চীনকে নিয়ে ইউরোপের স্বপ্ন দেখা শেষ

ইউরোপ ও চীনের মধ্যকার সম্পর্কে গভীর মোড় পরিবর্তন নিতে দেখা যাচ্ছে। এর আগে অনেক দিন ধরেই চীনের কাছ থেকে পণ্য আনার ওপর ইউরোপ জোর দিচ্ছিল এবং এর পক্ষে কথা বলতে অর্থনীতিবিদেরা বৃহত্তর ‘সরবরাহ ব্যবস্থার বৈচিত্র্য’ জরুরি বলে মত দিচ্ছিলেন। কোভিড–১৯ এর মহামারির পর সেই ‘ডাইভারসিফিকেশন’ এখন ইউরোপে বিতর্কিত হয়ে উঠছে এবং চীনের সঙ্গে অত মাখামাখির সম্পর্ক না করার বিষয়ে মত জোরালো হয়ে উঠছে।

তবে পণ্য আমদানিতে চীনের ওপর নির্ভরতা কমানো এবং চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক দূরত্ব এখনই ঘটানো সম্ভব নয়, তবে চীনকে নিয়ে ইউরোপ যে অর্থনৈতিক স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল, এখন আর সেটি নেই। কিছুদিন আগেও ইউরোপিয়ানরা চেয়েছে চীনের সঙ্গে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) সম্পর্ক অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক—উভয় দিক থেকে বাড়ুক। এমনকি ইইউ যখন চীনের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছিল, তখনো ইউরোপিয়ান বিনিয়োগকারীরা চীনে বিনিয়োগের কথা ভাবছিলেন। কিন্তু এখন সেই অবস্থা পাল্টে গেছে।

চলতি মাসের শুরুতে ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের কর্মকর্তা অ্যান্ড্রু স্মল বলেছেন, ইউরোপিয়ানরা স্বনির্ভর হওয়ার জন্য যে নীতি গ্রহণ করছে, তার প্রথম শিকার হবে সাইনো-ইউরোপিয়ান সম্পর্ক।

 ইইউর হাই রিপ্রেজেনটেটিভ ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড সিকিউরিটি পলিসি জোসেফ বোরেল সম্প্রতি একটি বিবৃতিতে বলেছেন, তাঁদের সাপ্লাই চেইন সীমিত করে আনতে হবে। তিনি বলেছেন, তাঁদের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে এশিয়া থেকে ঘুরিয়ে পূর্ব ইউরোপ, বলকান ও আফ্রিকা অঞ্চলে নিতে হবে। প্রায় একই ধরনের সুর শোনা গেছে ইইউর এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্গারেতে ভেস্তাগেরের মুখে। তিনি বলেছেন, চীনের থাবা থেকে ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলোকে বাঁচানোর জন্য ইউরোপের দেশে দেশে আইন করতে হবে।

 অবশ্য চীনের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে এখনই সরে আসতে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশই রাজি নয়। বিশেষ করে চীনের তৈরি চিকিৎসাসামগ্রী ও সরঞ্জাম আমদানির বিষয়ে এ মুহূর্তে তাদের কারও দ্বিমত নেই।

 তিন কারণে চীনের বিষয়ে ইউরোপের হিসাব–নিকাশ বদলে গেছে। প্রথম কারণ হলো চীনের অভ্যন্তরীণ দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন। ইইউ আগে এই বিশ্বাসে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়েছিল যে দেশটি আন্তর্জাতিক স্তরে সম্পর্ক বাড়ালে ধীরে ধীরে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ও দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে। কিন্তু উল্টোটা ঘটেছে। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের অধীনে চীন আরও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে। চীন যত বেশি তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাড়িয়েছে, ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলোর বিষয়ে তারা তত বেশি কড়াকড়ি আরোপ করেছে।

প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সই করা তিনটি নীতি ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’, ‘চায়না স্ট্যান্ডার্ডস’ ও ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলোকে চীনের বাজার থেকে শুধু জোর করে বের করেই দেয়নি, এই চীনা মডেলের নীতি তারা ‘রপ্তানিও’ করেছে। চীনের পণ্যের দাম ইউরোপের পণ্যের দামের চেয়ে অনেক কম। ইউরোপে চীনের পণ্য ঢোকার পরে দেখা যাচ্ছে, শুধু দাম কমের কারণে ইউরোপের মানুষই ইউরোপের তৈরি পণ্য কিনছে না, কিনছে চীনের পণ্য। এটি তাদের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দ্বিতীয় কারণ হলো ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে আসার পর চীনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি আরও কঠোর হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি আসার আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ লেগে গিয়েছিল। দুই দেশের অর্থনীতির মধ্যে যে সংঘাত শুরু হয়, তার মাঝখানে পড়ে ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েন।

ইউরোপিয়ান ৫-জি নেটওয়ার্ক তৈরিতে চীনের টেক জায়ান্ট হুয়াওয়ের যে ভূমিকা রাখার কথা, তাতে বাদ সেধেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এটি করা হলে চীন গোটা ইউরোপের তথ্যপ্রযুক্তিগত নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। হুয়াওয়ে ইস্যুতে ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপেরও হুমকি দিয়েছে। এ কারণে ইউরোপের কোম্পানিগুলোকে চীনের সঙ্গে দূরত্ব রাখার কথা ভাবতে হচ্ছে।

তৃতীয় কারণ হলো করোনাকালে চীনের বিতর্কিত আচরণ। ২০০৮ সালে বৈশ্বিক মহামন্দার পর চীনের সামনে বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ এসেছিল। সে সময় চীন দায়িত্বশীল বৈশ্বিক শক্তির মতো আচরণও করেছিল। সমন্বিত প্রণোদনা কার্যক্রমে ভূমিকা রেখেছিল। এমনকি তারা বাজার চাঙা রাখার জন্য ইউরো কিনেছিল এবং ডুবে যাওয়া অনেক কোম্পানিতে তারা বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু এবার এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যে চীন সে রকম কোনো উদ্যোগই নেয়নি।

এ বছরের শুরুতে যখন চীনের উহান থেকে করোনাভাইরাস ছড়াল, তখন ইইউ সদস্যদেশগুলো জাহাজে করে ৬০ টন মেডিকেল সরঞ্জাম চীনে পাঠাল। এর বেশির ভাগ এসেছিল দেশগুলোর রাষ্ট্রীয় গুদামখানা থেকে এবং সেগুলো সরাসরি পাঠানো হয়েছিল। এ নিয়ে দেশগুলো কোনো প্রচার করেনি। কিন্তু ইউরোপে যখন করোনা দেখা দিল, তখন চীন মেডিকেল সরঞ্জাম পাঠিয়ে ব্যাপক প্রচার শুরু করল। ইউরোপ যে সরঞ্জাম পাঠিয়েছিল, তা ছিল সম্পূর্ণ বিনা মূল্যের। আর চীন এগুলো প্রাইস ট্যাগ লাগিয়ে রপ্তানি করে সেটিকে ‘সহায়তা’ বলে চালিয়েছে।

চীনের এই আচরণ ইউরোপের দেশগুলোকে ক্ষুব্ধ করেছে। করোনা পরিস্থিতি চীনের ওপর ইউরোপের নির্ভরতা ও ইউরোপ ইস্যুতে চীনের আসল উদ্দেশ্য সবার সামনে খুলে দিয়েছে। এ কারণে চীনকে ছাড়াই চলতে চাইছে ইউরোপ।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
মার্ক লিওনার্ড: ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের কর্মকর্তা