আসাদকে বাঁচিয়ে ইরান কী পেল

এএফপি ফাইল ছবি
এএফপি ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধে ইরানের অর্থনীতির বিপন্ন বহুদিন। এর মধ্যেই দেশটি সিরিয়াযুদ্ধে ২০ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। বিশ্ববাসীকে এ রকমই তথ্য দিলেন দেশের একজন আইনপ্রণেতা গত মাসে। তথ্য দিয়েই থামেননি। বলেছেন, এই যুদ্ধ-খরচ ইরানের ফেরত পাওয়া উচিত। বক্তা হেসমতুল্লাহ একসময় দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলেন।

হেসমতুল্লাহর কথায় বোঝা যাচ্ছে, সিরিয়াযুদ্ধ নিয়ে ইরান লাভ-ক্ষতির হিসাব করছে। আসাদকে পরাজয় থেকে রক্ষা করেছে তাদের মদদ। কিন্তু এ প্রশ্নও উঠেছে, এই যুদ্ধে যুক্ত হয়ে ইরানবাসী কী পেল?

দশটি বাহিনীর হাতে রক্ত ঝরছে সিরিয়াবাসীর
সিরিয়াযুদ্ধের ৯ বছর শেষ হলো। এ কালের যুদ্ধের ইতিহাসে সিরিয়া অতি জটিল ময়দান। এখানে পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি অনেক। স্থানীয় লোকজনের জন্য অবস্থাটি দুর্ভাগ্যজনক। যদিও সবাই তাদের কথা বলেই যুদ্ধে যুক্ত। বাশার আল-আসাদ সরকার ও বিদ্রোহী পক্ষ ছাড়াও এখানে আছে আইএস, লেবাননের হিজবুল্লাহ, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, তুরস্ক, ইরান ও কুর্দিরা। এক অর্থে ইসরায়েলও এই যুদ্ধে সক্রিয়। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবেই এই যুদ্ধে শরিক প্রায় ১০টি শক্তি।

এরা আবার মোটেই দুই শিবিরে বিভক্ত নয়। পারস্পরিক স্বার্থে তারা কাছে আসছে, দূরে যাচ্ছে। যেমন আসাদ প্রশ্নে বিপরীত অবস্থান হলেও আইএস মোকাবিলায় ইরান-যুক্তরাষ্ট্রে সমঝোতা ছিল। আবার রাশিয়া-ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক পরিসরে বৈরী সম্পর্কে নেই। কিন্তু সিরিয়ায় তাদের স্বার্থ এক রকম নয়। সৌদিদের বিরুদ্ধে এককাট্টা দেখা গেলেও সিরিয়ায় তুরস্ক ও ইরানের অবস্থান বিপরীত মেরুতে। এ রকম জটিল গণিতের মধ্যেই বাশার আল-আসাদ টিকে আছেন। সেই কর্তৃত্বের একটা অংশ ইরান ও হিজবুল্লাহর; আরেক অংশ রাশিয়ার।

ইতিমধ্যে প্রায় ৬ লাখ মানুষ মারা গেছে। আরও প্রায় ৬০ লাখ বিভিন্ন দেশে আশ্রিত। দেশের ভেতরও বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত হয়েছে আরও ৬০ লাখ। মাত্র দুই কোটি মানুষের দেশে এ রকম ভয়াবহ অবস্থা।

দেশটির শহুরে ৫০ ভাগ মানুষই এই যুদ্ধে আক্রান্ত। অনেক শহর পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। এ রকম পোড়াভূমির বড় অংশ আসাদ সরকারের হাতে থাকলেও যুদ্ধরত সব পক্ষের হাতেও কিছু কিছু অঞ্চল আছে। সর্বশেষ গোলাগুলি লেগে আছে তুরস্ক সীমান্তের কাছে ইদলিবকে ঘিরে। আসাদ সরকার এটা ফিরে পেতে চায়।

তুরস্কের হয়ে সেখানে ছদ্মযুদ্ধে আছে নানান আদর্শের বেশ কিছু যোদ্ধাদল। তাতে আছে আল-কায়েদার সমর্থক ‘হায়াত তাহরির আল শাম’ও। আর সিরিয়ার পক্ষে আছে রাশিয়ার কিছু ‘প্রক্সি’। কুর্দিরাও তাতে যুক্ত। তুরস্কের জন্য এই অঞ্চলটি বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটি রক্ষায় তারা সিরিয়ায় ইসরায়েলের বিমান হামলাকেও স্বাগত জানাতে দ্বিধা করবে না।

যে যুদ্ধে কেউ জয়ী হচ্ছে না
৯ বছর ধরে সিরিয়ায় এ রকম অরাজকতা দেখতে দেখতে বিশ্ব এখন ক্লান্ত। সবাই প্রায় এ সংকটে উদাসীন। সামান্য যা বিতর্ক হয় মাঝেমধ্যে, আসাদ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে কি করেনি। সংকটের রাজনৈতিক সমাধানে কারও আন্তরিক আগ্রহ দেখা যায় না। আসাদ ও বিরোধী পক্ষকে আলোচনায় বসানোরও চাপ নেই।

