শিক্ষার মানে আপস না করেই চালাতে হবে

সারা দুনিয়ায় অর্থনীতির চাকা বন্ধ। কিন্তু তার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে জনস্বাস্থ্য। জীবন ও জীবিকাকে কৌশলে মুখোমুখি অবস্থানে ফেলা হয়েছে। আর তাতে অর্থশাস্ত্রী আর চিকিৎসাশাস্ত্রীরা ভাগ হয়ে গেছেন দুই মেরুতে। যে তরজায় শিক্ষা ইস্যু বেশ পেছনে চলে গেছে। কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব শুরু হলেই প্রথম কোপ পড়ে শিক্ষার ওপর। শিশু আর বৃদ্ধরা যেহেতু সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়ে, তাই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে দেশে দেশে সবার আগে বন্ধ করা হয়েছে শিক্ষালয়গুলো। সেটি একান্ত জরুরি ছিল। কিন্তু ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার গতি কবে কমবে তার হদিস পাচ্ছেন না বিজ্ঞানীরা। প্রথম দিকে কিছু আশাবাদ শোনানো হলেও বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন কোভিড-১৯ শুধু যে বহুকাল আমাদের চোখ রাঙাবে তা–ই নয়, হতে পারে সর্দি-কাশির মতো কোভিড-১৯–এর সঙ্গেই মানুষকে বসবাস করতে হবে। তবে তারা আশাবাদী যে কোভিড-১৯-এর গলায় তারার শিকল পরাতে পারবেন এবং এখন যেভাবে তা চোখ রাঙাচ্ছে আর গিলে খাচ্ছে লাখ লাখ মানুষের জীবন তার লাগাম টানা হয়তো সম্ভব হবে।

কিন্তু সে জন্য কতকাল অপেক্ষা করতে হবে কেউ ঠিক জানেন না। এ রকম অনিশ্চয়তার মধ্যে মানুষ নামক চিন্তাশীল ও বুদ্ধিমান প্রাণীর আশরাফুল মাখলুকাত হয়ে ওঠার গোপন রহস্য যে শিক্ষা, সেটাই এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। সোজা কথায় মানবসভ্যতার আসল বুনিয়াদ যে শিক্ষা, সেটিই এখন সবচেয়ে বেশি অচল, নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। ইতিহাসে দুনিয়াজুড়ে শিক্ষাব্যবস্থা এমন সংকটে আগে কখনো পড়েনি। অবশ্য আঞ্চলিক বা স্থানিকভাবে শিক্ষা এমন অসংখ্য সংকটের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যায়। যুদ্ধবিগ্রহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, দুর্ভিক্ষে শিক্ষা এ রকম সংকটের শিকার হয় হামেশাই। মহাযুদ্ধের সময়ে দু–দুবার চার-পাঁচ বছর করে শিক্ষাব্যবস্থা কোথাও না কোথাও অচল হয়ে পড়েছেই। বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে ঢের বেশিকাল ধরে চলেছে ভিয়েতনামের ওপর আমেরিকার আগ্রাসন। শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ায় যুদ্ধ চলছে দশকের পর দশক ধরে। প্যালেস্টাইনে ১৯৪৮ সাল থেকেই যুদ্ধ জারি আছে। নয় মাস চলেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ। এসব সময়ে শিক্ষা ক্ষতির শিকার হয়েছে, অবকাঠামো ব্যাপক ধ্বংসের শিকার হয়েছে, নিশ্চল হয়ে পড়েছে শিক্ষা পরিকাঠামো।

এবারের সংকট ভিন্নমাত্রিক। ভাইরাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চলছে, তাতে শিক্ষা পরিকাঠামো নিশ্চল হয়ে পড়েছে বটে, কিন্তু অবকাঠামো ধ্বংস হয়নি। যদিও অবকাঠামো রক্ষাণাবেক্ষণ ও নতুন নির্মাণ থমকে গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে শিক্ষার মূল কাজ—পঠন-পাঠন পড়েছে মহাসংকটে। প্রযুক্তির সহায়তায় বিশ্বের অনেক দেশ অবশ্য এই সংকট মোকাবিলা করছে এবং ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু আধুনিক যুগে শিক্ষা যত না বইনির্ভর, তার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তব পরীক্ষা–নিরীক্ষা, বহিরাঙ্গন কর্মসূচি ও ল্যাব–নির্ভর। স্বীকার করতেই হবে, করোনাভাইরাস সে ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে।

বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা যে সংকটে পড়েছে, তা দুনিয়ার অন্য দেশের তুলনায় একেবারেই ভিন্ন। সে ভিন্নতা ধরনে ও মাত্রায়। বাংলাদেশে শিক্ষার মূল সমস্যা শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য নির্ণয়ে বিপুল ব্যর্থতা। এ দেশের শিক্ষাক্রম (কারিকুলাম) অস্পষ্ট ও লক্ষহীন। তাই শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য অর্জনে পাঠক্রম (সিলেবাস) বিন্যাসেও ত্রুটির কূলকিনার নেই।

