করোনার টিকা বের হবে, কিন্তু বর্ণবাদের কী হবে

পুলিশের নৃশংসতা ও কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ চলাকালে অস্ত্রের মুখে একটি গাড়ির যাত্রীদের নামিয়ে আনা হয়। মিনেপোলিস, মিনেসোটা অঙ্গরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ৩১ মে। ছবি: এএফপি
পুলিশের নৃশংসতা ও কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ চলাকালে অস্ত্রের মুখে একটি গাড়ির যাত্রীদের নামিয়ে আনা হয়। মিনেপোলিস, মিনেসোটা অঙ্গরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ৩১ মে। ছবি: এএফপি

২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উন্নয়নশীল বিশ্বকে ‘নোংরা দেশ’ বলে উল্লেখ করার পর সে সময় আমি একটা লেখায় বলেছিলাম, এই প্রেসিডেন্টের হাত থেকে আমাদের, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত কৃষ্ণাঙ্গদের রক্ষা করার মতো কেউ নেই। আজ এই মহামারির মধ্যে সে কথা যে কতখানি সত্য, তা সবাই স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। বেকারত্বের হারে উল্লম্ফন হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কাজ করছেন না। আমেরিকানদের জীবন বাঁচানোর জন্য কেউ কোনো উদ্ভাবনী পদক্ষেপের কথা বললে তা নিয়ে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ঠাট্টা–তামাশা করছেন। ইতিমধ্যে কোভিড–১৯ মহামারিতে এক লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন। আমাদের অনেকেই দুই মাসের বেশি সময় হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন। কিন্তু এমন বহু মানুষ আছেন, যঁারা আর পারছেন না।

সরকার সবার অ্যাকাউন্টে ১২০০ ডলার পৌঁছে দেওয়ার কথা বললেও এখনো সেই অর্থ পাওয়া যায়নি। ফলে এক মানবেতর জীবন ভোগ করছেন আমেরিকার সাধারণ মানুষ। লকডাউন তুলে নেওয়ার জন্য রাজধানীজুড়ে বিক্ষোভ হচ্ছে। বড় বড় চেইনশপ সবাইকে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়ে পণ্য বাসায় তারা পৌঁছে দেবে বলে বিজ্ঞাপন প্রচার করছে, অথচ নিজেদের স্টাফদের বেতন এখনো বুঝিয়ে দেয়নি।

এই মহাসংকটের মধ্যে বর্ণবাদ নিয়ে আবার যুক্তরাষ্ট্র ফুঁসে উঠেছে। করোনায় সবচেয়ে যাঁরা আক্রান্ত এবং প্রাণহানির শিকার হয়েছেন, তঁারা হলেন কৃষ্ণাঙ্গরা। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুঝুঁকি কমাতে সরকারের দিক থেকে বিশেষ কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। করোনা ইস্যুতে সরকারের তরফ থেকে লাগাতার বর্ণবাদী নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে বলে কৃষ্ণাঙ্গরা যখন ফুঁসছে, ঠিক তখন শ্বেতাঙ্গ এক পুলিশ কর্মকর্তার হাতে নির্মমভাবে মিনেপোলিসে নিহত হলেন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড। এই নিয়ে এখন আমেরিকা উত্তাল হয়ে উঠেছে।

