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন

তাইওয়ান মাত্র ১৩ হাজার ৮২৬ বর্গমাইলের একটা দ্বীপ। আয়তনে চীনের চার শতাংশও হবে না। লোকসংখ্যায় দুই শতাংশেরও কম হবে। অথচ দেশটির প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন বেইজিংয়ের চোখে চোখ রেখে কথা বল যাচ্ছেন। চীনের জন্য এটা অসহনীয়।

কিন্তু ম্যাডাম সাইয়ের এই সাহসের উৎস কী? কেউ বলে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধন। কেউ বলে নিজ দেশের শক্তি-সামর্থ্য। কোন দাবি সঠিক, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। সেই বিতর্ক ছাপিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে—চীন আর কত দিন এটা সহ্য করবে?


তাইওয়ানের কাছাকাছি চীনের কাজ-কারবার দেখে এ উদ্বেগও আছে, তারা দ্বীপটি সরাসরি দখল করতে চলেছে কি না?

ম্যাডাম সাই বনাম আংকেল সি

মূল চীন থেকে তাইওয়ান প্রায় ১১০ মাইল দূরে। দ্বীপটির মূল বাসিন্দারা বরাবরই ইতিহাসে অনালোচিত। চীনের সিং ডাইনেস্টি এই দ্বীপ দখল করে ১৬৮৩ সালে। অল্প কয় বছর পরই সেটা জাপানের দখলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীনারা আবার দ্বীপের দখল পায় জাপান বিতাড়িত হওয়ার পর। মাও সে-তুংয়ের নেতৃত্বে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি যখন মূল ভূখণ্ডের ক্ষমতা দখল করে, তখন প্রতিপক্ষ জাতীয়তাবাদী দলের সরকার কমিউনিস্টদের কাছে হেরে ঘাঁটি গাড়ে এই দ্বীপে এসে। এরা 'কুয়োমিনট্যাঙ' নামে পরিচিত। সে সময় মূল চীন থেকে 'কুয়োমিনট্যাঙ' সমর্থক প্রচুর মানুষও তাইওয়ানে চলে আসে। সেই থেকে দ্বীপটি তাদের শাসনেই চলছে। এরা স্থানীয় লোকজনের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করেই দশকের পর দশক তাইওয়ানকে শাসন করেছে। এদের শাসনে দেশটা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও পেয়েছে।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন অবশ্য ভিন্ন দল থেকে নির্বাচিত। তাঁর ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি এর আগে মাত্র দুবার তাইওয়ানে ক্ষমতায় আসে। 'কুয়োমিনট্যাঙ' দলের সঙ্গে ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির পার্থক্যটাও বেশ মজার। একদা মূল ভূখণ্ড ছেড়ে আসা 'কুয়োমিনট্যাঙ' দল এখন চীনের সঙ্গে 'ভালো সম্পর্কে'র পক্ষে। অন্যদিকে প্রগ্রেসিভ পার্টির পক্ষপাত তাইওয়ানিজ জাতীয়তাবাদের দিকে। ম্যাডাম সাইয়ের সঙ্গে আংকেল সি চিনপিংয়ের বৈরিতার বড় কারণ তাই কেবল ইতিহাস নয়, তাইওয়ানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও।

