করোনাকালে মাতৃত্ব আরও অনিরাপদ হলো

আজ নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। আজকের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের মায়েরা কি নিরাপদ, কিংবা কতটুকু নিরাপদ? অভাবনীয় এই মহামারি অনেক ক্ষতির মধ্যে আমাদের মতো সীমিত সম্পদ ও সামর্থ্যের দেশে যে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতি করেছে, তা হচ্ছে আমাদের প্রাক্‌-মহামারি নিত্যদিনের সংকট ও উন্নয়ন-উত্তরণ ভাবনা ও বিনিয়োগ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে বাধ্য করা।

বাংলাদেশে ৪৭ শতাংশ মা অর্থাৎ প্রতিবছর প্রায় ১৭ লাখ মা এখনো অদক্ষ পরিচর্যাকারীর হাতে সন্তান জন্ম দেন। এই মায়েরা এবং তাঁদের নবজাতকেরা থাকেন মৃত্যু এবং অসুস্থতার ঝুঁকির মধ্যে। যাঁরা হাসপাতালে সন্তান জন্ম দেন, তাঁদের অধিকাংশই পান নিম্নমানের সেবা। বাংলাদেশে ৩২ শতাংশ—প্রায় ১১ লাখ ডেলিভারি ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতালে হয়, যেগুলো কার্যকর অর্থে মান-নিয়ন্ত্রণহীন। তাঁদের অনেকে শিকার হন অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশনের। প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ৭ লাখ অপ্রয়োজনীয় সিজার হয়। বাধ্য হন বিশাল অঙ্কের অর্থ নিজের পকেট থেকে খরচ করতে। বাংলাদেশের মানুষ স্বাস্থ্যসেবার প্রায় ৭০ শতাংশ খরচ নিজের পকেট থেকে করে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চদের দলে। জাতি হিসেবে আমাদের স্বপ্ন, ২০৩০–এর মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে এ রকম দিকনির্দেশনাহীন, জবাবদিহিবিহীন স্বাস্থ্য খাত খুবই বেমানান।

করোনা মহামারি আমাদের ‘নিরাপদ মাতৃত্ব’ কে কি নিরাপদ করল, নাকি বাড়তি ঝুঁকির মধ্যে ফেলল? এখন পর্যন্ত গবেষণার ফল বলছে, কোনো করোনাক্রান্ত গর্ভবতী মা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের মধ্যে ভাইরাসটি আপনা–আপনি চলে আসবে না। এমনকি মায়ের দুধের মধ্য দিয়েও ভাইরাস সন্তানের মধ্যে যাবে না। কিন্তু মা কিংবা অন্যান্য পরিচর্যাকারীর নিশ্বাস, হাঁচি, কাশি কিংবা জীবাণুবাহী স্পর্শের মাধ্যমে নবজাতকের আক্রান্ত হবার আশঙ্কা পুরোমাত্রায় রয়েছে। যে ৫০ শতাংশ মা হাসপাতালে সন্তান জন্ম দিচ্ছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই হাসপাতালের পরিবেশ এবং সেবাদানকারীদের মাধ্যমে সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকবেন, যে ঝুঁকি শুরু হচ্ছে গর্ভকালীন সেবার সময় থেকে। প্রায় ৮৩ শতাংশ মা একাধিকবার স্বাস্থ্যসেবাদানকারীর সংস্পর্শে আসেন গর্ভকালীন।

২০১৪ তে ইবোলা মহামারিতে দেখা গেছে, মূল সংক্রমণের সরাসরি ক্ষতির চেয়ে পরোক্ষ প্রভাবের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশি। ২০০৩–এর সার্স সংক্রমণের সময় স্বাস্থ্যসেবা প্রায় ২৫ শতাংশ কমে গিয়েছিল। বাংলাদেশসহ ১১৮টি দেশের পরিসংখ্যান নিয়ে করা প্রাক্কলন বলছে, কোভিড-১৯ মহামারিতে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবার পরিধি ৬ মাসে প্রায় ৪৫ শতাংশ কমে গিয়ে অতিরিক্ত ৫৬ হাজারের বেশি মাতৃমৃত্যু এবং প্রায় ১২ লাখ শিশুমৃত্যুর আশঙ্কা তৈরি করতে পারে। তবে গবেষকেরা এটাও বলেছেন, সঠিক বিনিয়োগ ও কর্মকৌশলের মাধ্যমে এই অতিরিক্ত মৃত্যু এড়ানো যেতে পারে।

