সংস্কারের পরিকল্পনা শুরুর সময় এখনই

সংস্কারসহ ভবিষ্যতের সব পরিবর্তিত ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য চীনের মতো একটি শক্তিশালী জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করতে হবে, যা সম্পূর্ণ নিজস্ব জনবল দ্বারা পরিচালিত হবে। এর প্রধান হবেন পূর্ণমন্ত্রী পদমর্যাদাসম্পন্ন। লিখেছেন সৈয়দ আব্দুল হামিদ
সংস্কারসহ ভবিষ্যতের সব পরিবর্তিত ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য চীনের মতো একটি শক্তিশালী জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করতে হবে, যা সম্পূর্ণ নিজস্ব জনবল দ্বারা পরিচালিত হবে। এর প্রধান হবেন পূর্ণমন্ত্রী পদমর্যাদাসম্পন্ন। লিখেছেন সৈয়দ আব্দুল হামিদ

করোনা মহামারি যা আমাদের রোগেও মারছে, ভাতেও মারছে, তা কোনোভাবে কাম্য না হলেও এখন সেটা বাস্তবতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই বাস্তবতার সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিন বসবাস করতে হতে পারে। তাই একদিকে যেমন সংক্রমণ প্রতিরোধসহ কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা জরুরি, অন্যদিকে তেমনি করোনার শিক্ষা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে এ ধরনের মহামারি মোকাবিলাসহ স্বাস্থ্য খাতের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা দূর করতে স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানোর পথে হাঁটা উচিত।

করোনা দেখিয়ে দিয়েছে, স্বাস্থ্য খাতের সমস্যাগুলোর গভীরতা কত গভীর। স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব বুঝতে সহায়তার পাশাপাশি করোনা আরও বুঝিয়েছে, স্বাস্থ্যের জন্য ব্যক্তি খাতের ওপর নির্ভরশীলতা কতটা বোকামি। আর স্বাস্থ্যের জন্য বিদেশনির্ভরতা তো দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব অন্য দেশের সেনাবাহিনীর ওপর তুলে দেওয়ার শামিল। সাধারণ অসুখ-বিসুখের জন্যও বিদেশ ভ্রমণ আমাদের অনেকেরই অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। তাই হয়তো নীতিনির্ধারকদের কাছে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার প্রয়োজন তেমন অনুভূত হয়নি। করোনা বুঝিয়েছে, অর্থবিত্ত থাকলেও চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া যায় না।

স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের ক্ষেত্রে একদিকে যেমন সমস্যার গভীরে হাত দিতে হবে, অন্যদিকে তেমনি সংস্কারের একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে পর্যায়ক্রমিক সংস্কারের মাধ্যমে একটা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। জোড়াতালি দিয়ে সাময়িকভাবে রাস্তা মেরামতের মতো পিস মিল ভিত্তিতে কোনোভাবেই স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার করা উচিত নয়।

স্বাস্থ্য একটি জটিল এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল খাত। আর এই খাতের ব্যবস্থাপনাও বেশ জটিল ও কঠিন। তাই এর ব্যবস্থাপনার জন্য দরকার অভিজ্ঞ এবং প্রশিক্ষিত জনবল। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের বিধান অনুযায়ী সব কর্মকর্তার একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে অন্য মন্ত্রণালয় বা দপ্তরে বদলি হতে হয়, তাই একদিকে যেমন কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ কম এবং যা অর্জিত হয়, সেটাও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দপ্তরে কাজে লাগানোর সুযোগ নেই। তাই মন্ত্রণালয় পর্যায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তাবৃন্দের স্বাস্থ্য খাত ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অভাব সর্বদাই পরিলক্ষিত হয়।

তা ছাড়া অভিজ্ঞ এবং প্রশিক্ষিত জনবলের ঘাটতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ এই খাতের অন্যান্য প্রশাসনিক ধাপেও বিরাজমান। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, সিভিল সার্জনসহ যাঁরা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন, তঁাদের নিজেদের দক্ষভাবে গড়ে তোলার সুযোগ ও প্রচেষ্টা উভয়ই কম। কারণ, তঁাদের প্রশাসনের নীতিনির্ধারণী ধাপে ওঠার সুযোগ সীমিত। ফলে এসব পদে নিয়োগ পেতে আগ্রহী প্রার্থীদের সংখ্যা যেমন কম, তেমনি প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তঁাদের দক্ষ ব্যবস্থাপক হয়ে ওঠার সুযোগও কম। তাই বাজেট চাওয়া, খরচ করাসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেকাংশেই তঁারা নিজ নিজ দপ্তরের অধীনস্থদের ওপর নির্ভর করেন।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ উচ্চতর পদগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরাসরি মেডিকেল কলেজের অধ্যাপকদের নিয়োগ দেওয়ার কারণে মাঠপর্যায়ে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যোগ্য প্রার্থীর এসব পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। তা ছাড়া মেডিকেল কলেজের যেসব অধ্যাপক এসব পদে অধিষ্ঠিত হন, আগের প্রশাসনিক এবং মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে তঁাদেরকেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হয়। তাই স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনা সর্বক্ষেত্রে অদক্ষ, অনভিজ্ঞ এবং অপেশাদার জনবল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেট প্রাপ্তি এবং তার গুণগত খরচসহ স্বাস্থ্য খাতে সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রথমে এর ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

