বাঁধের আয়ু কেন কম, জবাব দেবে পাউবো?

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

২১ মে আম্পান ভারতের কলকাতায় পৌঁছানোর অনেক আগেই শরণখোলার সাউথখালীর বগিবাজার থেকে বাঁধ ছিঁড়ে যাওয়ার খবর আসে সকাল ১০টার একটু আগে। মোবাইলে ভিডিও আসে মানুষের আহাজারি আর ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে ছোটাছুটির। এই কষ্টের মধ্যেও অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীর সেই বিখ্যাত সংলাপ যেন কানে ভেসে এল—আম্পান যেন বলছে, ‘মারব এখানে আর লাশ পড়বে শ্মশানে’। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এখন জানাচ্ছে, আঘাতে খুলনার কয়রা, দাকোপ এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার আনুমানিক ১৭০টি স্থানে ৯৯টি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ আম্পানের মূল আঘাত ঘটেছিল ভারতীয় এলাকায়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে দেশের ১৩ জেলায় মোট ৮৪টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙেছে, যার দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ৭ কিলোমিটার। সারা দেশে প্রায় ১৭ হাজার কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে; তার মধ্যে ভেঙেছে মাত্র সাড়ে ৭ কিলোমিটার। এ রকম কথা শুনলে রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতা মনে না এসে পারে না। যা হোক, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, উপকূলবাসীর দুঃখের দিন গেল বলে উপকূলীয় এলাকার জন্য ৫ হাজার ৫৫৭ কিলোমিটার বাঁধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলো ইতিমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর উপমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের মেরামতের কাজ দ্রুত শুরু করা হবে। ২২ ও ২৩ মে ভাঙা বাঁধের জেলাগুলো দেখতে যান পানিসচিব। সে সময় বাছাই করা স্থানীয় প্রতিনিধি, জেলা প্রশাসন এবং মোতায়েন করা সেনা প্রতিনিধিদের সঙ্গে সভা করেন।

বাঁধ নিয়ে কথা উঠলে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের কথা মনে পড়ে। তিনি ছাড়া বাঁধ নিয়ে আর কি কেউ জীবনের গল্প এঁকেছেন? সাইমন আহমেদ কামরানের পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘শুনতে কি পাও’-এর কথাও মনে পড়ে। জহির রায়হানের এই ছোটগল্পটা বাঁধ আর বন্যানিয়ন্ত্রণ প্রকৌশলীদের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। বদ্বীপের মানুষের কাছে বাঁধ যে কী জিনিস, সেটা তিনি তাঁর ‘বাঁধ’ গল্পে অল্প কথায় বলেছেন। ‘...পর পর দুইডা বছর ফসল নষ্ট অইয়া গেল, খোদা না করুক, এবার যদি কিছু অয়, তাইলে যে কোনোমতেই জান বাঁচান যাইবে না।’

গল্পে মতি মাস্টারের দলে লোক কম ছিল কিন্তু তাঁরা এখন কয়রা, শরণখোলা, আশাশুনি, গাবুরা, পদ্মপুকুর, শ্যামনগর, কালীগঞ্জে সংখ্যায় বেড়ে হাজারে হাজার। জহির রায়হানের ভাষায় ‘ফাগুনে ফাগুনে তাঁরা দ্বিগুণ’ হয়েছে। ভেঙে যাওয়া বাঁধ তাঁরা রাত-দিন জেগে ভাটায় ভাটায় মেরামতের কঠিন কাজে নেমে পড়েছেন। পূর্ণিমার আগে ছিঁড়ে যাওয়া বাঁধগুলো জোড়া লাগাতে না পারলে তাঁদের ভবিষ্যৎ শেষ। এই করোনাকালে কাজের খোঁজে দেশান্তরি হওয়ার জো নেই। তাদের এখানেই করে কম্মে খেতে হবে। জমিতে লোনা পানির জোয়ার-ভাটা চললে সেটা সম্ভব নয়।

