ওপারের জেলে স্বামী-সন্তান, এপারে মা-বউয়েরা কাঁদে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

‘দুইটাই ছেলে ভাই। দুইটাই আটক হৈছে। ছাওয়ার মাও তো সেদিন কথা কওয়ার পরই অজ্ঞান হৈছে।’ কথাগুলো বলছিলেন ব্যাপারীপাড়ার লাল মিয়া (৬৫)। ব্যাপারীপাড়ার স্থানীয় নাম ডাটিয়াপাড়া। তাঁদের নগদ টাকার কারবার। মাছ মারেন, বিক্রি করেন আর খান। তাঁরা জমি কেনেন না। নদী ভাঙার পর জমি ইজারা নিয়ে বাড়ি করেন। ইজারা তত দিন, যত দিন নদী না ভাঙে। ভাঙলেই জমি আগের মালিকের। তাদের পাড়া এ জন্য সব সময় নদীর পাড়ে হয়। বিশাল বিশাল বাগাড় মাছ, একটা ধরলেই ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ। তাঁদের চালচলন কৃষকের মতো না। তাঁদের পাড়াসংলগ্ন বাজারে তাই জিনিসপত্রের দাম বেশি। সম্ভবত ডাট থেকেই ডাটিয়া শব্দটি এসেছে। এখন তাঁরা নিজেদের ব্যবসায়ী পরিচয় দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন বেশি।

সম্ভবত, জেলেরা যেমন একটা জায়গাতেই থিতু হন, এঁরা সেখানে মাছের মতোই গতিশীল। মাছ যত দূর যায়, এঁরাও তত দূর যান। বছরে একেক জায়গায় তাঁরা মাছ মারেন। বাগাড় মাছ যেখানে ধরা পড়ে, আইড় মাছ সেখানে নয়। বোয়াল ও পাঙাশ মাছের এক স্বভাব। পৈরালি বা বৈরালি মাছের আরেক স্বভাব। বাঁশপাতারি বা কাজলি, সে আবার বৈরালির জায়গায় থাকে না। একেক মাছের জন্য জালও ভিন্ন ভিন্ন। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ যাঁদের পড়া, তাঁদের বোঝার কথা, জেলের সঙ্গে মাছের সম্পর্ক কেমন। বাগাড় মাছের মতো আড়াই মণি মাছ যে ব্রহ্মপুত্রে পাওয়া যায়, সেখানে মাছ শিকার মাত্র ভোগের বিষয় না। পানির মধ্যে খোয়াজ খিজির থাকেন বলে তাঁদের বিশ্বাস, তার সঙ্গেও সম্পর্ক বটে। খোয়াজ খিজিরের প্রতি ভক্তিতে তাঁরা পানিতে প্রাকৃতিক কর্ম সারেন না। খোয়াজ খিজির মাছের পিঠে ঘুরে বেড়ান। সব সময় তাই মাছ ধরা যাবে না, এটা তাঁদের বিশ্বাস। মাছের ডাকে তাই তাঁরা আসামের কাজীরাঙ্গা বনের গভীরে চলে যান। আটক ২৬ জন জেলের মধ্যে ৩/৪ জন নববিবাহিত স্ত্রী রেখেও চলে গেছেন। লালমিয়ার (৬৫) ছেলে মানিক তাঁদের একজন।

‘বিশাল বিশাল বিল। বিলের মধ্যে বন, নাকি বনের মধ্যে বিল, কিছু বোঝা যায় না। আমরা জানি কখন বিল থাকি মাছ নামি আইসপে, আমরা সেই সময় ওখানে যাই। এই যে খাড়ি জাল দেখেন না, হামার হেডেই কয়ডা মাছ ওঠে? ওখানে একটা মাইনষে জাল তোলা যায় না। আর সেই মাছের কী স্বাদ!’ কথাগুলো বলেছেন ব্যাপারীপাড়ার প্রবীণ আবদুল শহীদ (৬৪)। তাঁরও দুই ছেলে আনারুল ও এছানুল আটক।

তিনি আরও দুঃখ করেন, ‘হামার দাদারা, তারে দাদারা আসামত যায়া মাছ মাচ্ছি। তহন পাসপোর্ট-ভিসা আছিল না। যারা কৃষি করে, তারা ওখানে জমি-জমা কইরছে। ওই জায়গার মানুষ হয়া গেইছে। কিন্তু হামার জাতোত জমির নেশা নাই বাহে। নদী ছাড়া হামরা থাইকপের পাই নে। হামার খালি মাছের নেশা। হামার মাছ ধইরবের দেও, হামরা আছি। এই জইন্যে ওখানকার মহাজনরা হামাক পছন্দ করে। হামার বাড়ির টান নাই। ভিসা-পাসপোর্ট আসি মনে হৈছে, ওই দেশোতে বউ বাচ্চা করা ভালো আছিল।’