এ জন্য সম্পূর্ণ একটা আলাদা ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, সুপারিনটেনডেন্ট, সিভিল সার্জনসহ যঁারা মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত, তঁাদেরকে অর্থায়ন, বাজেট ব্যবস্থাপনা, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাসহ প্রশাসনিক সব প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে দক্ষভাবে গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি তঁাদেরকে স্বাস্থ্য অর্থনীতি অথবা জনস্বাস্থ্য বিষয়ে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করা বাধ্যতামূলক করতে হবে, যা তঁাদের পদোন্নতির পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। তা ছাড়া উপজেলাসহ স্বাস্থ্য প্রশাসনের প্রতিটি ধাপে সঠিকভাবে বাজেট ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত পদ সৃষ্টি ও নিয়োগদানের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি, অর্থনীতি বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের এ পদে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরেরও প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এইভাবে পর্যায়ক্রমে গড়ে তোলা দক্ষ ব্যবস্থাপকদের আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সব পদে পদায়ন করতে হবে। তবে মেডিকেল কলেজের অধ্যাপকদের স্বাস্থ্য শিক্ষা নামে যে নতুন অধিদপ্তর হয়েছে, সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা যেতে পারে। আর মেডিকেল শিক্ষার পাঠ্যক্রমে প্রবলেম বেইসড লার্নিং পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করে এর গুণগত মান বৃদ্ধির ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে। তা ছাড়া এমবিবিএস পর্যায়ে কমিউনিটি মেডিসিন কোর্সের মধ্যে স্বাস্থ্য অর্থনীতির মৌলিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি নামে নতুন একটি কোর্সও চালু করা যেতে পারে। স্টেট মেডিকেল ফ্যাকাল্টিকে আইনগত ভিত্তি প্রদানের মাধ্যমে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট শিক্ষার ক্ষেত্রে বিরাজমান বিশৃঙ্খলা দূর করতে হবে।

তা ছাড়া সংক্রমণ রোগ নিয়ন্ত্রণসহ প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার ওপর জোর দিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। এ জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পর্যন্ত সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অর্গানোগ্রাম যুগোপযোগী করে নিয়োগদানের ব্যবস্থা করতে হবে। শহরের ক্ষেত্রে প্রতি ২৫ থেকে ৩০ হাজার জনগণের জন্য প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবাসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার শক্তিশালী অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি জেলা হাসপাতালসহ সব সেকেন্ডারি এবং বিশেষায়িত হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা অনুযায়ী যুগোপযোগী অর্গানোগ্রাম তৈরি করে নিয়োগদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো শক্তিশালী করে কার্যকর রেফারেল পদ্ধতি চালুর পদক্ষেপ নিতে হবে।

সেবা প্রদানকারীর পেমেন্ট পদ্ধতিতেও সংস্কার আনতে হবে। বর্তমান ইনপুট এবং লাইন আইটেমভিত্তিক পেমেন্ট কাঠামোর সঙ্গে আউটপুটভিত্তিক প্রণোদনা যোগ করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন হলে মেডিকেল ক্যাডারকে জুডিশিয়াল ক্যাডারের মতো বিসিএসের বাইরে আনার চিন্তা করতে হবে। বেসরকারি খাতকে নিজস্ব জনবলসহ অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে শক্তিশালীকরণের ওপর জোর দিতে হবে। এ জন্য ১৯৮২ সালের মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্সকে যুগোপযোগী করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় সব মানুষের জন্য সামাজিক স্বাস্থ্য বিমা চালুর সুযোগ নেই। তাই আপাতত সরকারি অর্থায়নের ওপর জোর দিতে হবে। এ জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ছাড়া অন্যান্য দ্রব্যের ওপর অতিরিক্ত ১-২ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করে অতিরিক্ত অর্থায়নের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

এসব সংস্কারসহ ভবিষ্যতের সব পরিবর্তিত ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য চীনের মতো একটি শক্তিশালী জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করতে হবে, যা সম্পূর্ণ নিজস্ব জনবল দ্বারা পরিচালিত হবে। এর প্রধান হবেন পূর্ণমন্ত্রী পদমর্যাদাসম্পন্ন।

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক
[email protected]