সিকদারদের পেছনে কারা?

রন হক সিকদার ও দিপু হক সিকদার।
রন হক সিকদার ও দিপু হক সিকদার।

বছর পাঁচেক আগে আমার মায়ের পেনশন-সংক্রান্ত কাজে সোনালী ব্যাংকের রমনা করপোরেট শাখায় যাই। সেখানে জেনারেল ম্যানেজারের রুমে বসি। তিনি অন্য সময় আমার সঙ্গে সৌজন্যমূলক আলাপ করেন। সেদিন তাঁকে দেখি প্রচণ্ড বিচলিত অবস্থায়। জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঋণ দেওয়ার জন্য তাঁর ওপর চাপ আসছে। তিনি নিরুপায় হয়ে কোনো একটা উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।

এমন ঘটনা আরও শুনেছি বিভিন্ন ব্যাংকে। হল-মার্ক কেলেঙ্কারির সময় সোনালী ব্যাংকের ঋণ অনুমোদনে সরকারি দলের লোকজন ও সরকারের একজন সাবেক উপদেষ্টার ভূমিকার কথা পত্রিকার মাধ্যমে জানতাম। ফলে এসব কথা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না।

প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এভাবে ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর তা ফেরত দেন না, এটিও আমাদের জানা রয়েছে। এ দেশে এমন খেলাপি ঋণের পরিমাণ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, এটা সরকারি হিসাবে বলা হয়। আইএমএফের হিসাবে এটি আরও অনেক বেশি।

কিন্তু এসব ঋণ পেতে চাপটা কোন স্তর পর্যন্ত যেতে পারে, তা আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না সিকদার গ্রুপের দুই পরিচালকের অতিসাম্প্রতিক ঘটনাটি না জানলে। এ লোমহর্ষ ঘটনার পরতে পরতে রয়েছে অনিয়ম, অনৈতিকতা আর অপরাধবৃত্তির কালো ছাপ। প্রথমে সম্পত্তির ভুয়া মূল্য দেখিয়ে এক্সিম ব্যাংকের কাছে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দিতে চাপ দেন সিকদার গ্রুপের কর্তা রন হক সিকদার ও দিপু হক সিকদার। এতে রাজি না হওয়ার ব্যাংকের এমডি ও ডিএমডিকে পথ রোধ করে তাঁরা গুলি করেন। পরে অপহরণ করে নিজেদের বাসায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রেখে হত্যার হুমকি প্রদান ও নির্যাতন করেন। দেশের শীর্ষ স্তরের দুজন ব্যাংকারকে এভাবে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে ঋণ আদায়ের চেষ্টা কোনো মাফিয়ার ওপর সিনেমা নয়, বাস্তবে হতে পারে—এটা আমাদের কল্পনাতেও ছিল কি?

সিকদার গ্রুপ সরকারের বড় নেতাদের ঘনিষ্ঠ। সিকদার পরিবারের একজন সরকারি দলের একজন মনোনীত সাংসদ। সিকদার ভাইদের ঘটনা ক্ষমতাশালী লোকদের প্রকাশ্যে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ করার ঔদ্ধত্যকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছিল, উন্মোচিত করেছিল দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার চরম অরাজকতার কিছু কার্যকারণকেও। সিকদারদের এসব কাজে সরকারের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয় নেই, এটি প্রমাণ করার খাতিরে হলেও মামলার পর অবিলম্বে তাঁদের গ্রেপ্তার করা উচিত ছিল, উচিত ছিল অন্তত তাঁদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ঠেকানোর ব্যবস্থা নেওয়ার।

কিন্তু আমরা হতভম্ব হয়ে দেখলাম, এসব কিছু হয়নি। বরং মামলা দায়েরের ছয় দিনের মধ্যে তাঁরা এ করোনা পরিস্থিতিতেও নিজেদের বিমানে অনায়াসে উড়ে চলে গেলেন ব্যাংককে। সে-ও আবার সরকারের বিভিন্ন মহলের সহায়তায়!

