উপকূলের প্রতিটি বাড়িই ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচাবে

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বে রোল মডেল। আগাম সতর্কবার্তাব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবীদের সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলে এটা সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে মানুষ আগের চেয়ে সচেতন হয়েছেন।

১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলের ৫ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি ১ লাখ ৩৮ হাজার। সেই অবস্থা থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ অভাবনীয় উন্নতি করেছে, যার প্রমাণ ২০০৭ সালে সিডরের মতো সুপার সাইক্লোনেও মানুষের মৃত্যু আটকে রাখা গেছে ১০ হাজারের নিচে। এর পরের ঘূর্ণিঝড়গুলোতে যা একেবারেই কমে এসেছে।

কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আম্পান ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে আঘাত হেনেছে বাংলাদেশে। এই ঝড়ে ৩ লাখ ৩০ হাজার ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৫৫ হাজার ঘর-বাড়ি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত। ২০০ ব্রিজ-কালভার্টসহ ১৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙেছে। নোনা পানি ঢুকে গেছে শত শত গ্রামে। সহায়–সম্বল হারিয়ে বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছে লক্ষাধিক মানুষ। নষ্ট হয়েছে দেড় লাখ হেক্টর জমির ফসল। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে মাছ ও আমচাষিদের। সব মিলিয়ে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ১ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; প্রাণ গেছে অন্তত ২২ জনের। প্রাথমিক হিসাবে এই ঝড়ের আথির্ক ক্ষতি ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয় থাকলেও ঝড়ের আঘাত থেকে বাঁচতে উপকূলের সাড়ে ১৪ হাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে ২৪ লাখ মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র আছে। এর সঙ্গে প্রয়োজন হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি ভবন আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী দিনে বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সংখ্যা ও তীব্রতা বাড়বে। তার সঙ্গে যুক্ত হবে নতুন নতুন সমস্যা, যা মানুষ আগে দেখেনি। আবার ঘূর্ণিঝড়ে মানুষের মৃত্যু কমানো গেলেও সম্পদের ক্ষতি কমানো যায়নি।

পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে মানুষের সক্ষমতা বাড়াতে দরকার নতুন চিন্তুা ও প্রযুক্তি। জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা উপকূলের সাড়ে তিন কোটি মানুষকে দুর্যোগ সহনশীল করে গড়ে তুলতে সরকারি-বেসরকারি অনেক উদ্যোগের পাশাপাশি কাজ করছে ব্র্যাকও। কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা ও মানুষের চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে ব্র্যাক একটি নতুন ও সাশ্রয়ী সমাধান বের করেছে। তা হচ্ছে জলবায়ু সহিষ্ণু বাড়ি।

গত বছর থেকে জলবায়ু সহিষ্ণু বাড়ি বা মিনি সাইক্লোন শেল্টার নিয়ে কাজ করছে ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি। প্রাথমিকভাবে পাইলট প্রকল্পের অধীনে উপকূলের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার ১০টি পরিবারের জন্য ১০টি বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। দোতলা এসব ভবন ২৫০ কিলোমিটার গতিবেগের ঝড়ে টিকে থাকতে পারবে। ঘরের উচ্চতা ঠিক করা হয়েছে গত ১০০ বছরের জলোচ্ছ্বাসের হিসাব মাথায় রেখে, যাতে তা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। দোতলায় মানুষ এবং নিচতলায় হবে গবাদিপশুর আশ্রয়।

৬৫২ বর্গফুটের এই বাড়িতে আশ্রয় নিতে পারবে আশপাশের কয়েক বাড়ির ৩৫ থেকে ৪০ জন। যাদের সবাই চেনাজানা। অন্যদিকে আশ্রয়ের জন্য বেশি দূরেও যেতে হবে না। কমে আসবে ক্ষয়ক্ষতি। এসব বাড়িতে আছে সৌরবিদ্যুৎ, বৃষ্টির পানি ধরে রাখা ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থাও।

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আগে ও পরে আমরা এসব বাড়ির উপযোগিতা নিয়ে জরিপ করেছি। জরিপে দেখা গেছে, ঝড়ের সময় সবাই নিজ বাড়িতে ছিলেন এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের আশ্রয় দিয়েছেন। অর্থাৎ মিনি সাইক্লোন শেল্টার হিসেবে কাজ করেছে এসব বাড়ি। কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সবাই সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেছিল। তা ছাড়া সাবাই চেনাজানা হওয়ায় করোনা সংক্রমণের ভয় ছিল কম। সুরক্ষা পেয়েছে গবাদিপশুও।

এমন একটি বাড়ি বানাতে খরচ হচ্ছে কমবেশি সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা, যা অতিদরিদ্রদের অনুদান বা ভর্তুকি দিয়ে করে দিতে পারলে দীর্ঘ মেয়াদে তা দুর্যোগ মোকাবিলায় মাইলফলক হবে।

বাংলাদেশে প্রতিবছর অন্তত একটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। লাখ লাখ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর্থিক হিসেবে যে ক্ষতি হাজার হাজার কোটি টাকা। জলবায়ু পরিবর্তন এই ক্ষতি বাড়িয়ে দেবে আরও বহুগুণ। সেই কঠিন সময় মোকাবিলার জন্য উপকূলের বাড়িগুলো মিনি সাইক্লোন শেল্টার হিসেবে গড়ে তোলা জরুরি হয়ে উঠেছে।

লেখক: আবু সাদাত মনিরুজ্জামান খান: কর্মসূচি প্রধান, জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি, ব্র্যাক
জিএম মোস্তাফিজুল আলম: ডেপুটি ম্যানেজার, জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি, ব্র্যাক।