কঠোরতা দেখাচ্ছে চীন

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীনের কাছে সবচেয়ে স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ তাইওয়ান। বেয়াড়া দ্বীপটি নিজে যে তাদেরই অংশ—এ নিয়ে কোনো আপস করতে রাজি নয় তারা। তাইওয়ানকে পৃথক দেশ হিসেবে মানে না তারা। সে দেশের সরকারও তাদের কাছে 'তাইওয়ান কর্তৃপক্ষ' মাত্র।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার ভয়ে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখে না। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত ১৯৩টি দেশের মধ্যে তাইওয়ানের সঙ্গে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে মাত্র ১৫টি দেশের। চীনের বাধায় তাইওয়ান জাতিসংঘেও নেই।
চীন বরাবরই বলে যাচ্ছে শান্তিপূর্ণভাবে না হলে জোর করে তাইওয়ানকে 'মূল ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণে' আনা হবে। ইদানীং এই হুমকি উচ্চমাত্রায় পৌঁছেছে। চীনের সাফ কথা, 'এক দেশ, দুই ব্যবস্থা' নীতির আওতায় পুঁজিতান্ত্রিক তাইওয়ান চীনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে। যেভাবে আছে হংকং। কিন্তু সর্বশেষ জরিপে তাইওয়ানের ৯৫ ভাগ মানুষই চীনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিরুদ্ধে। সাই ইং-ওয়েনের দুই দফা প্রেসিডেন্ট হওয়া সেই মনোভাবেরই প্রকাশ।
কিন্তু তাইওয়ানকে চাপে রাখতে চীন এখন পেশিশক্তি দেখাচ্ছে। প্রচুর যুদ্ধবিমান মোতায়েন রাখা হয়েছে তার দিকে তাক করে। এর মধ্যে আছে পারমাণবিক বোমা বহনকারী বিমানও। তাইওয়ানের উপকূল ঘেঁষে প্রায়ই চীনের নৌবাহিনী শক্তি দেখায়।

তাইওয়ানের বড় ভরসা যুক্তরাষ্ট্র

চীনের এ রকম শক্তি প্রদর্শনে তাইওয়ানের বড় ভরসা যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক পরিসরে চীন-যুক্তরাষ্ট্র ঠান্ডা যুদ্ধ যত প্রকাশ্য হচ্ছে, তাইওয়ান প্রণালিতে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি তত বাড়ছে। বিশ্বের অন্যতম উত্তেজক অঞ্চল যে এখন দক্ষিণ চীন সাগর, সেটা তাইওয়ানের কারণেও। এ সপ্তাহে তাইওয়ানকে ১৮০ মিলিয়ন ডলারের টর্পেডো দিল ওয়াশিংটন, যা ওই উত্তেজনায় নতুন জ্বালানি জোগাবে।
তবে এসব অস্ত্র পাওয়ার পরও ভূখণ্ড ও জনশক্তির মতোই সামরিক শক্তিতেও চীনের তুলনায় নগণ্য তাইওয়ান। অর্থনীতি ভালো থাকায় সমর খাতে খরচ করতে সমস্যা নেই তাইওয়ান সরকারের। তারপরও সেটা চীনের তুলনায় সামান্যই। চীন প্রতিরক্ষা খাতে প্রতিবছর যা খরচ করে, তাইওয়ান তার ৫ ভাগ খরচ করতে পারে। এ দিয়ে সে যে আত্মরক্ষা করতে পারবে না, সেটা তাইপের রাজনীতিবিদেরা জানেন। ফলে তাঁদের দরকার শত্রুর শত্রুকে। ওয়াশিংটন তাই তাইপের বন্ধু। উল্টোটিও সত্য। হংকংয়ের চীনবিরোধী বিক্ষোভে যুক্তরাষ্ট্রের খোলামেলা সমর্থন তাইওয়ানকে আশাবাদী করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক দাপট এখন কমতির দিকে, যা তাইওয়ানের সামনে অস্তিত্ব রক্ষার ভয় বাড়াচ্ছে। করোনা দুর্যোগকালে যুক্তরাষ্ট্রের বেহাল দশায় তাইওয়ানজুড়ে হতাশা বেড়েছে। অথচ নিজ দেশে করোনাকে ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণে রেখেছে তারা।

