জয় দেখান, ভয় নয়, জয় হবেই

রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন ২৫ বৈশাখ চলে গেল। ১১ জ্যৈষ্ঠ আসছে, এবার কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন পড়বে ঈদের ছুটিতে। চাঁদরাতে আমরা অবশ্যই বাজাব ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। গানটা শুনলেই মনটা খুশিতে নেচে ওঠে। এবার এই গানের দ্বিতীয় লাইনটা খুব বেশি প্রাসঙ্গিক, ‘তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ।’ আয়হীন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। ফিতরা তো আছেই। জাকাত যদি আমরা নিয়ম মেনে হিসাব করে দিই, দেশের বহু মানুষ এই দুর্দিনে একটুখানি চলবার রসদ পাবেন।

২.
রবিঠাকুরের খাপছাড়া বইয়ের ৮২ নম্বর ছড়াটা এ রকম:

 ‘মহারাজা ভয়ে থাকে

পুলিশের থানাতে,

আইন বানায় যত

পারে না তা মানাতে।

চর ফিরে তাকে তাকে—

সাধু যদি ছাড়া থাকে

খোঁজ পেলে নৃপতিরে

হয় তাহা জানাতে,

রক্ষা করিতে তারে

রাখে জেলখানাতে।’

মনে হচ্ছে, এ আমাদের কথা, আমাদের কালের কথা। মহারাজারা ভয়ে আছেন, যত আইন বানাচ্ছেন, সব মানাতে পারছেন না, সাধুদের ধরে ধরে তাই জেলখানায় রাখতে হচ্ছে, অবশ্যই সাধুদের নিরাপত্তারই স্বার্থে।

সম্প্রতি সম্পাদক পরিষদ এক বিবৃতি দিয়েছে। প্রথম আলো (৭ মে ২০২০) থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি: ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দমনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে এই আশঙ্কায় সম্পাদক পরিষদ শুরু থেকেই আইনটির বিরোধিতা করেছিল। আইনটি নিয়ে সম্পাদক পরিষদের সেই শঙ্কা এখন গণমাধ্যমের জন্য দুঃস্বপ্নের বাস্তবতা।’

সম্পাদক পরিষদ বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, ‘আমরা গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে অযৌক্তিকভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট ও লেখককে অভিযুক্ত ও গ্রেপ্তার করার ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করছি। গ্রেপ্তারের আগে অভিযোগের যৌক্তিকতার বিষয়ে কোনো কথা বলা হচ্ছে না।’ ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়া’, ‘গুজব ছড়ানো’, অথবা ‘সরকারের সমালোচনা’ করার মতো কারণকে এখন সাংবাদিকদের জেলে ভরার জন্য যথেষ্ট বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া যেকোনো মামলা হওয়া মানেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখন গ্রেপ্তার হওয়া। সম্প্রতি ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। সাংসদ, জেলা প্রশাসন, ক্ষমতাসীন লোকজনের নামে সামান্য সমালোচনার কারণে সম্প্রতি মামলাগুলো দায়ের করা হয়।’ ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বিদ্যমান মানহানির মামলার পরিবর্তে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় পরিষ্কার আগ্রহ প্রমাণ করে, সুবিচার পাওয়াটা তাঁদের মূল উদ্দেশ্য নয়, বরং সাংবাদিকদের ভয় দেখানো ও হয়রানি করার ইচ্ছেটাই এখন মূল।’

এই বিবৃতির এই লাইনটা পড়ে নিজের জন্যই ভীষণ মায়া বোধ করছি: ‘বিদ্যমান মানহানির মামলার পরিবর্তে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় পরিষ্কার আগ্রহ প্রমাণ করে, সুবিচার পাওয়াটা তাঁদের মূল উদ্দেশ্য নয়, বরং সাংবাদিকদের ভয় দেখানো ও হয়রানি করার ইচ্ছেটাই এখন মূল।’ কত দুঃখে সম্পাদকগণ বলছেন, মামলা করতে চান, মানহানি মামলা করুন। এবং তাঁরা বলছেন, সুবিচার পাওয়া নয়, এসব মামলার (এবং গ্রেপ্তারের) আসল উদ্দেশ্য ভয় দেখানো।

ভয়! রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটার শরণ প্রায়ই নিতে হয়:

‘এ দুর্ভাগ্য দেশ হতে হে মঙ্গলময়

দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয়,−—

লোকভয়, রাজভয়, মৃত্যুভয় আর।

দীনপ্রাণ দুর্বলের এ পাষাণ–ভার।’

কবে রবীন্দ্রনাথ এই প্রার্থনা করেছেন, প্রার্থনা মঙ্গলময় মঞ্জুর করেছেন, তার কোনো নজির দেখি না, দেশটা দুর্ভাগ্য দেশই যেন রয়ে গেল, আমাদের কত যে তুচ্ছ, এবং তত-তুচ্ছ নয় ভয়—লোকভয়, রাজভয় এবং মৃত্যুভয়।

কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন:

 ‘তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়।’