এক হপ্তার বেশি সময় চলে গেলেও ছিঁড়ে যাওয়া বাঁধের কারণে উপকূলের অনেক জনপদের বাড়িঘর এখনো দিনে দুবার জোয়ার-ভাটায় ডুবছে আর ভাসছে। রাষ্ট্রঘোষিত বাঁধের মালিকদের কাউকে পাশে না পেয়ে প্রায় সব জায়গায় স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ জোড়া দেওয়ার কাজে নেমেছে সাধারণ মানুষ। জহির রায়হানের গল্পে সম্ভব হলেও এখন নদীতে প্রবল জোয়ার থাকায় কোনো বাঁধ টিকছে না। একপাশের বাঁধ দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আরেক পাশ ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা।

গত মঙ্গলবার (২৬ মে) ভোর থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের লেবুবুনিয়ায় ৮ হাজার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ৩ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান। বাঁধ নির্মাণ শেষে বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই প্রবল জোয়ারে সেটি ভেঙে আবারও লোকালয়ে পানি ঢুকতে থাকে।
একই খবর এসেছে বুড়ি গোয়ালিনী ইউনিয়নের দাঁতিনাখালী ও কাশিমাড়ি ইউনিয়নের ঘোলা এলাকা থেকে। এই ‍দুই এলাকার মানুষও স্বেচ্ছাশ্রমে রিং বাঁধ নির্মাণ করে বাড়ি ফিরতে না-ফিরতে দুটি বাঁধই ভেঙে বাড়িঘরে পানি ঢুকে যায়।
গাবুরা গাইনবাড়ি এলাকার খবরও তাই। সাত-আট হাজার মানুষ দিনে সাত ঘণ্টা কাজ করে বাঁধ দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তিন জায়গায় ভেঙে পুরো এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। হতাশ আমেনা বাওয়া এক উন্নয়নকর্মীকে বলেছেন, ‘কতবার ভাঙবে আর আমরা কতবার সারাব, তা বুঝতেছি না। কী হবে আমাদের? এমপি-মন্ত্রীরা দলে দলে আসে আর তোমরা ফটো উঠাও, সমাধানের কোনো ভাও দেখি না। বানে জোয়ারে মরি আমরা।’

এই লেখার মাঝপথে খবর আসে, গাবুরা ইউনিয়নের দাঁতিনাখালী এলাকায় গিয়ে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক (২৮ মে) বাঁধ জোড়া দিতে ব্যস্ত মানুষদের বলে এসেছেন, ‘উপকূলে বাঁধ সংস্কারের জন্য আমরা সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিয়েছি। তারাই কাজ করবে। কীভাবে করবে সেটি তাদের ব্যাপার। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা আমার সঙ্গে রয়েছেন। তাঁরা দেখছেন।’ এক বেয়াদব নাকি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কত দিনে শেষ হবে আর শুরুই বা হবে কবে?’ মন্ত্রী ট্রাম্পের মতো বিরক্ত হতে পারতেন কিন্তু তিনি বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে জানিয়েছেন, ‘দ্রুত সময়ের মধ্যেই কাজ শুরু হবে। ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়ে গেছে। কত দিনে শেষ হবে, সেটি এই মুহূর্তে বলা যাবে না। তবে দ্রুত শেষ হবে।’

আশ্বাস-বিশ্বাসের পর মন্ত্রী কিছুটা ধমক কিছুটা ওয়াজের সুরে লোনা জলে দাঁড়িয়ে থাকা কপাল মন্দ মানুষদের জানিয়েছেন, ‘বাঁধ করে দেবে। কিন্তু বাঁধে প্রত্যেককে একটি করে গাছ লাগতে হবে। গাছ থাকলে বাঁধের ক্ষতি কম হয়। ঘুরে দেখেছি, যেখানে গাছ আছে সেখানে বাঁধ আছে। যেখানে গাছ নেই, সেখানে বাঁধের ক্ষতি হয়েছে। আপনারা যদি বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ না করেন, তবে এই এলাকায় ভবিষ্যতে বসবাস করতে পারবেন না। বিভিন্ন সময় জলোচ্ছ্বাস হবে, ঝড় হবে। বাঁধ রক্ষা করা না গেলে এখানে আপনাদের বসবাস করা কঠিন হয়ে যাবে। সবকিছু ভেসে যাবে। সে জন্য বাঁধে গাছ লাগিয়ে বাঁধকে রক্ষা করতে হবে। সরকার আপনাদের সহযোগিতা করবে।’ আহা মন্ত্রী যদি বলতেন, ‘দেশ যেমন জনগণের, বাঁধও তেমনি আপনাদের। এ বাঁধের মালিক আপনারা। এই যে পুলিশের বড় বাবু আমার সঙ্গে আছেন ওনার মোবাইল নম্বর লিখে নেন, কেউ যদি আপনাদের বাঁধ ফুটো করে ঘেরে পানি নেয়, তার নাম জানিয়ে দেবেন। ২৪ ঘণ্টা লাগবে না তাকে সোজা করতে। এখানে গাছ লাগান, গাছও আপনার ফলও আপনার। পানি বোর্ডের কেউ সেসব দাবি করতে পারবে না।’