এই যুদ্ধের শুরু হয়েছিল বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে দেশবাসীর একাংশের যৌক্তিক নাগরিক অসন্তোষ থেকে, যা ছিল ‘আরব বসন্তে’র জের। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো সেই অসন্তোষকে ছিনতাই করে একটা বহুপক্ষীয় যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ দেয়। কিন্তু যুদ্ধরত পক্ষগুলোর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য এখন অস্পষ্ট। কেউই কার্যত জয়ী হতে পারছে না সিরিয়ায়।

যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দিকে আসাদবিরোধীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সেই উদ্যোগের সর্বশেষ ফলাফল আর জানা যায় না। আইএসকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র ও কুর্দিদের যে মৈত্রী গড়ে উঠেছিল, সেটাও তুরস্কের কুর্দিবিরোধী অভিযানে বেশ নড়বড়ে হয়ে গেছে। কুর্দিদের যেকোনো বাড়তি সুবিধার বিরুদ্ধে তুরস্ক। এটা তার জাতীয়তাবাদী গরিমা। সেই বাধা জারি রাখতে তাকেও বড় বিনিয়োগে সিরিয়ায় থাকতে হচ্ছে। দেশটির অনেকখানি ‘নিরাপদ অঞ্চল’ গড়ার নামে দখল করে আছে তারা। তুরস্ক কুর্দিদের বিপক্ষে হলেও আসাদবিরোধী অন্যান্য শক্তির পক্ষে। রাশিয়া আবার এদের বিরুদ্ধে। অথচ সিরিয়া ও লিবিয়ার বাইরে আন্তর্জাতিক পরিসরে রাশিয়া-এরদোয়ান ভালো বন্ধু। এর মধ্যে সিরিয়াজুড়ে হিজবুল্লাহ আর কুর্দিদের সঙ্গে দায়েশের চোরাগোপ্তা হামলা-পাল্টা হামলাও চলছে। এভাবে সিরিয়ার রণক্ষেত্র পারস্পরিক রক্তক্ষয়ের অনন্ত যুদ্ধের রূপ নিয়ে আছে। ইরান ও তুরস্কের ঠান্ডাযুদ্ধ তাতে বাড়তি জ্বালানি দিচ্ছে। অথচ এই দুই দেশ সৌদিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে ছদ্মযুদ্ধে খুব কাছাকাছি।

এ রকম অবস্থার মধ্যেই সম্প্রতি খবর ছড়াল, ইরান সিরিয়ায় সৈন্য সংখ্যা কমাতে চলেছে। ইরান সে খবর অস্বীকার করেছে। তারা বলছে, এটা ইসরায়েলের প্রচারণা। তবে এ-ও সত্য, জেনারেল সোলাইমানিকে হারিয়ে সিরিয়াযুদ্ধে ইরানের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। করোনা ও অর্থনৈতিক অবরোধেও কাহিল তারা। অর্থনীতি চরম চাপে পড়েছে। ইরানের করদাতাদের সামনে তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, সিরিয়ায় বিপুল সম্পদ খুইয়ে আসাদকে রক্ষা করে কী অর্জন করছেন তাঁরা? ভূ-রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা বলছেন, ইরানের মতোই উপলব্ধি রুশদেরও। তেলের দাম পড়ে যাওয়া এবং করোনার কারণে রাশিয়ার আর্থিক অবস্থাও ভালো নেই। ইরানে যেমন কয়েকজন জনপ্রতিনিধি এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন, তেমনি রাশিয়ায় পুতিন সমর্থক কিছু দৈনিক আসাদের দুর্নীতির খবর ছাপছে। আসাদের জন্য এসবই খারাপ ইঙ্গিতবহ। ইরান ও রাশিয়া আসাদকে না চাইলে তাঁকে সরে যেতে হবে।

সিরিয়ায় ফাঁদে পড়েছে ইরান?
একাধিক শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে ৯ বছর যুদ্ধে টিকে থাকা যেকোনো শাসকের জন্য গৌরবের। বহু সৈনিক সরকারি বাহিনী থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। বহু জেনারেল নিহত হয়েছেন বিরোধীদের হামলায়। কিন্তু আসাদ এখনো টিকে আছেন। প্রায় ২০ বছর তিনি ক্ষমতায়। এই গৌরব কতটা উপভোগ্য হচ্ছে, বলা মুশকিল। তাঁর টিকে থাকার বিনিময়ে দেশটির বিপুল এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ৯ বছর দীর্ঘ সময়। কিন্তু দেশটির রাজনৈতিক সংকটের কোনো সমাধানও খুঁজে বের করতে পারেননি তিনি। সিরিয়াকে যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে বের করার সক্ষমতা আসাদের রয়েছে কি না, তাতে দেশে-বিদেশে সন্দেহ আছে। সিরিয়ায় টেকসই শান্তির জন্য আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কার দরকার। আসাদের পক্ষে তাতে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয় বলেই ধরে নেওয়া যায়। পুরোনো সমর্থক পরিমণ্ডলেও তাঁর জনপ্রিয়তা কমছে। দীর্ঘ যুদ্ধে সবাই ক্লান্ত।