২.
৩ মে আসামের জোড়হাট জেলা থেকে কোচবিহার চেংরাবান্ধা চেকপোস্টের উদ্দেশে রওনা দেন ২৬ জন বাংলাদেশি। সেদিন ছিল ভারতের দ্বিতীয় দফা লকডাউনের শেষ দিন। কিন্তু তাঁরা শুনেছিলেন, ওই দিন চেকপোস্ট খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু ধুবড়ি জেলার চাপোড় থানা-পুলিশ তাঁদের লকডাউন ভাঙার অভিযোগে আটক করে। পরে ফরেন অ্যাফেয়ার্স ধারা ১৪ অনুসারে জেলে পাঠায়। অথচ তাঁরা ভিসা নিয়েই গিয়েছিলেন।

এদিকে ১৪ মে কুড়িগ্রামে আটক ২৬ জনের পরিবারের সদস্যরা মানববন্ধন করে এবং জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর তালিকাসহ স্মারকলিপি জমা দেয়।

তা ছাড়া ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠন বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) পক্ষে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আসামের মুখ্যমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রকের সার্ক বিভাগের ডিরেক্টর, ধুবড়ির ডিসি ও এসপি, বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশন ও বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনকে লেখা এক চিঠিতে ‘মাসুম’ সম্পাদক কিরীটি রায় বলেছেন, সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ২৬ জন বাংলাদেশিকে অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। করোনা মহামারির জন্য লকডাউন চালু থাকায় তাঁরা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোনো যানবাহন পাননি। ফলে লকডাউনের শিকার হয়ে তাঁদের ভারতেই আটকে থাকতে হয়েছিল। এঁরা সবাই তিন মাসের পর্যটক ভিসা নিয়ে এসেছিলেন।

স্মারকলিপিতে স্বজনেরা বলেন, আমাদের নিয়মিতই আসা-যাওয়া করতে হয়। ওপারের আত্মীয়রা আসেন, আমরাও যাই। পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে চলাচল চলে। বংশপরম্পরায় জেলে হওয়ায় বেড়াতে গিয়ে অবসরে মাছ শিকার করি। আমাদের রক্তের মধ্যে আছে মাছের গন্ধ, নদীর কলতান। বেড়াতে গিয়ে মাছ ধরা অপরাধ নয়।

৩.
আসাম আর বাংলাদেশ একই ঢালে ও একই নদনদীর স্রোতোধারায় জন্ম ও বিকাশ। আসামের ৮০ শতাংশ যেমন ব্রহ্মপুত্রের উপত্যকা আর বাকিটা বরাকের, বাংলাদেশও তাই। ব্রিটিশের ইচ্ছায় সীমানা বদলেছে। কিন্তু প্রকৃতি বদলায়নি। একসময় যে আসাম ছিল কোচবিহার রাজ্য, পরে কোম্পানি আমলে ১৮২২ সালে রংপুরের অধীনে বিশেষ অঞ্চল, তা-ই ১৮২৬ সালে অহমিয়া যুবরাজ পুরন্দর সিংকে ৫০ হাজার রুপি বার্ষিক খাজনার বিনিময়ে দিয়ে দেওয়া হয়। তারপর ৯১ বছর ধরে কাচ্চারি রাজ্য, মাতক রাজ্য, মেঘালয়, দেওয়ানগিরি, নাগা অঞ্চল, মিজোরাম, গারো পাহাড় এলাকাগুলোসহ অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য ও ট্রাইবালদের পাহাড়ি এলাকা দখল করা হয়। ১২০২ সাল। যে বছর বখতিয়ার খিলজি বাংলায় আসেন, সেই একই বছরে অহমদের পূর্বপুরুষেরা আবার আসামে আসেন চীন-বার্মা সীমান্ত থেকে। অন্যদিকে গোয়ালপাড়া, কাছাড় ও সিলেট হলো আসামের ৩০ শতাংশ ভূভাগ নিয়ে।

৪.
তাঁদেরই উত্তরপুরুষেরা ভ্রমণ ভিসা নিয়ে যাওয়ার পরও আটক হন আসামে। আর সাবেক বাহারবন্দ পরগনা চিলমারীর ব্যাপারীপাড়ার পিতৃহীনা-স্বামীহীনা রেজিনা বেগম আকাশ কাঁপিয়ে বলে ওঠেন, ‘বাপ নাই, স্বামীও মইরছে। ওই একটায় কামাইয়ে (উপার্জনকারী) ছেলে। হামরা কী খায়া বাঁচমো...!’

‘বালুর চরে একটা-আধটা রুটি খায়া বেটারা মোর লকডাউনে আটকা পড়ে আছিল। আর কত দিন থাকে? বাজানরা মোর চলি আইসতে ধরছে।’ বলছিলেন ভারতে আটক আনোয়ার হোসেন ও রাজা মিয়ার মা আনোয়ারা বেগম (৬৭) এবং নুরল হকের মা বেগম (৬৫)। প্রতিদিন মায়েরা, বউয়েরা আসছেন। কাল ঈদ।

লেখক: রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি।
nahidknowledge@gmail. com