সরকার একলা চললে ভোগান্তি বাড়বে

ইমতিয়াজ আহমেদ। ফাইল ছবি
ইমতিয়াজ আহমেদ। ফাইল ছবি
>

ইমতিয়াজ আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক। চলমান কোভিড–১৯ মহামারি মোকাবিলা বিষয়ে তিনি সম্প্রতি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান 

প্রথম আলো: এই মুহূর্তে সরকারের কী করণীয়?

ইমতিয়াজ আহমেদ: কোভিড–১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষা আরও বাড়াতে হবে। পরীক্ষা বাড়লে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। অবশ্য, আনুপাতিক হারে অবস্থাটা একই থাকছে। অন্য কিছু দেশের তুলনায় বিপজ্জনক সীমায় এখনো পৌঁছায়নি। এ দেশের প্রতি বর্গমাইলে ৩ হাজার মানুষের বাস। তাদের ৯০ ভাগ অনানুষ্ঠানিক খাতের (কৃষিসহ) কর্মজীবী। তারা মূলত দিনমজুর। করণীয় নির্ধারণে এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিতে হবে। অনেকে নিউজিল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার প্রশংসা করেন। কিন্তু সেখানে প্রতি বর্গমাইলে যথাক্রমে মাত্র ৪৬ ও ৭ জনের বাস। সেখানে ঘরে ঘরে গিয়ে পরীক্ষা করা ও চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। তাই এ রকম উদাহরণ দিয়ে এখানে আতঙ্ক সৃষ্টি করার বিষয়ে একটু চিন্তা করা উচিত। ডব্লিউএইচও বলছে হাত ধুতে, মাস্ক পরতে ও শারীরিক দূরত্ব মানতে। এগুলো এত ব্যয়বহুল নয়, যা জোগাড় করার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। শক্তিশালী পোশাক খাত মাস্কসহ সুরক্ষাসামগ্রীর বিরাট জোগানদাতা হতে যাচ্ছে।

প্রথম আলো: এন–৯৫ মাস্কের মতো স্বাস্থ্যকর্মীদের যা দরকার, তা তারা দিতে পারবে?

ইমতিয়াজ আহমেদ: জনসাধারণের জন্য দরকার সাধারণ মাস্ক। আর যে দেশ পিপিই রপ্তানি করতে পারছে উন্নত দেশে, তার পক্ষে এন–৯৫ মাস্ক তৈরি করা সম্ভব। যাঁরা লকডাউন ও কারফিউর কথা বলছেন, তাঁরা বুঝতে পারছেন না, পথশিশুদের সংখ্যা কত। রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনগুলোর ডাকে রাজপথে লাখো মানুষ ও ছাত্রের ঢল নামে। এখন তারা মানুষকে সংগঠিত করছে না। অন্যদিকে ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, প্রশিকার মতো বৃহৎ এনজিও আছে। কেউ বিশ্বে বৃহত্তম।

প্রথম আলো: তাদের অনেকে অতীতের দুর্যোগে বড় কাজ করেছে।

ইমতিয়াজ আহমেদ: সেটাই। আমি এবার অবাক হলাম। হতে পারে স্যার ফজলে হাসান আবেদ নেই, ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিকভাবে অযথাযথ অবস্থানে, হয়তো বয়সও একটা বিষয়। রেহমান সোবহানও প্রবীণ। ১৯৯৬ সালের দুর্যোগকালে তাঁদের সঙ্গে আমিও প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছিলাম। তাঁরা তখন বিশাল একটা এনজিও ফোরাম তৈরি করেছিলেন। এবার অবশ্য নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বাধীন এনজিওগুলোর অভিজ্ঞতারও ঘাটতি থাকতে পারে। অথবা তারা দাতাদের তরফে তহবিল পাচ্ছে না।

প্রথম আলো: অফিস পুরোদমে চলবে, গণপরিবহন চলবে সীমিতভাবে, এই সিদ্ধান্ত সঠিক?

ইমতিয়াজ আহমেদ: ভালো প্রশ্ন। সরকার বাছাই করে লকডাউন খুলছে। প্রতিদিন পরীক্ষা ২০ হাজারে উন্নীত করা জরুরি। তাহলে আমরা প্রকৃত সংক্রমণের বিস্তার বুঝতে পারব। আমি এর আগে জনগণকে সংগঠিত করার যে কথা বলেছি, তার সঙ্গে এই তিনটি বিষয়ের কার্যকরতা জড়িত। সরকার যদি মনে করে, সে একাই করবে, এনজিওসহ অন্যদের আনা ঠিক হবে না, তাহলে আমাদের ভোগান্তি বাড়বেই।

প্রথম আলো: দৈনিক ১০ হাজার পরীক্ষায় পৌঁছাতে প্রায় তিন মাস লাগল। আরও ১০ হাজার যুক্ত করতে কতটা সময় লাগবে, সেটা প্রশ্ন। জনগণ মাস্কও পরছে না। তিন শর্ত পূরণে ঢিলেঢালা।

ইমতিয়াজ আহমেদ: বিজিএমইএ এখানে সাংঘাতিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তারা প্রচুর মুনাফা করেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক হয়ে তারা যদি জনগণকে বিনা মূল্যে সাধারণ মাস্ক না দিতে পারে, তাহলে তাদের অবসরে যাওয়া উচিত। বিদেশে চলে যাওয়া উচিত, যেখানে বেশির ভাগের ছেলেমেয়েরা থাকেন। আমরা বারবার সরকারের করণীয় বলছি। কিন্তু আমাদের তো একটা বড় বেসরকারি খাত আছে। বিজিএমইএ যদি পথশিশুদেরও মাস্ক দিতে না পারে, তাহলে কারা পারবে?