তাইপের হার না মানা রাজনীতিবিদেরা

তাইওয়ানের রাজনীতিবিদেরা বরাবরই অত্যন্ত চৌকস ও সৃজনশীল। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আশপাশের অঞ্চলেও বরাবরই মিত্র বাড়াতে তৎপর তাঁরা। বিশেষ করে জাপান প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের বড় লক্ষ্য। টোকিও এই মৈত্রীতে উৎসাহী। দেশটির সঙ্গে এখনি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে চীনের ক্রোধের মুখে পড়তে চায় না জাপান। তবে 'সরকারি' চৌহদ্দি এড়িয়ে এই সম্পর্কের পরিসর বাড়ছে। কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকার পরও জাপান সরকারের মুখপাত্র ইশিহাইদি সুগা সম্প্রতি তাইওয়ানকে 'অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার' বলে ঘোষণা দিয়েছেন। একই ধাঁচের সম্পর্ক রক্ষা করছে দক্ষিণ কোরিয়া ও ফিলিপাইন। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে তাইওয়ানের প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে। ফিলিপাইনের সঙ্গেও তাইপের ব্যবসা-বাণিজ্য বিপুল। ফিলিপাইনের অন্যতম বিদেশি বিনিয়োগকারী তাইওয়ান। ফিলিপাইনের সঙ্গে তাইওয়ানের সম্পর্ক সাংস্কৃতিক পরিসরেও ঘনিষ্ঠ। উভয় দেশের মানুষের মধ্যে বিপুল হারে বিয়ে-শাদি হয়। ভিয়েতনামেরও প্রধান এক বিনিয়োগকারী তাইওয়ান।
চাপ দিয়ে প্রথাগত কূটনৈতিক সম্পর্কের বাইরে রাখতে পারলেও জাপান, কোরিয়া, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম থেকে তাইওয়ানকে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে না পারা বেইজিংয়ের বড় ব্যর্থতা।
বহুদলীয় গণতন্ত্র ও বাক্‌স্বাধীনতার চর্চায় গণচীন থেকে অনেক এগিয়ে তাইওয়ান। আশপাশের অঞ্চলে তার প্রতি আকর্ষণ বাড়ার এটাও বড় কারণ। গণতান্ত্রিক এই ইমেজ তাকে চীনের অঙ্গীভূত হওয়ার হাত থেকে একধরনের সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে।

চীন কি অবরোধ-অস্ত্র প্রয়োগ করবে?

চীনের জন্য তাইওয়ানে হামলা চালানোর অনেকগুলো অসুবিধা আছে। প্রথমত, এটা হংকংয়ের চীনবিরোধী বিক্ষোভকে নৈতিকভাবে আরও বলবান করবে। চীনের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসন রক্ষায় হংকংয়ের তরুণ বিক্ষোভকারীরা তাইওয়ানে খোলামেলাভাবেই প্রশংসা পান। কিছু বস্তুগত সাহায্যও পেয়েছেন তাঁরা। হংকং থেকে পালাতে বাধ্য হওয়া বিক্ষোভকারীদের জন্য তাইপে এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এসব কারণে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই হংকংয়ে জনপ্রিয়। হংকং ও তাইওয়ানের এই সাংস্কৃতিক সংহতি বেইজিংয়ের জন্য বিরক্তিকর। এমনকি উদ্বেগের বিষয়ও বটে।
আবার তাইওয়ানের পাশের দেশ জাপান, কোরিয়া ও ফিলিপাইনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক মৈত্রী রয়েছে, যা তাৎক্ষণিকভাবে তাইওয়ানের পাশে দাঁড়াতে ওয়াশিংটনকে সাহায্য করতে পারে। তবে সরাসরি সামরিক হামলা না চালিয়েও চীন তাইওয়ানকে রাজনৈতিক ঐক্য প্রক্রিয়ায় বাধ্য করতে পারে। সেটা হতে পারে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। অনেক ভাষ্যকারের শঙ্কা, একটা সময়সীমা বেঁধে দিয়ে চীন তাইওয়ানকে অবরোধের দিকে নিয়ে যাবে শিগগির।
আগামী বছর চীনের শাসক দলের প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পূর্তি উৎসব হচ্ছে জাঁকজমকের সঙ্গে। হয়তো তার আগেই তাইওয়ানের বিরুদ্ধে অবরোধের ঘোষণা আসতে পারে।
এ রকম শঙ্কার বড় কারণ, সি চিনপিংকে নিয়ে চীনের সার্বক্ষণিক প্রচার আন্দোলন। চীনে মাও সে-তুং এবং দেং জিয়াও পিংয়ের পরই এখন তাঁর 'ঐতিহাসিক মর্যাদা'। তাইওয়ানের জন্য এটা উদ্বেগের বিষয়। কারণ, বিপ্লবের পর একদা মাও সে-তুং তিব্বতকে মূল চীনে যুক্ত করেছিলেন। দেং জিয়াও পিংয়ের আমলে হংকংকে ফিরে পায় চীন। সেই ধারাবাহিকতায় সি চিনপিং তাইওয়ানকে কবজায় এনে নিজের জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তি বাড়তি উচ্চতায় নিতে চাইতে পারেন।