সম্প্রতি আমরা দেখেছি, করোনার আতঙ্কে অনেক জায়গায় চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত নন এমন গুরুতর অসুস্থ রোগী ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গর্ভ কিংবা প্রসবকালীন জটিলতাগুলো এবং অত্যাবশ্যকীয় নবজাতকের সেবা যেহেতু অত্যন্ত সময়-সংবেদনশীল, সময়মতো এই সেবা নিশ্চিত করা না গেলে প্রসূতি এবং সন্তান—দুজনেরই ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়।

সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জন করার ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা হচ্ছে আপৎকালীন স্বাস্থ্যসেবার অভাবনীয় খরচ। আমরা একটা বহুমাত্রিক দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কায় আছি। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষ প্রবল অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। এই অবস্থায় যখন মৌলিক প্রয়োজনগুলো মেটাতেই আমাদের পরিবারগুলো হিমশিম খাবে, তখন স্বাস্থ্যসেবার মুনাফালোভীদের শিকার হবেন একটা বিরাট অংশের মায়েরা। সুযোগসন্ধানী দুষ্টচক্রের প্ররোচনায় একদিকে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে, অন্যদিকে এই সংক্রান্ত বিপুল খরচ পরিবারগুলোকে ঠেলে দেবে দারিদ্র্যের অন্ধ চক্রে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো পরিবারগুলো ঋণগ্রস্ত হবে এবং পুষ্টি, শিক্ষার মতো অত্যাবশ্যকীয় বিনিয়োগ কমাতে বাধ্য হবে।

তাহলে মাতৃত্ব নিরাপদ হবে কেমন করে
আমারও আশাবাদী হতে ইচ্ছে করে, কিন্তু মহামারি বোঝায় এবং মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বেহাল অবস্থা দেখে আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাতারাতি পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় একটা শক্ত লাগাম টানতে চাই। যে পরিবর্তনটা মধ্য থেকে দীর্ঘ মেয়াদে প্রয়োজন, তা হচ্ছে মাতৃস্বাস্থ্যসেবাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পর্যায়ে স্থানান্তরের কৌশল নেওয়া। ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সেই অবকাঠামো এবং মোটামুটি জনবল আছে। পাইপলাইনে থাকা ধাত্রীদের সেখানে পদায়ন দিয়ে থাকা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে করে অধিকাংশ স্বাভাবিক ডেলিভারি ও অত্যাবশ্যকীয় নবজাতকের সেবা সেখানেই দেওয়া যায়। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে যদি প্রশিক্ষিত প্যারামেডিক দেওয়া যায়, তাহলে সেখানে প্রাথমিক গর্ভকালীন সেবা দেওয়া যেতে পারে। যেসব জেলা বা উপজেলা হাসপাতালে কার্যকর ২৪/৭ জরুরি প্রসূতিসেবা আছে, তাদের সঙ্গে একটা রেফারেল এবং পরামর্শমূলক যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। যেভাবে আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তি উন্নত হয়েছে, তাতে এটা সহজেই সম্ভব। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও গ্রহীতা—দুই পক্ষের আচরণ ও সেবাদানের পদ্ধতি পরিবর্তন এবং নজরদারিকে নিত্যদিনের স্বাস্থ্যসেবার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে করে বিদ্যমান সংক্রমণ ছড়াতে না পারে এবং নতুন সংক্রমণ দ্রুততম সময়ে চিহ্নিত ও নিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

এই কৌশলে যে লাভ হবে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, প্রথমত, ডাক্তারনির্ভর প্রসূতিসেবা কমবে এবং তাঁরা শুধু জটিলতার ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ দিতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান কমবে; কারণ, মিডওয়াইফরা ইউনিয়ন পর্যায়ে সিজার করতে পারবেন না, শুধু প্রয়োজনমাফিক রেফার করতে পারবেন। তৃতীয়ত, মাতৃস্বাস্থ্যসেবা দরিদ্র, মধ্যবিত্ত গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সহজলভ্যতার মধ্যে আসবে। চতুর্থত, এ ধরনের মহামারিতে হাসপাতালকেন্দ্রিক সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বহুলাংশে কমে আসবে।

মহামারি আমাদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন আনবে, কিন্তু জীবন থামবে না। এমন মহামারি আবারও আসবে, এমনকি কোভিড-১৯ এরই দ্বিতীয় সংক্রমণের আরেকটি মারাত্মক পর্যায়ে আমরা পড়তে পারি। আমাদের, এই ‘নেই রাজ্যের’ বাসিন্দাদের, আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে সমাধান খুঁজতে হবে নিজেদের আয়ত্তের মধ্যে থাকা বনিয়াদি ভিত্তিগুলোর মধ্যেই।

ইশতিয়াক মান্নান: জনস্বাস্থ্যকর্মী