অর্থনৈতিক সংকটে নাগরিকদের জীবন-জীবিকায় প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে পারছে না সরকার। দেশটি আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে অনেক দিন একঘরে। যুদ্ধের আগে যুক্তরাষ্ট্রের এক ডলারের বিনিময়ে সিরিয়ায় ৪৭ পাউন্ড পাওয়া যেত। এখন সেটা প্রায় এক হাজার পাউন্ডে দাঁড়িয়েছে। মূলত ইরানের সহায়তায় সিরিয়ার আর্থিক খাত দাঁড়িয়ে আছে।

অতিরিক্ত ইরাননির্ভরতা আসাদের জন্য বিপদও তৈরি করেছে। যুদ্ধ যত এগিয়েছে, তত তিনি ইরান-রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়েছেন। ফলে এই দুই দেশ যা চাইবে, তাঁকে সেটাই মেনে নিতে হবে এখন। কিন্তু আসাদ বিদায় নিলে দেশটি থেকে আরেক দফা শরণার্থী স্রোত বইবে ইউরোপের দিকে। ইউরোপ তাতে উদ্বিগ্ন। তারা হয়তো আসাদকে রেখেই সমাধান চাইবে। কিন্তু আসাদ নিজে দেশটিতে অস্থিতিশীলতার প্রতীক হয়ে আছেন। তাঁকে রেখে সমাধান খুঁজতে হলে ইরানকে সিরিয়ায় থাকতে হচ্ছে। তার অর্থ দাঁড়ায় ইরান নিজে থেকে এক ধরনের ক্ষয়ক্ষতির ফাঁদে পড়েছে সিরিয়ায়। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রও সেখানে কুর্দিদের প্রতি দায়-দায়িত্বের ফাঁদে পড়েছে। তবে ইরানের জন্য এই ফাঁদ অতিরিক্ত ব্যয়বহুল। সিরিয়ায় কেবল বন্দুক নিয়ে টিকে থাকাই যথেষ্ট নয়। দেশটিকে পুনর্গঠন করাও প্রয়োজন। আসাদ সরকারের সেই সামর্থ্য নেই। এ সরকার আন্তর্জাতিক সাহায্য আনতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে আসাদের বিকল্পই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে কাছে টানার উপায় হতে পারে। সবাই তাই ইরানের দিকে তাকিয়ে আছে।

সিরিয়ার বর্তমান সরকার ওই অঞ্চলে ইরানের পুরোনো নির্ভরযোগ্য মিত্র। আসাদকে সরিয়ে দিতে চাইলে সেখানকার ইরান সমর্থক পুরো শাসন কাঠামো ভেঙে পড়ার শঙ্কা আছে। শিয়া-সুন্নি সমীকরণ তৈরি হতে পারে তখন। জনসংখ্যার ৭০ ভাগ সুন্নি হওয়ায় তারা শাসন কাঠামোতে বাড়তি হিস্যা চাইবে। এতে লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইরানের সরবরাহ লাইনও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইরান কি এসব ঝুঁকি নেবে? নাকি নিতে বাধ্য হবে?

পুতিনই কি আসাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন?
সিরিয়ায় উপস্থিতি বজায় রাখতে ইরানি শাসকেরা ইসরায়েলকে মোকাবিলার কথা বলে থাকেন। কিন্তু ইসরায়েলকে সামরিকভাবে মোকাবিলার বেলায় সিরিয়া থেকে ইরান বাড়তি কোনো সুবিধা পেয়েছে বলে প্রমাণ মেলে না। সিরিয়ায় ইসরায়েলের উসকানিমূলক বিমান হামলার সামান্যই পাল্টা জবাব দিতে পারে তারা। সোলাইমানির পর ইরাক-সিরিয়া-লেবানন মিলে নিজেদের সমগ্র উপস্থিতিকে সমন্বয় করা ইরানের জন্য দুরূহ। তেহরান কিছুদিন হিজবুল্লাহকে দিয়ে এই সমন্বয়ের চেষ্টা করলেও ইরাকে তা কোনো সুফল দেয়নি। ফলে ইরানের ‘কুদস্ ফোর্স’কে প্রতিটি রণাঙ্গনে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে থাকতে হচ্ছে এই মুহূর্তে। এ অবস্থায় রাশিয়া যদি আসাদকে ত্যাগ করতে মনস্থ করে, তাহলে ইরানের একার পক্ষে তাঁকে রক্ষা করা বেশ কঠিন। তাতে তুরস্কের সঙ্গে ইরানের বৈরিতাও আরও বাড়বে।

সিরিয়ার আকাশ এ মুহূর্তে রাশিয়ার জিম্মায়। এ কারণে ইরানের পক্ষে সেখানে রাশিয়ার সমর্থন ছাড়া স্থলযুদ্ধে এগোনো দুরূহ। রাশিয়াকে নাখোশ করে তুরস্কের সঙ্গে যুদ্ধ করাও কঠিন। ফলে আসাদের ভাগ্য শেষ বিচারে পুতিনই নির্ধারণ করে দিতে পারেন।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক