মৃতের সংখ্যা, অপরাজনীতি ও মানবিকতা

আমরা যখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে কতজন আর করোনা উপসর্গে কতজন মারা গেছেন, এ নিয়ে অহেতুক বিতর্ক করছি তখন ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ রোববার একটি ব্যতিক্রমী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রথম পৃষ্ঠাসহ চার পৃষ্ঠাজুড়ে করোনায় মৃত মার্কিনদের তালিকা ছেপে দিয়েছে তারা। কোনো ছবি নয়, কোনো আবেগঘন অভিজ্ঞতার বিবরণ নয়, কেবল মৃতদের তালিকা। এবং তাতে বয়স উল্লেখসহ প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির পরিচয় তুলে ধরেছে একটিমাত্র বাক্যে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল, ‘যুক্তরাষ্ট্রে মৃত লাখের কাছে, অবর্ণনীয় ক্ষতি’।

কয়েকজনের পরিচয় এখানে তুলে ধরা হলো: অ্যাঞ্জেলিন মিকালোপুলোস (৯২) নাচে-গানে নির্ভীক, লিলা ফেনউইক (৮৭) প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী যিনি হার্ভাড ল থেকে স্মাতক করেন। রোমি কোহন (৯১) গেস্টাপো বাহিনীর হাত থেকে ৫৬টি ইহুদি পরিবারকে রক্ষা করেন, এপ্রিল ডান (৩৩) একজন প্রতিবন্ধী অধিকারকর্মী। ফ্র্যাঙ্ক গ্যাব্রিন (৬০) একজন জরুরি বিভাগের চিকিৎসক, যিনি স্বামীর বুকে মাথা রেখে মারা গেছেন, ফিলিপ কান (১০০) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন, স্প্যানিশ ফ্লুর কারণে যমজ ভাইকে হারিয়েছিলেন এক শতাব্দী আগে। উইলিয়াম ডি গ্রিক (৫৫), যিনি মানুষের জীবনের গল্পটাকেই সবচেয়ে বেশি জরুরি ভাবতেন (সূত্র: ডেইলি স্টার)। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ ১ হাজার জনের পরিচয় ছেপে বলেছে, এটি মোট মৃতের ১ শতাংশ মাত্র। তারা কেবল একটি সংখ্যা নয়। তাঁরা আসলে আমরাই।
বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন সাড়ে ৩৫ হাজার, মৃত্যুর সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়েছে। এখানে যাঁরা মারা গেছেন তাঁরাও আসলে আমরাই।

কিন্তু আমরা কি কথাটি জোর দিয়ে বলতে পেরেছি? পারিনি। পারলে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আরও ভালো প্রস্তুতি থাকত। করোনা পরীক্ষা নিয়ে আমরা এত কালক্ষেপণ করতাম না। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী আরও উন্নত হতো। মন্ত্রী–নেতারা আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলতেন না, আমাদের প্রস্তুতির কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। কিংবা ইউরোপ ও আমেরিকার চেয়ে আমাদের অবস্থা ভালো।

ভালো মানে কি মৃতের ও রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক কম হওয়া? আক্রান্তের তালিকায় বাংলাদেশ বিশ্বে দশম ও দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয়। যত বেশি পরীক্ষা হচ্ছে, আক্রান্তের সংখ্যাও তত বাড়ছে। তাহলে ভালো বলার সুযোগ কোথায়?

বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত মানুষদের মধ্যে রাজনীতিক আছেন, ব্যবসায়ী আছেন, চিকিৎসক–সেবিকা আছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য আছেন। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য আছেন। শিক্ষাবিদ–সাংবাদিক আছেন। এই লেখা তৈরির সময়ই খবর পেলাম সানবিম ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নিলোফার মঞ্জুর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানটি স্বল্প পয়সায় কিট উদ্ভাবন করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পরীক্ষা করতে পারেনি আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতার কারণে। অথচ তিনি যে কোভিড–১৯ পজিটিভ সেটি তাঁদের উদ্ভাবিত কিটের পরীক্ষাতেই জানা গেছে।

করোনা সংকটের শুরুর দিকে আমরা হারালাম সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মইনউদ্দিনকে। এরপর আরও কয়েকজন ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধা চিকিৎসক–সেবিকা, স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১০ সদস্য মারা গেছেন। ৩ জন সাংবাদিক মারা গেছেন। করোনায় আমরা লেখক–শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামানকে হারালাম।

কেবল করোনা নয়, গত সপ্তাহে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আম্পানেও বেশ কয়েকজন মানুষ মারা গেছেন। ফসল ও ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো প্রস্তুতি ছিল বলেই ক্ষতি কম হয়েছে। পরিসংখ্যান ভিন্ন কথা বলে। পৃথিবীতে যত ঘূর্ণিঝড় হয়, তার ১ শতাংশ হয় বাংলাদেশে। আর ঘূর্ণিঝড়ে যত মানুষ মারা যান তার ৫৩ শতাংশ মারা যান আমাদের দেশে। আমাদের প্রস্তুতির নমুনা হলো ২০০৭ সালে সিডর ও ২০০৯ সালে আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। প্রতিবছর কিছু জোড়াতালি দেওয়া হয় আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তা ও মতলববাজ ঠিকাদারদের পকেট ভারী হয়। ফলে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বহু স্থানে বাঁধ ভেঙে ফসল, চিংড়িঘের ধ্বংস হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে।

যদি সত্যিকার অর্থে কেউ আম্পানের তাণ্ডব কমিয়ে থাকে সেটি সুন্দরবন, সরকার নয়। তাই সুন্দরবনই ধন্যবাদ পেতে পারে। উন্নয়নের নামে আমরা এই বনটির ওপর অনেক অত্যাচার করেছি। তারপরও সুন্দরবন প্রতিবার বুক আগলে বাংলাদেশকে রক্ষা করে চলেছে।
করোনা সংকট মানুষের জীবন ও জীবিকাকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। হঠাৎ করে লাখ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। যাঁদের জীবনে হররোজ রোজা, তারা স্বাভাবিক অবস্থায়ই ঈদ করতে পারেন না। আর এবার করোনা–আম্পানের দ্বৈত আক্রমণের পর তাঁদের মনে ঈদের আনন্দ থাকার কথা নয়। ছিলও না।

যেকোনো আধুনিক রাষ্ট্রের নিয়ামক শক্তি হলো রাজনীতি। রাজনীতি ভালো না হলে প্রশাসন, প্রতিষ্ঠান, জনপ্রতিনিধি, কর্মকৌশল কিছুই ভালো হয় না। কিন্তু এই মহাদুর্যোগের সময়েও দেখি, তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে, নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের একশ্রেণির নেতা–কর্মী প্রাণঘাতী সংঘাতে লিপ্ত। পটুয়াখালীর বাউফলে প্রচারমূলক তোরণ নির্মাণকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপ মারামারি করেছে। এতে এক যুবলীগ কর্মী মারা যান। পৌরসভা চেয়ারম্যানের সমর্থকেরা তোরণ নির্মাণ করতে গেলে প্রতিপক্ষ বাধা দেয়।

ঈদের দিন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জেও আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় ৪ জন গুলিবিদ্ধসহ ১৩ জন আহত হয়েছেন। ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান মাহমুদ গ্রুপ ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা খোকন গ্রুপের দ্বন্দ্বের কারণে এ ঘটনা ঘটে। রাজনৈতিক ও মসজিদে ঈদের জামাতের টাকা তোলার বিরোধ নিয়ে মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার শলইনগর ও খর্দরহুয়া গ্রামে সোমবার স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন। এ সময় অর্ধশতাধিক বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট হয়।