বাঁধের মালিকানা কি মানুষকে দেওয়ার বিধান আছে?
আছে, আর এটা করার জন্য দেশটাকে কিউবা বা মন্ত্রীকে কমিউনিস্ট হতে হবে না। এই পানি উন্নয়ন বোর্ড স্থানীয় ভূমিহীনদের সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় সরকার আর উন্নয়ন সংগঠনের সহযোগিতায় ভোলার চরফ্যাশনে বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের একটা অসাধারণ উদাহরণ তৈরি করেছিল আজ থেকে ১৯-২০ বছর আগে। সে বাঁধে ইঁদুরে গর্ত করে না। সে বাঁধ ঝড়ের কথা শুনেই ছিঁড়ে যায় না। সেখানে এক ভূমিহীন পরিবারকে বেড়িবাঁধের ১ কিলোমিটার করে জায়গা দেওয়া হয়েছে, সেখানে সে ঘর তুলে থাকে, বেড়িবাঁধের ঢালে সবজি বা ফসল ফলায়, বড় বড় ফলের গাছ কাঠের গাছ লাগিয়ে রাখে। এই ব্যবস্থায় বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় প্রায় নেই বললেই চলে। বরং, ভূমিহীন মানুষেরা ভূমি পায়, তাদের আয়ের সংস্থান হয়। কিন্তু, এতে শুধু দুর্নীতির সুযোগ কমে যায়। তাই পরীক্ষামূলক এই প্রকল্প সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও সেটা আর অনুসরণ করা হয় না।

১৯৯১-এর জলোচ্ছ্বাসের পর ভোলা আর লক্ষ্মীপুরের মাঝামাঝি চর জহিরুদ্দিনের বেড়িবাঁধ একই নিয়মে বাঁধা হয়। পরে অবশ্য রাজনৈতিক মাফিয়া আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক শ্রেণির ‘বিপথগামী’ কর্মকর্তার যোগসাজশে বাঁধের গাছ প্রায় লোপাট হয়ে গেলেও বাঁধটা এখনো টিকে আছে। মন্ত্রী চাইলে সেসব প্রকল্পের নথিপত্র, মূল্যায়ন প্রভৃতি পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে তলব করতে পারেন। চাইলে বুয়েটের অধ্যাপকদের দিয়ে বিষয়টি আবার মূল্যায়ন করে দেখতে পারেন। দুর্নীতির উইপোকায় ছাওয়া সাবেক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠামূলক একটা ব্যবস্থাপনায় যেতে না পারলে সাইক্লোন আর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধির বিপদের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

রোল মডেল হতে হলে দীর্ঘ মেয়াদে এই টেকসই ব্যবস্থায় যেতে হবে। বেড়িবাঁধের মালিকানা স্থানীয় মানুষের হাতে দিতে হবে। চরমভাবে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বেড়িবাঁধের নির্মাণ বা ব্যবস্থাপনায় আর আগের ভূমিকায় রাখা যাবে না।

জনগণ জান কোরবান করে খেয়ে না-খেয়ে রোজা মুখে আর ঈদের দিনে বাঁধ মেরামতে নেমে যান। তাঁরা বাঁধকে জানের চেয়েও ভালোবাসেন। এ বাঁধের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ তাঁরাই করতে পারবেন, যদি থাকে তাঁদের মালিকানা।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক।
nayeem 5508 @gmail.