ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা

ঘূর্ণিঝড় আম্পান ১২ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস এবং ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৫১ কিলোমিটার গতিবেগের ঝোড়ো বাতাসে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোর ব্যাপক ক্ষতি করেছে। বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবনে সৃষ্টি করেছে বিরাট দুর্ভোগ ও অনিশ্চয়তা। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ এমন এক সময়ে হানা দিয়েছে, যখন সারা দেশে কোভিড-১৯ নামে এক অত্যন্ত ছোঁয়াচে মহামারি দ্রুত বিস্তার লাভ করে চলেছে, এবং সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের প্রায় পুরোটাই এই সংকট মোকাবিলায় ব্যস্ত রয়েছে।

ঝোড়ো বাতাসের চেয়ে জলোচ্ছ্বাসেই ক্ষতি করেছে বেশি। প্রাথমিকভাবে ১০ জনের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়েছে; কিন্তু ঘরবাড়ি, গৃহস্থালি, ভৌত অবকাঠামো এবং কৃষি ও মৎস্য খাতের ক্ষতি কত ব্যাপক, তা এখন নিরূপণ করতে হবে। সংবাদমাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, জলোচ্ছ্বাসে অনেক বাঁধ ভেঙে গেছে, বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে অনেক জনপদ প্লাবিত হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের অনেক গ্রাম পানির নিচে, সেগুলোর অধিবাসীদের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়েছে। তাঁদের সবার ভাগ্যে নিরাপদ আশ্রয় জুটেছে কি না, তা বলা কঠিন। কারণ, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগেই সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী প্রায় ২৪ লাখ মানুষকে ঘূর্ণিঝড়
আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল এবং সংবাদমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী সেগুলো তখনই ভরে গিয়েছিল। অনেক এলাকার বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের খুঁটি পড়ে গিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। খেতের ফসল ও চিংড়ির ঘেরগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; লোনাপানির প্লাবনে কৃষিজমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী তাৎক্ষণিক খবরাদি থেকে সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া কঠিন হলে স্পষ্টই প্রতীয়মান হচ্ছে যে বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকা সংকটাপন্ন হয়েছে। তাঁদের দ্রুত সহযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য প্রথমেই ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা নিরূপণ করা একান্ত জরুরি। করোনার কারণে সারা দেশের মতো দক্ষিণাঞ্চলের অধিবাসীরাও দেড় মাসের বেশি সময় ধরে জীবিকার সংকটে রয়েছেন; এর ওপর আম্পানের আঘাতে তাঁরা যে ক্ষতির মুখে পড়লেন, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য তাঁদের বাড়তি ও দীর্ঘ মেয়াদি সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। জরুরি ত্রাণ সহযোগিতা যত দ্রুত সম্ভব শুরু করা প্রয়োজন। জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ-টেলিফোনসহ ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো পুনরুদ্ধার করতে হবে; ভেঙে যাওয়া ও ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলোও দ্রুত মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

চলমান কোভিড-১৯ মহামারির কারণে আম্পান-পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। এই ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের বিশেষ ত্রাণ সহযোগিতাসহ সব কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার বাড়তি ঝুঁকি এড়িয়ে। কিন্তু যে জনগোষ্ঠী ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে, কিংবা যাদের ঘর ছাড়তে না হলেও খাদ্য ও পানির নিশ্চয়তা নেই, তাদের পক্ষে সামাজিক-শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা গৌণ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের অবশ্যই এদিকে কড়া নজর রাখতে হবে। তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে, খাদ্য, পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি ও ত্রাণসামগ্রীর সঙ্গে সম্ভব হলে মাস্ক ও সাবান সরবরাহের ব্যবস্থাও রাখা প্রয়োজন।

সর্বোপরি, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর বাড়তি দুর্দশা ও বিপদকে আন্তরিক মানবিকতার সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে অবিলম্বে জোরালো সহযোগিতার তৎপরতা শুরু করতে হবে।