অবস্থাদৃষ্ট মনে হচ্ছে, করোনো বা আম্পানের মতো মহাদুর্যোগও এদের সুমতি দেয়নি। নিবৃত্ত করতে পারেনি হানাহানি থেকে। এরা রাজনীতির নামে অপরাজনীতিই চালিয়ে আসছেন। বিরোধী দলে থাকতে এরা ভেজা বিড়াল হয়ে যান। ক্ষমতায় গিয়ে দাপট দেখান। আর ক্ষমতার নিয়ন্ত্রকেরা সব সময় এঁদের পক্ষে সাফাই গেয়ে থাকেন।

তবে এত সব অঘটন–হতাশার মধ্যেও যখন দেখি, করোনাকালে সাধারণ মানুষ অন্যের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন, তখন আশান্বিত হই। শেরপুরের নাজিমউদ্দিন ভিক্ষুক হয়েও তাঁর সঞ্চিত ১০ হাজার টাকা করোনায় আক্রান্তদের সহায়তায় দান করেছেন। ভৈরবের তরুণেরা গরিব ও দুস্থ মানুষের জন্য তৈরি করেছেন ‘আহার ঘর’, যেখানে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ মানুষের খাবার বিতরণ করা হয়। আরও অনেক স্থানে তরুণদের উদ্যোগে ‘আহার ঘর’, ‘বাজার ঘর’ ইত্যাদি গড়ে উঠেছে।

বিদ্যানন্দ নামের সংগঠনটির সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশেও। কয়েকজন উদ্যমী তরুণের গড়া এই প্রতিষ্ঠান লাখ লাখ মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। অনেকে তাদের মাধ্যমে দুর্গত মানুষকে সহায়তা করছেন। করোনো সংকটের আগেও তারা গরিবদের মধ্যে ১ টাকায় খাবার বিলাত। পত্রিকায় এসেছে, দিনাজপুরের একটি শিশু তার মাটির ব্যাংক ভেঙে গরিব মানুষকে সাহায্য করেছে।

অনেক কারণেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিতর্কিত। কিন্তু করোনাকালে এই যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অনেক মানুষ নিজেদের মধ্যে নেটওয়ার্ক তৈরি করে দুস্থ ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের নিয়মিত ত্রাণসামগ্রী দিচ্ছেন। অনেক নিজের নাম–ঠিকানাও প্রকাশ করছেন না। এক ভদ্রলোককে জানি, টেলিফোনে দুর্গত মানুষের নাম–ঠিকানা সংগ্রহ করে প্রত্যেকের বাড়ির দরজার সামনে খাবার রেখে আসেন। কাউকে নিজের পরিচয় জানতে দেননি। কোনো কোনো রাজনীতিকদের মতো এঁরা ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করতে গিয়ে ফটোসেশন করেন না।

স্বর্ণকিশোরী ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন বেশ কিছু এলাকায় তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। করোনা প্রতিরোধে স্বেচ্ছাসেবক সমিতি নামে আরেকটি সংগঠন আশুলিয়া, টঙ্গী, সাভার, গাজীপুর এলাকার কয়েক শ অতি দরিদ্র পরিবারকে নগদ অর্থসহায়তা করেছে। এ পর্যন্ত তারা আটটি উপকমিটি করে কাজ করছে। এ রকম আরও বহু প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও ব্যক্তি বিপন্ন মানুষকে সহায়তা করছে। এসব জন–উদ্যোগ আশা জাগায়।

আম্পান–বিধ্বস্ত সাতক্ষীরার কলারোয়া থেকে পানি এখনো সরে যায়নি। অনেক ঘরবাড়ি ডুবে আছে। এ অবস্থায় কলারোয়ার মানুষ ঈদের দিনেও ভাঙা বাঁধ বানাতে দল বেঁধে কাজ করেছেন। আবার কাজের মধ্যেই হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ পড়েছেন। এ ঘটনায় মনে হলো, বাংলাদেশের মানুষ যেকোনো অবস্থায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। তাঁরা হারবেন না।

সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]