প্রথম আলো: বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ভূমিকা কী?

ইমতিয়াজ আহমেদ: ভীষণ দুর্ভাগ্যজনক। হিপোক্রেটিস (প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসাবিদ, যাঁর নামে চিকিৎসকেরা শপথ নেন) বা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল এসব দেখলে আত্মহত্যা করতেন। চিকিৎসা পেশা তো অন্য দশটা পেশার মতো নয়। তারা পয়সার জন্য পেশায় এলে তাদের ব্যবসায় নামা উচিত ছিল। এটা পরিতাপের যে চিকিৎসা ও ব্যবসা এক হয়ে গেছে। বেসরকারি হাসপাতাল কেমন চলছে, তা দেখতে একজন সরকারি প্রতিনিধি বসিয়ে দেওয়া উচিত। সরকারের দায়িত্ব তদারক করা। এটা হচ্ছে না, এর একটা কারণ হাসপাতালের কোনো প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে হয়তো রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা আছে। এভাবেই রাজনীতির সঙ্গে ব্যবসা ও আমলাতন্ত্রের একটা যোগসাজশ তৈরি হয়। অতিমারির সময় তাই আমরা তাদের দিক থেকে একটি নেতিবাচক ভূমিকা দেখছি। মাস্ক, হাত ধোয়ানো ও দূরত্বের শর্ত পূরণে কিন্তু রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের নজরদারির দরকার নেই। দরকার পাড়ায়–মহল্লায় দলগুলোর দ্বারা আমজনতাকে উদ্দীপ্ত করা। শুধু পুলিশ বা মিলিটারি এটা করতে পারবে না।

প্রথম আলো: সাংসদদের অধিকাংশই দৃশ্যত নিষ্ক্রিয়, সার্বিকভাবে জনপ্রতিনিধিরাই দৃশ্যপটে কম। আমলাতন্ত্রই নেতৃত্বে।

ইমতিয়াজ আহমেদ: আমলাতন্ত্রই সমন্বয় করবে। কিন্তু জনগণকে সম্পৃক্ত করা তো তাদের কাজ নয়। মহল্লার মানুষ নেতাকে চেনে, সচিব অচেনা। প্রশ্ন হলো, রাজনীতিকেরা এখন অপেক্ষা করছেন কেন? আগে ঝড়তুফান এলে তো নেমে পড়তেন। এখন মেয়রদের ওয়ার্ড কমিশনারদের সংগঠিত করতে হবে, ছাত্র–যুব নেতাদের সংগঠিত করতে হবে তাঁদের কর্মীদের। এভাবে তৃণমূল পর্যায়ে উদ্যোগী না হলে করোনার টিকা আসার আগ পর্যন্ত ওই তিন শর্ত পূরণ করা দুরূহই থেকে যাবে।

প্রথম আলো: স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় জিডিপির ১ শতাংশের নিচে, মানুষ মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ মেটায় নিজের পকেট থেকে।

ইমতিয়াজ আহমেদ: আসন্ন বাজেটে এ বিষয়ে মনোযোগ প্রত্যাশিত। একই সঙ্গে আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যক্রমে জনস্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শুধু বাজেট ও অবকাঠামো বাড়ানোই নয়, সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা থাকতে হবে। পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ সম্পর্কে বলা হয়, তারা বেশ নিরাপদেই আছে। কারণ, তারা আগে থেকেই মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করত। আমাদের জনগণকেও সেটা রপ্ত করাতে হবে। ত্রাণ বিতরণের সঙ্গে এবার ভাইরাস সংক্রমণ যুক্ত হয়ে পড়েছে, যা বন্যার ত্রাণে ছিল না। ক্ষুধার্ত মানুষ তঁার কাছের জায়গায় ত্রাণ না পেলে দিনে বা রাতে, সুযোগ পেলেই তিনি এলাকা বদলাবেন। তিনি ভাইরাস ছড়াবেন। এমনকি যিনি তঁার ত্রাণ মেরে দিলেন, ওই ব্যক্তি ত্রাণের আশায় তঁার বাসাতেও চলে আসতে পারেন। ত্রাণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য মহল্লাকেন্দ্রিক নজরদারি বাড়ানো দরকার।

প্রথম আলো: করোনায় বাক্স্বাধীনতার হালফিল বলুন। জাতিসংঘের একটি বিশেষজ্ঞ গ্রুপ সাংবাদিক গুম ও নিগ্রহে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

ইমতিয়াজ আহমেদ: বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সর্বদা একটি আপেক্ষিক বিষয়। কোনো ব্যক্তি পছন্দের সরকারের সময় চুপ ছিলেন, কিন্তু অপছন্দের সরকারের সময় হইচই ফেলে দিয়েছেন। অতিমারিতে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা আমি বলতে পারছি কি না, সেখানে নজরদারি বাড়ানো দরকার। আমি ভাইরাস রোধে ব্যর্থ হলাম, কিন্তু মুখ বন্ধ করলাম। তাতে কোনো লাভ হবে না। আমরা কিন্তু বড় মাপের গণতন্ত্রচর্চা কখনো করতে পারিনি।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

ইমতিয়াজ আহমেদ: ধন্যবাদ।