ঈদ এবং সচেতনতার সার্থকতা

দূরে থেকেও কাছে থাকা সম্ভব। ঈদের দিনে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ইয়াসির আজমান
দূরে থেকেও কাছে থাকা সম্ভব। ঈদের দিনে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ইয়াসির আজমান

আপনজনদের কাছে ফিরে যাওয়ার মাঝেই ঈদের আনন্দ। বছরের পর বছর এভাবেই আমরা ঈদের আনন্দকে বাড়িয়ে দিই। তবে এবারের এই ঈদের দিনটা অন্য রকম। এই অন্য রকম ঈদটাকে মেনে নেওয়ার মাঝেই লুকিয়ে আছে আগামীর আনন্দ, ঈদের আনন্দ।

কয়েকটি বছর কাজের প্রয়োজনে দেশের বাইরে ঈদ করা ছাড়া আজ পর্যন্ত মনে পড়ে না কোনো একটি ঈদে মায়ের হাতের রান্না করা সকালের নাশতা ছাড়া ঈদের দিন শুরু করেছি। ঈদের জামাত শেষ করেই মায়ের খাবার টেবিলে হামলে পড়া। এ রকমই তো হয়ে থাকে আমাদের সবার ক্ষেত্রে। এবারও এ রকম হওয়ার কথা ছিল, কারণ আমি যেই বাসাটিতে ভাড়া থাকি, তার অন্য একটি ফ্লোরে মা–ও থাকেন। লকডাউনের ঠিক আগে আমার মা শাহেদা চৌধুরী সিলেটে বেড়াতে গিয়ে আটকে গেলেন, প্লেনে তো আসবেনই না, আমি নিজে ড্রাইভ করে আনতে চাইলেও মানা। মা তো সন্তানকে কোনোভাবেই কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে দিতে চান না। সব মা–ই তো তাই।

মা ছাড়া আর ও দুজন মানুষ ঈদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ঈদ উদ্‌যাপনে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য: বাবা ও বউ। বাবা এখন সবকিছুর ঊর্ধ্বে, চোখের পলকে চলে গেছে তিনটি বছর। কিন্তু আমার বউ ডা. সিফাত মেহরীণ কবীর তো সব সময়ই আছে আলো আর ঝড় ছড়িয়ে। বছরের পর বছর দেখছি ঈদের আনন্দকে কেমন করে দ্বিগুণ করে তোলে ঘর গুছিয়ে, ফুল সাজিয়ে, রান্না তদারকিতে। অতিথি এলে মুখে সূর্যের আলো, না আসায় মেঘে ভরা কালো। কিন্তু এবার বউয়ের খালা অসুস্থ হওয়ায় সে যেহেতু হাসপাতাল যাচ্ছে, নিজে একজন চিকিৎসক হয়ে, নিজেকে আরও কয়েকজন আত্মীয়ের সঙ্গে মেনে নিতে হয়েছে বাসায় ফিরে না আসার, পরিবারের বাকিদের নিরাপদে রাখার জন্য বাচ্চাদের ছেড়ে থাকছে অন্য একটি বাসায়।

দেশে আছি, মা ও বউ দেশে আছে কিন্তু ঈদের দিনটা শুরু হলো একদম উল্টোভাবে, যেটা কখনো কল্পনাও করিনি। একেবারে মিলে গেল ‘গ্রামীণফোনের স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ কথাগুলোর মতো—

‘দেহটারে চার দেয়ালে রাখলি না হয় তুই
মনের ঘুড়ি উড়াই আমি নীল আসমান ছুঁই

বিশ্বাসে যাব কাছে ফিরে ফিরে আবার
স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার...!’