যে কারণে ২০২১ তাইওয়ানের জন্য বিপজ্জনক বছর

তাইওয়ানকে নিয়ে চীনের নেতৃত্বের সাম্প্রতিক অতিরিক্ত উদ্বেগের বড় কারণ দ্বীপটির তরুণ প্রজন্মের মনমানসিকতা। মূল ভূখণ্ড থেকে রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্নতার ৭০ বছর পেরিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। তাইওয়ানের আজকের তরুণ-তরুণীদের জন্ম হয়েছে একটি বহুদলীয় সমাজে ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মধ্যে। নিজ দেশ নিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গর্ব অনেক। অবলীলায় এখানে তাঁরা প্রায় সব বিষয়ে মতামত প্রকাশ করতে পারছে, যা চীনে অসম্ভব। এই অবস্থা থেকে নবীনেরা বেইজিংয়ের অধীন হওয়ার কথা ভাবতে পারেন না।
হংকংয়ে চীনের কর্তৃত্ববাদী আচরণও এদের চীনের সঙ্গে একীভূত হতে অনিচ্ছুক করে তুলেছে। এই তরুণ-তরুণীরাই এখন তাইওয়ানের রাজনীতিতে চীনবিরোধিতার পাল্লা ভারী করেছেন। অনেকে তাঁদের জাতিগত চীনা ঐতিহ্যও অস্বীকার করতে চান এখন। চীনের দিক থেকে হুমকি-ধমকিও তাঁদের চীনা ঐতিহ্যের প্রতি বৈরী করছে, যার ফায়দা পাচ্ছেন সাই ইয়ং-ওয়েন ও তাঁর প্রগ্রেসিভ পার্টি। চীনের প্রতি নমনীয় নীতির কারণে দেশটির এতদিনকার প্রধান দল 'কুয়োমিনট্যাঙ'-এর জনপ্রিয়তা অনেক পড়ে গেছে ইতিমধ্যে। চীনের জন্য এটাও বড় আঘাত।
তাইওয়ানিজদের কাছে 'কুয়োমিনট্যাঙ'-এর আবেদন কমে যাওয়ার আরেকটি তাৎপর্য হলো, শান্তিপূর্ণ উপায়ে উভয় ভূখণ্ডের একত্র হওয়ার সুযোগ কমে যাওয়া। এ অবস্থায় চীনের এই উপলব্ধি অত্যন্ত সঠিক যে দ্বীপটিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসার এখনি হয়তো শেষ মুহূর্ত। দিন যত যাবে, তাইওয়ানের বৈশ্বিক অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে এবং দেশটির নতুন প্রজন্ম চীনের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য মেনে নিতে আপত্তি তুলবে। ২০২১ তাই তাইওয়ানের জন্য একটা বিপজ্জনক বছর।


আলতাফ পারভেজ: গবেষক