কেনটাকি অঙ্গরাজ্যের লুইসভিলে শহরে এর আগে ব্রেনা টেইলর নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ নারী পুলিশের হাতে খুন হয়েছিলেন। ব্রেনা যে ভবনে থাকতেন, সেখানে তল্লাশি চালিয়ে এক অপরাধীকে ধরতে এসেছিল পুলিশ। তারা ব্রেনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় তিনি তাঁদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়েছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। এ ঘটনার পর বিক্ষোভ হলে বিক্ষোভকারীদের সাতজনকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছিল। এর আগে সাউথ জর্জিয়ায় জগিং করার সময় আহমুদ আরবেরি নামের আরেক কৃষ্ণাঙ্গকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন দুই শ্বেতাঙ্গ অফিসার। তৃতীয় আরেক ব্যক্তি হত্যার সেই দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করেছিলেন। সেই ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে না পড়া পর্যন্ত আরবেরি হত্যায় কোনো মামলাই হয়নি। মিনেপোলিসের ঘটনায় ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, হাতকড়া পরা অবস্থায় জর্জ ফ্লয়েডকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা উপুড় করে ধরে তাঁর কাঁধ হাঁটু দিয়ে চেপে ধরেছেন এবং ফ্লয়েড বলছেন, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না।’ এতে ওই পুলিশের কোনো ভাবান্তর হয়নি। তাঁর সঙ্গে থাকা তিন শ্বেতাঙ্গ সহকর্মীরও কোনো ভাবাবেগ দেখা যায়নি।

মিনেপোলিসের ঘটনায় কয়েক দিন ধরে বিক্ষোভ হচ্ছে এবং সেই বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের যে অমানবিক আচরণ দেখা যাচ্ছে, তারও আদেশ দিয়ে রেখেছেন ট্রাম্প। এর আগে ২০১৭ সালে একটি বিক্ষোভ সামাল দেওয়ার বিষয়ে ট্রাম্প পুলিশকে বলেছিলেন, ‘দয়া করে তাদের সঙ্গে খুব বেশি মোলায়েম আচরণ করবেন না।’ তিনি নিজে টুইটারে লিখেছিলেন, ‘হোয়েন দ্য লুটিং স্টার্টস, দ্য শুটিং স্টার্টস’ (লুটতরাজ শুরু হলে গুলিও শুরু হবে)। গত ১২ বছরে কয়েকটি নাম আমরা বেদনার সঙ্গে উচ্চারণ করেছি। মাইক ব্রাউন, ট্রাইভন মার্টিন, সান্ড্রা ব্লান্ড, ফিল্যান্ডো ক্যাস্টিল, তামির রাইস, জর্ডান ডেভিস, আতাতিয়ানা জেফারসন, চার্লসটন নাইন—এ রকমের নাম আমরা হ্যাশটাগ আকারে পেয়েছি। এরা সবাই বর্ণবাদের শিকার হয়ে মারা গেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বিক্ষোভ হওয়ায় নামগুলো আমাদের মনে আছে। কিন্তু প্রতিদিন যেসব অন্যায় ও নির্যাতন হয়, সেগুলো চাপা পড়ে থাকে।

আমেরিকান সমাজে শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে অদ্ভুত এক মনস্তত্ত্ব কাজ করে। যখন কোনো কৃষ্ণাঙ্গ শুধু বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়ে আহত বা নিহত হন, তখন শ্বেতাঙ্গরা ওই ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করেন। যখন কৃষ্ণাঙ্গটির কোনো দোষত্রুটি ধরা পড়ে, তখন তাঁরা বলতে থাকেন, কৃষ্ণাঙ্গ লোকটি এমন আচরণ করেছে বলেই এই পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গরা অন্যায় করলে তাঁদের আদালতে জুরির সামনে নিয়ে বিচার করার খুব একটা দরকার নেই। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে তাঁর পাওনা বুঝিয়ে দেওয়াই দুরস্ত।

২০১৮ সালে আমি লিখেছিলাম, ট্রাম্পের শাসনাধীনে আমরা কৃষ্ণাঙ্গরা নিরাপদ থাকব না। এখন সেটিই প্রমাণিত হচ্ছে। এখন আমাদের উপলব্ধি হচ্ছে, করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আজ না হয় কাল আবিষ্কৃত হবে, কিন্তু আমেরিকার মতো মহান দেশে বর্ণবাদের যে বিষাক্ত ভাইরাস ছড়িয়ে আছে, তার টিকা কি আবিষ্কার করা যাবে? শুধু হ্যাশট্যাগের বর্ণবাদবিরোধিতা কি আমেরিকাকে রক্ষা করতে পারবে?

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
রেক্সোনা গে: নিউইয়র্ক টাইমসের নিয়মিত কলাম লেখক