দেশে থেকেও একসঙ্গে থাকা মানুষগুলো তিনটি জায়গায় থেকে ঈদের দিনটি উদযাপন করছি। যদিও টেলিকমিউনিকেশনের বদৌলতে দূরত্বটা কমে গেছে তাৎপর্যপূর্ণভাবে।

আমি প্রতিমুহূর্ত উপলব্ধি করছি আমাদের মন এত নিয়ম আর এত বারণ মানতে রাজি না। সারা বছর যারা দূরে থেকে কষ্ট করে যায় শুধু আপনজনের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে আপনজনের কাছে যাওয়ার, বছর ঘুরে আবার প্রিয়জনের মুখটা দেখার ব্যাকুলতা যেন কোনো বাধাই মানে না। বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এবারও তাই মানুষের ঘরে ফেরা। এই ব্যাকুলতা কোনো ভয়ভীতির কাছে হার মানতে রাজি না।

গত কিছুদিন কিছু চেনা মুখের চলে যাওয়াটাই বলছে, কত তুচ্ছ আমরা এই মহামারির কাছে। তারপরও সরকার তার সব ঢাল–তলোয়ার এবং সৈন্যবাহিনী নিয়েও ভালোবাসার এই প্লাবন থামাতে পারছে না। আমরা ছুটছি দলবদ্ধভাবে। সচেতনতা শব্দের মাঝে লুকিয়ে আছে এর অর্থ। নিজে সচেতন হওয়া ও সচেতনতার নিয়মগুলো মেনে নেওয়ার মাঝে এর সার্থকতা।

আমার এক আফ্রিকান বন্ধু একদিন এর মধ্যে ফোনে বলল, তার দেশে নাকি লকডাউনের অর্থ হচ্ছে অসম্ভবভাবে লকডাউন সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং এই সচেতনতার অর্থ হিসেবে সবাই সচেতনভাবে লকডাউন মানছে কি না, তা জানার জন্য একসঙ্গে বাইরে জমায়েত হওয়া। মনের কষ্টে বন্ধু আমার ব্যঙ্গ করছিল কি না জানি না, কিন্তু আমাদের এই আপনজনের কাছে ফিরে যাওয়ার জোয়ারটা কোনো অংশেই উদাহরণ হিসেবে কম না।

অতীত দেখে কষ্টে থেমে থাকা বা আজকের আত্মতৃপ্তিতে কালকের দিনটা কাটিয়ে দেওয়ায় আমার কখনোই সন্তুষ্টি হয় না। কাল বাদে পরশু যখন আমাদের সবার আবার ফিরে আসা, তখন চলুন সবাই একটু ভাবি, আগামী ঈদে যেন আবার আপনজনের কাছে ফিরে যেতে পারি ঈদ আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার জন্য।

এভাবে নয়, দূরত্ব মানতে হবে ঠিক ভাবে। ছবি: লেখক
এভাবে নয়, দূরত্ব মানতে হবে ঠিক ভাবে। ছবি: লেখক

আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না যে আমি বাইরে যাব না বা একবারও বাইরে যায়নি। কিন্তু বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনটাকে যাচাই বা প্রশ্ন করে নিই প্রতিবার। আসুন আমরা একটু সামনে তাকাই দুইটা দিন পরে যখন প্রিয়জনের মুখ দেখার ও ছোঁয়ার ব্যাকুলতা থামবে আগামীকাল। আশা করতেই পারি একটু বোধোদয় হওয়ার। বেঁচে থাকার জন্যই যেহেতু ঘরে বসে থাকা, আবার এই বেঁচে থাকার জন্যই শুধু যেন আমাদের বের হওয়া, নাইলে নয়।

ঈদের পরই শুরু হবে আবার জীবনযুদ্ধ। ধরে নেই আমরা শূন্য থেকে শুরু করছি কীভাবে চলতে হবে এই মহামারি কালে। মোবাইল কোম্পানিতে কাজ করার সুবাদে বলতে পারি মানুষের কথা বলা কমেছে অনেক, কাজ ও ব্যবসার কমতির জন্য। তারপরও সবারটা মিলিয়ে বিলিয়ন মিনিট কথা হচ্ছে। এখন থেকে প্রতিটা কথা বলায় আমরা যেন নিজেই আরেকজনকে প্রশ্ন করতে পারি যে নিয়মগুলো মানছি কি না, বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনগুলো যাচাই করছি কি না। কেন? দিরাইয়ের গোচিয়াতে নিজ গ্রামে ফোন দিয়ে জানলাম মানুষগুলো শুরুর দিকে একটু নিয়ম মানলেও এখন জীবনকে ঝুঁকির মুখে নিয়ে যাচ্ছে, একটু যেন ক্লান্ত জীবনের তাগিদে। সব জেনেও মানতে ভুলে যাচ্ছে। তাই প্রতিটি সোশ্যাল মিডিয়া ও পোস্টে বারবার আপনজনদের মনে করিয়ে দিই যে নিয়ম ভাঙার ভয়াবহতা কেমন হবে বা নিয়ম ভঙ্গে করব প্রশ্নবাণে জর্জরিত। প্রতিটি পত্রিকায় রেড ব্যানারে একটি স্লোগান দিয়ে দেওয়া যেতে পারে প্রতিদিন। আমাদের নিজেদের দায়িত্ব আমাদের নিজেদেরই নিতে হবে।