আমরা এসব বিশ্বাস করতে লজ্জা অনুভব করি। কিন্তু চাঞ্চল্যকর একটি মামলার আসামিরা করোনা পরিস্থিতির মধ্যে রাজধানীর একমাত্র বিমানবন্দর দিয়ে নির্বিঘ্নে চলে গেছেন সরকারের কারও সহযোগিতা ছাড়া, এটা কীভাবে সম্ভব?

২৫ মে সিকদার ভ্রাতৃদ্বয়ের ব্যাংককে চলে যাওয়ার পেছনে বরং প্রত্যক্ষভাবে সরকারের কয়েকটি অফিস বা মন্ত্রণালয় জড়িত ছিল বলে মনে হয়। এক. তাঁদের থাইল্যান্ডের ভিসাপ্রাপ্তি ও সেখানে নিজস্ব বিমান অবতরণের অনুমতির জন্য চিঠি লেখে সেখানকার বাংলাদেশি দূতাবাস। বিডিনিউজের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি সরাসরি এটি অস্বীকার না করে বলেছেন, তাঁরা কিছু জানেন না। দুই. মামলা মাথায় নিয়ে ভুয়া রোগী সেজে চলে যাওয়ার অনুমোদনে যুক্ত ছিল বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। তবে তারা দাবি করেছে, সিকদারদের উড়োজাহাজকে অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে থাইল্যান্ডে যাওয়ার জন্য আবেদনটা করা হয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।

এ ছাড়া মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে গাফিলতি বা অনীহ ছিল তদন্তকারী পুলিশের। ব্যাংককে ‘পালিয়ে’ যাওয়ার ঘটনার আগে তারা প্রথম আলোকে বলেছে দুই ভাইকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলছে; পালিয়ে যাওয়ার পর বলেছে গ্রেপ্তারের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পায়নি তারা। বিমানবন্দরের পুলিশ জানিয়েছে, তারাও দেশ ছেড়ে যেতে সিকদারদের বাধা দেয়নি এমন কোনো নির্দেশ না থাকায়। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের এমনকি মামলা ছাড়া বিমানবন্দরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখে পুলিশ। হত্যাচেষ্টার চাঞ্চল্যকর মামলার আসামিদের বাধা দিতে এমন কোনো নির্দেশ কেন ছিল না পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের? নাকি সিকদারদের দেশ ত্যাগ করতে সহায়তার নির্দেশ ছিল আরও ওপরের কোনো মহল থেকে?

আমাদের মন্ত্রীরা প্রায়ই বলেন, অপরাধীর পরিচয় যা-ই হোক, কোনো ছাড় নেই বা অন্যায় অপরাধের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে বিশ্বাসী সরকার। অতীতে আমরা এসবের বহু ব্যত্যয় দেখেছি। হাতুড়ি দিয়ে পাশবিক হামলাকারীর বিরুদ্ধে মামলা হয়নি দেখেছি, খুনের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত কুখ্যাত বহু অপরাধীকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্ত করে দিতে দেখেছি। কিন্তু এত প্রকাশ্যে, এত উৎকটভাবে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে হত্যাচেষ্টার মামলার আসামির কাছে নতজানু হওয়ার ঘটনা আর দেখেছি কি?

আমরা বিশ্বাস করতে চাই, সরকারের সর্বোচ্চ মহলের জ্ঞাতসারে সিকদারদের পক্ষে এসব অন্যায় করা হয়নি। সে জন্য আমরা দেখতে চাই এসব কাজে যুক্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, পুলিশ ও ভুয়া রোগী সনদ প্রদানকারী চিকিৎসক—সবার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার।

করোনাকালে দেশের একজন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীও নিজস্ব বিমানে চড়ে দেশ থেকে চলে গেছেন, একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীও তা করেছেন। এসব ঘটনা অনভিপ্রেত হতে পারে। কিন্তু হত্যাচেষ্টার টাটকা মামলা মাথায় নিয়ে অন্য দেশ থেকে ভিসা আনিয়ে, ভুয়া রোগী সেজে বিমানবন্দর দিয়ে প্রকাশ্যে বিদেশে চলে যাওয়ার ঘটনায় রাষ্ট্রের প্রতি যে বিদ্রূপ রয়েছে, তা খুবই দুঃখজনক।

এ রাষ্ট্রের কর্ণধারদের এটি উপলব্ধি করা উচিত।