আনিসুজ্জামান: একটি মানবিক সমাজের অন্বেষণে

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

করোনার দুঃসময়ে অনেকগুলো মৃত্যুশেল আমাদের প্রিয়জনদের আমাদের কাছ থেকে পরপর ছিনিয়ে নিয়ে গেল। সর্বশেষ খবর এসেছে যে সিএমএইচে ১৪ মে বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ৮৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে প্রথমে করোনার কথা আমরা জানতে পারিনি। স্যারের অনেকগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যথাযথভাবে কাজ করছিল না (মেডিকেল পরিভাষায় যাকে ‘Multiple organ failure’ বলা হয়) সে জন্যই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রক্ত পরীক্ষা করে জানা গেলÑতাঁকেও ঘাতক করোনা আক্রমণ করেছিল। এ জন্য আমাদের দুঃখ রয়ে গেল যে যথাযোগ্যভাবে তাঁর শেষকৃত্য আমরা করতে পারলাম না।

তবে যেভাবেই এই মৃত্যু হোক না কেন, সর্বজনশ্রদ্ধেয় আনিসুজ্জামানকে আমরা আর আমাদের মাঝে ফিরে পাব না। স্মিত হেসে, সভাপতির আসনে বসে থেকে ধৈর্য ধরে সবার দীর্ঘ বক্তৃতা শুনে তারপর মাত্র দুটি-চারটি তীক্ষ্ণ মর্মভেদী সারসংক্ষিপ্ত বাণীর মাধ্যমে সভার সমাপ্তি টানার যে অনন্য অননুকরণীয় ঐতিহ্য তিনি স্থাপন করে গিয়েছিলেন, তার পুনরাবৃত্তি আর আমরা দেখতে পাব না। এই কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব আমাদের কাছ থেকে আজ চিরবিদায় গ্রহণ করে গেছেন।

আনিসুজ্জামানের প্রধান এবং প্রথম পরিচয় সম্ভবত ‘শিক্ষক’। শিক্ষকতা ও গবেষণাই ছিল তাঁর প্রধান বৃত্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধ ছাত্র চিরকাল তাঁকে মনে রাখবেন, হৃদয়ে ধারণ করে রাখবেন। জীবনের শেষে প্রান্তে এসে তিনি বাংলাদেশের ‘জাতীয় অধ্যাপক’ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এই পদ তাঁর জন্য শুধু একটা সম্মানজনক পদ বা সামাজিক স্বীকৃতি ছিল না। যুক্তি ও মনীষা দিয়ে জাতির প্রতিটি সংকটকালে অভিভাবকের মতো জাতিকে পথ দেখিয়েছেন তিনি, জাতীয় শিক্ষকের মতো, তিনি জাতির পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বারবার। অকুণ্ঠচিত্তে অসাম্প্রদায়িকতা, উদারনৈতিক গণতন্ত্র, ন্যায় বিচার এবং প্রগতির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য শহীদজননী জাহানারা ইমামের পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করেছেন। এই সেদিনও যখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার হচ্ছিল, তখন তাঁর নেতৃত্বেই গঠিত হয়েছিল ‘রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ’। তাঁকে নিয়েই আমরা ঘটনাস্থলে গিয়েছি, নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়িয়েছি এবং বটবৃক্ষের মতো আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি নির্ভয়ে আমাদের সবাইকে ছায়া দিয়েছেন।

আনিসুজ্জামানের মানবিকতা অপরিমেয়। তিনি এই ঘাতক-দালাল আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অকুতোভয় দৃঢ় সৈনিক হিসেবে যেমন দায়িত্ব পালন করেছেন, তেমনি ঘাতকদের ন্যায় বিচারের পক্ষেও সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। সত্য সাক্ষী দিতে যেমন দ্বিধাবোধ করেননি, আবার এ কথাও সত্য যে তাদের বা যেকোনো মানুষের মৃত্যুদণ্ড নীতিগতভাবে তিনি সমর্থন করতেন না।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন ভেতরে বাইরে পরিপূর্ণ একজন ইহজাগতিকতাবাদী মানুষ। ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দের চেয়ে ইহজাগতিকবাদ শব্দকে তিনি পছন্দ করেছেন বেশি। তাই মুক্তবুদ্ধির চর্চার পক্ষে তিনি সর্বদাই দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। এসব প্রশ্নে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, চোরা আপস বা সুবিধার জন্য নানা তুচ্ছ কৌশল অবলম্বনকে তিনি কখনোই সমর্থন করতেন না। তিনি ছিলেন ’৭২ সালে রচিত সংবিধানের মূল চার নীতির একনিষ্ঠ দৃঢ় সমর্থক। এসব নীতিতে কোনো গোঁজামিল তাঁর পছন্দ ছিল না। সেসব কথা নির্ভয়ে অনেকবার অনেক জায়গায় একাধিকবার তিনি উচ্চারণ করে গেছেন।

অনেকেই হয়তো মনে রাখেননি যে আনিসুজ্জামানের তরুণ বয়সে পঞ্চাশ দশকে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন প্রগতিশীল যুব সংগঠন ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগের’ সঙ্গে। পরবর্তী সময়ে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ও নেতা ছিলেন তিনি। এ সময় আন্দোলনের অনেক উল্লেখযোগ্য প্রচারপত্রের প্রথম খসড়াটি লিখিত হয়েছিল আনিসুজ্জামান কর্তৃক। মোহাম্মদ ইলিয়াস, মুনীর চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান—তাঁদের সঙ্গে থেকে তাঁদের সঙ্গে প্রগতির পথে তিনি হেঁটেছেন অনেক দিন। যদিও বিশেষ কোনো সাম্যবাদী দলের অফিশিয়াল সদস্যপদ তিনি কখনো গ্রহণ করেননি। পাকিস্তানি শাসনের সেই অন্ধকার প্রতিক্রিয়াশীল যুগে রবীন্দ্রনাথকে সামনে তুলে ধরা, হাজার বছরের বাঙালি সত্তাকে যুক্তি ও তথ্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করা এবং তদানীন্তন পূর্ব-বাংলার স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতায় উত্তরণের ক্ষেত্রে আনিসুজ্জামান সর্বদাই ছিলেন গভীরভাবে সচেতন এবং প্রবলভাবে সক্রিয়। সেই ধারাবাহিকতাতেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আনিসুজ্জামান সোজা গিয়ে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর ভক্সওয়াগন গাড়িতে করে আগরতলায় এসে। সেখানে গাড়িটি তদানীন্তন কমিউনিস্ট নেতাদের ব্যবহারের জন্য উপহার হিসেবে দান করে চলে আসেন কলকাতায়। কাজ শুরু করেন মুজিবনগর সরকারের অধীনে পরিকল্পনা কোষে। তিনি হয়ে ওঠেন মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সরকারপ্রধান তাজউদ্দীন আহমদের অন্যতম সহচর। সেই দুঃসময়ে তাজউদ্দীন আহমদের অনেক ভাষণের প্রথম খসড়াটি তাঁর কলমেই রচিত হয়েছিল।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়ে তিনি কাজ করেছেন নানাভাবে। একসময় বঙ্গবন্ধু তাঁকে শিক্ষাসচিবের পদও দিতে চেয়েছিলেন। এই প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে আনিসুজ্জামান তাজউদ্দীন আহমদকে অনুরোধ করেন তা বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়ে বলার জন্য। তখন তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘আনিসুজ্জামানকে শিক্ষাসচিব করলে আমরা এজন ভালো শিক্ষককে হারাব আর বদলে পাব একজন মন্দ প্রশাসক।’ (আনিসুজ্জামানের আত্মজীবনী ‘বিপুলা পৃথিবী’ থেকে উদ্ধৃত) এ কথা থেকে বোঝা যায় আনিসুজ্জামান কখনোই প্রশাসক জাতীয় কিছু হতে চাননি। তিনি চেয়েছেন নিজেকে সর্বদা জ্ঞানসাধনায় ব্যাপৃত রাখতে। জ্ঞানের আলোয় প্রদীপ্ত পথ ধরেই হেঁটেছেন অবিচলভাবে। স্বাধীন বাংলাদেশে ’৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, তার প্রায় পুরোটাই বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন আনিসুজ্জামান। স্মর্তব্য যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে কখনো যদি সংবিধানের বাংলা পাঠ ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে কোনো অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়, তাহলে বাংলা পাঠটিই শিরোধার্য (Authentic) বলে বিবেচিত হবে। আনিসুজ্জামান সেই আস্থার মর্যাদা রক্ষা করে আমাদের সংবিধানের এক অনন্যসাধারণ নিখুঁত বঙ্গানুবাদ উপহার দিয়ে গেছেন জাতিকে।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

দুই বাংলার সংস্কৃতি জগতে আনিসুজ্জামানের পদস্পর্শ ছিল অবাধ এবং তাদের সবাকেই তিনি সহৃদয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেছেন আজীবন। বিশ্বভারতী, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, থিয়েটার, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, ছায়ানট, উদীচী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট—এসব সংগঠনের প্রতিটিই ছিল তার পৃষ্ঠপোষকতা ও স্নেহ ধন্য। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। এরা সবাই তাঁর মৃত্যুতে শুধু ব্যথিত হননি, হারিয়েছেন একজন অকৃত্রিম বন্ধু ও অভিভাবককে। এদের সবার কাছ থেকে তিনি সম্মান ও স্বীকৃতিও পেয়েছেন যথেষ্ট। বিভিন্ন সময়ে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, আনন্দ পুরস্কার, ভারতের পদ্মভূষণসহ নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে তাঁকে ভূষিত করা হয়েছিল। দেশ-বিদেশে এত খ্যাতি সত্ত্বেও তিনি সর্বদাই মাটির কাছাকাছি বিচরণ করেছেন এবং ভেবেছেন ও বলেছেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক।’

অসাম্প্রদায়িকতা, উদার গণতন্ত্র, ইহজাগতিকতা, মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, প্রগতি ও ন্যায় বিচারের আদর্শের ধারক ও বাহক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে সত্যই বাঙালি জাতি হারাল তার পুরোধা এক পথপ্রদর্শককে। এ কথা হয়তো সত্য দুই বাংলার জন্যই। তাঁর এসব চিন্তা ও লেখনী আগামী দিনের একটি মানবিক সমাজের অন্বেষণে আমাদের সবার পাথেয় হিসেবে কাজ করুক, এই কামনাই করি।