প্রথম দিকে যেমন a2 i, WHO, UNICEF, Brac, Grameenphone–এর নিজস্ব সচেতনতামূলক তথ্যগুলো ছিল খুব বেশি চোখে পড়ার মতো সবার পেজে, এখন একটু কমে এসেছে। আমি শিগগিরই আবার গ্রামীণফোনের সব চ্যানেলে সচেতনতামূলক কার্যক্রম তীব্রগতিতে শুরু করতে চাই। আপনিও আপনার জায়গায় আবার সচেতনতা বাড়িয়ে তুলুন। আসুন চেষ্টা করে যাই, সবাইকে জানিয়ে দিই কীভাবে নিয়মগুলো মানতে হবে। ঈদের আনন্দে সব ভুলে গিয়ে যেন বিপদ ডেকে না নিয়ে আসি। নিয়ম মানার মানে নয় যে ঘরে বসে থাকব, ঘরের বাইরে আমাদের যেতে হবে, আমাদের সমাজে লকডাউন পুরোপুরি মানায় না, কিন্তু কিছু নিয়ম কঠিনভাবে মেনে তবেই বাইরে কাজ করতে হবে। এটা ভেবে নেওয়ার কোনোই কারণ নেই যে আমাদের আগের মতো করেই কাজে ফেরত যেতে হবে। নতুন করে সাজিয়ে নিতে হবে কাজের ধারা, যা অনেকের জন্যই সম্ভব হবে না, তাই তাদের চলার পথকে সহজ ও নিরাপদ রাখতে আমাকে প্রয়োজন ছাড়া জটলা পাকানো চলবে না। সব কাজ, সব প্রসেস, সবাই ডিজিটাল করতে পারবে না, কিন্তু যেটা সম্ভব, যার জন্য সম্ভব সেটা যেন দ্রুততার সঙ্গে করতে পারি, করে ফেললে যেন আগের জায়গায় না যাই। তবেই আরেকজনের বাইরে যাওয়াটা নিরাপদ হবে।

সমাজের প্রতিটি স্তরে সঠিক নেতৃত্বের বড়ই প্রয়োজন। এই কঠিন সময়কে অতিক্রম করতে সরকার চেষ্টা করবে সর্বক্ষণ, তবে সহায়ক হয়ে সেই চেষ্টাগুলোকে সফল করার জন্য নেতৃত্ব দিতে হবে, অপেক্ষা যেন না করি এই ভেবে যে আরেকজন করবে।

এই ঈদের ছুটির পর জীবনযুদ্ধে যখন ফিরে আসব, মনে রাখতে হবে, একজন ব্যক্তির অসুস্থতা আপনাকে অসুস্থ করে ফেলতে পারে; ছোট ব্যবসাগুলো না বাঁচলে বড় ব্যবসাগুলো অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফল ভোগ করতেই হবে। অসম্ভব রকম এক বড় বিপদ নিজের জীবনে ধেয়ে আসা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে নিজেকেই উঠে দাঁড়াতে হবে।

তাই মন আর আবেগের ভুলে আর আমরা সচেতনতার কাছে হার মানব না, আরও জোরেশোরে প্রতিরোধ করব। ঈদের আনন্দ উদ্‌যাপনের মাঝে পরিবারের সবার কাছে এই প্রতিজ্ঞা করি, সবাই মিলে ভালো থাকি এটা কথায় সীমাবদ্ধ না রেখে আমরা কাজে প্রমাণ করি। তবেই আগামী ঈদে বাড়ি যাব অনেক আনন্দের সঙ্গে।

ঈদ মোবারক।

ইয়াসির আজমান: প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, গ্রামীণফোন লিমিটেড