বর্তমান সংকট মোকাবিলায় অন্যান্য দেশ যেসব সুবিধা ব্যবহারের সুযোগ নিচ্ছে, দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা তা করতে পারছি না। করোনাকালে শিক্ষা সচল রাখতে অনেক দেশই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। দূরশিক্ষণের নানা উপায় এখন মানুষের হাতের নাগালে। এর বেশির ভাগই অনলাইনভিত্তিক। কিন্তু বাংলাদেশে আধুনিক প্রযুক্তি যতখানি বাণিজ্যবান্ধব, ততখানি জনবান্ধব নয়। শিক্ষায় দূরশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনায় বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় যে আশার আলো জ্বেলেছিল, প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্যের বিদায়ের পর তার উন্নয়ন তো দূরের কথা, সেটি এখন ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। অথচ সারা পৃথিবীতে দূরশিক্ষণ ক্রমেই আরও বিস্তৃত হচ্ছে। ১৯৯০ দশকে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সে ধারা অব্যাহত রাখা হলে আজকের দুর্যোগ মোকাবিলায় তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পারত। কিন্তু সে পথ আমাদের অদূরদর্শী রাজনীতির কোপানলে সে সুযোগ ধ্বংস হয়েছে।

গত এক দশকে শিক্ষাক্ষেত্রে এমন বহু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে নিঃসম্বল করে ফেলেছে। এর মধ্যে প্রধান হলো শিক্ষার অবাধ বাণিজ্যিকীকরণ। সেটা সর্বপ্লাবী হয়েছে; বেঞ্জামিন ব্লুমের টেক্সোনমির অপব্যাখ্যা করে তথাকথিত সৃজনশীল শিক্ষার নামে শিক্ষাকে কোচিং সেন্টারের একচেটিয়া বাণিজ্যের কাছে বন্ধক দিয়ে। ফলে দেশে শিক্ষালয়গুলো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। শিক্ষক সম্প্রদায় পেশাজীবী হিসেবে সামাজিক মর্যাদা হারিয়েছেন। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে শিক্ষকের দক্ষতা কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। ফলে শিক্ষার মানের ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে।

গত এক দশকে শিক্ষা হয়ে উঠেছে পরীক্ষানির্ভর। দুটো একেবারেই অনাবশ্যক ও শিশুনির্যাতনমূলক পরীক্ষা (প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি) চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে শিশু, অভিভাবক ও শিক্ষকদের কাঁধে। এই অতিরিক্ত বোঝা থেকে জাতির মুক্তি চেয়ে নাগরিকদের সব আবেদন–নিবেদন মামলা–মোকদ্দমা কোনো কাজে আসেনি।

পাঠক, মনে হতে পারে, আমি ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি। পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটাঘাঁটি করছি। জি, ঠিক তা–ই। এসব কাসুন্দি না ঘেঁটে করোনাকালে শিক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অসম্ভব। তাই, আমি মনে করি, শিক্ষা সম্পর্কে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করার এখনই সময়।

প্রথমত, সরকারের পক্ষ থেকে মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে প্রাথমিক ও জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা তুলে দেবার স্পষ্ট ঘোষণা করা উচিত।

২. শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার স্বার্থে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষ জনশক্তি, প্রযুক্তি ও অন্যান্য সুবিধা কাজে লাগানো এবং তার দ্রুত আধুনিকায়ন ও উন্নতির পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। এ জন্য বর্তমান প্রশাসনের শীর্ষপদে যোগ্যতম লোক নিয়োগ এখন সময়ের দাবি।

৩. শিক্ষক বাতায়নকে আরও কার্যকর করা। এবং ডিজিটাল কন্টেন্টগুলোর ব্যাপক উন্নতি সাধন করা। আমরা লক্ষ্য করেছি, শিক্ষক বাতায়নে অনেক কন্টেন্ট ভয়াবহ রকম যান্ত্রিক ও প্রাণহীন।

৪. সংসদ টেলিভিশনের সম্প্রচার ক্যাবলভিত্তিক না রেখে তা বিটিভির সঙ্গে টেরিস্টেরিয়াল প্রযুক্তিতে সম্প্রচার করার জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া।

৫. শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এটুআই যৌথভাবে শিক্ষা–অ্যাপ উদ্ভাবন ও তার মাধ্যমে পাঠদানের ব্যবস্থা করা।

৬. দেশের সব শিক্ষার্থীর ডেটাবেইস তৈরি করে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে মোবাইল নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে আসা এবং তাদের জন্য নামমাত্র মূল্যে বিশেষ ডেটা প্যাকেজ ঘোষণা করা। এ বিষয়ে মোবাইল অপারেটরগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার এখনই সুযোগ।

৭. সর্বোপরি, স্থগিত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণ এবং ২০২১ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষা সম্পর্কে সরকারে চিন্তাভাবনা প্রকাশ করা।

এ বিষয়ে একটি কথা বলা প্রয়োজনীয় বোধ করছি। ১৯৭২ সালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে শিক্ষা বিষয়টি দেখভাল করতেন সদ্য প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই সে সময়ের শিক্ষামন্তী অধ্যাপক ইউসুফ আলী সংক্ষিপ্ত সিলাবাসের নামে ৫০ ভাগ নম্বরে পরীক্ষার নেওয়ার ঘোষণা করেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয় গণটোকাটুকি। এ ঘটনাকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর স্মৃতিকথায় একটা মস্ত ভুল সিদ্ধান্ত বলে বর্ণনা করেছেন। তাই বিপর্যস্ত শিক্ষা মূল্যায়নে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা ও গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে আমরা খোঁজখবর নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। শিক্ষার মান নিয়ে আপস করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এবার যেন সেই ভুল না করি।

আমিরুল আলম খান: লেখক, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।
amirulkhan5252@gmail