দৈনিক ইত্তেফাক-এ ১০ মে ২০২০ প্রথম পৃষ্ঠার খবর: ‘এই করোনা মহামারিতেও থেমে নেই ষড়যন্ত্রকারীরা। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা সরকারকে বিপদে ফেলতে এবার বেছে নিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সেখানে ছড়ানো হচ্ছে নানা ধরনের প্রপাগান্ডা। এমনকি গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন জায়গার শ্রমিকদের উসকানি দিয়ে পথে নামানোর চেষ্টাও করছে। তবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও বসে নেই। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আমলা, দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার শতাধিক ব্যক্তির একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে।’

কর্তৃপক্ষ সদা সতর্ক। অতন্দ্র প্রহরা চলছে। এ ধরনের ষড়যন্ত্র অঙ্কুরেই বিনাশ করা হবে।

তো এবার যখন একজন কার্টুনিস্টকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাদের ফেসবুক পেজটা তখনো খোলা ছিল। এই পেজে গেলাম। যা দেখলাম, তার মধ্যে ষড়যন্ত্র কোথায় আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে এবং ‘সবারে বাস রে ভালো’ টাইপ মনে একদমই খুঁজে পেলাম না। একজন মন্ত্রীর ধানকাটা নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে। ভাষাটা বেশ তির্যক, গায়ে জ্বালা ধরায় বটে। তবে গণপ্রতিনিধি হলে সমালোচনা তো সহ্য করতেই হবে। একবার এরশাদের আমলে আইনবিষয়ক এক টেলিভিশন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক প্রেস কাউন্সিলে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। গদ্যকার্টুনে তাঁকে খোঁচা দিয়েছিলাম। মামলার বিবরণ শুনে একজন বিচারক সেই উপস্থাপককে বলেছিলেন, ‘আপনি টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করবেন, আর ব্যঙ্গ লেখকের খোঁচা সহ্য করতে পারবেন না, তা তো হবে না।’ আমেরিকায় স্যাটায়ারের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করা যাবে না—এ রকমই কানুন ছিল।

৩.
তপন রায়চৌধুরীর একটা স্মৃতিকথার বই পড়ছি। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের ছায়াটা কীভাবে পড়ছিল, তার বর্ণনা আছে তাতে। রাস্তায় ভিখিরির ভিড় বেড়ে যাচ্ছে। গ্রাম থেকে খাবারের সন্ধানে পুরো সংসার চলে এসেছে কলকাতায়। তারা রাস্তায় পড়ে আছে। ভিক্ষাও চাইতে জানে না। ‘চাল দাও’ বলে লাভ হচ্ছে না দেখে বলতে শুরু করল ‘ফ্যান দাও গো ফ্যান দাও’।

সন্ধ্যার পর আমি রাস্তার দিকের ঘরে থাকতে পারি না। এত ভিখিরি কোনো দিনও ঢাকার এই রাস্তায় আসেনি। আমার বুক কেঁপে কেঁপে ওঠে। দোকান বন্ধ, দোকানের মালিক-শ্রমিকেরা চলবেন কী করে?

তবু আমরা আশা দেখি। ইকোনমিস্ট বলেছে, যাদের অবস্থান ভালোর দিকে, বাংলাদেশ তাদের দলে। একজন গার্মেন্টস মালিকের সঙ্গে কথা বললাম, তিনি বললেন দুঃসময়ে তাঁর ভালো খবর আছে, তাঁর একটা কারখানা গত বছর লোকসান করেছে, এবার একটা বড় অর্ডার পেয়েছেন, লাভের মুখ দেখবেন। ধান উৎপাদনে আমরা রেকর্ড করেছি, এক ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়।

এই অবস্থায় অমর্ত্য সেনের কথাটা খুব প্রাসঙ্গিক। ‘যে দেশে গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না।’ কথাটা ঘুরিয়ে বলি, আমরা চাই না দেশে দুর্ভিক্ষ হোক, তাই আমাদের চাই গণতন্ত্র আর বাক্স্বাধীনতা। গণতন্ত্র কেবল নির্বাচন নয়। গণতন্ত্র মানে মানবাধিকার, বলার স্বাধীনতা, নাগরিকদের নিরাপত্তা। স্বাধীনভাবে বলতে দিন। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করুন। করোনা নিয়েও তথ্য গোপনের চেষ্টা ক্ষতিকর হবে। সঠিক তথ্য যত জানা যাবে, গুজব তত অকার্যকর হবে, দুর্যোগ মোকাবিলায় সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া তত সহজ এবং অনিবার্য হয়ে উঠবে।

কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা থেকে বলি, জয় দেখিয়ে শাসন করুন, ভয় দেখিয়ে নয়। দুইটা কৌতুক, তিনটা কার্টুন দেশ বা রাষ্ট্র এমনকি সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নয়। আসলে যেখানে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, সেগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখুন। দেশের মানুষ দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধেই সব সময় ছিল, থাকবে।

এই দেশের মানুষ সব সময়ই দুর্যোগ মোকাবিলায় সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে, এবারও দেবে। আমরা অনেক মারি যুদ্ধ মন্বন্তর পাড়ি দিয়ে এসেছি। আমরা যুদ্ধ জয় করতে শিখেছি। এবারের যুদ্ধেও আমাদের জিততে হবে। আমরা জিতব। আমাদের জিততেই হবে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক