নজরদারিতে ব্যর্থ হলে বিপদ অনিবার্য

বিশ্বের বহু দেশ লকডাউন শিথিল বা প্রত্যাহার করেছে। বাংলাদেশও করেছে। খালি চোখে এই দৃশ্যপটে মিল আছে, কিন্তু কোন দেশ কতটা কী বাস্তবায়ন করেছে, তার সঙ্গে তুলনা করলে অনেক কিছুতেই মিল নেই। লকডাউন চলাকালীন যে শর্তগুলো অনুসরণ বাধ্যতামূলক ছিল, সেখানে আমরা উদ্বেগজনক শৈথিল্য দেখেছি। সাধারণ ছুটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরুতেই যে একটা ছুটির আমেজ আনা হলো, তা থেকে বাংলাদেশ যেন আর বেরোতেই পারল না।

টেস্ট যে পরিমাণ প্রতিদিন হওয়া উচিত, তা তো হচ্ছেই না; উপরন্তু লকডাউন তুলে নেওয়ার প্রথম দিনেই সর্বোচ্চ রোগী আক্রান্ত এবং ২৪ ঘণ্টায় সব থেকে বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেল। এখন সব থেকে বড় ভয় গণপরিবহন ব্যবহার। সাধারণত কোনো গণপরিবহন, যা নির্দিষ্ট যাত্রী নিয়ে চলার কথা, সেগুলো কখনো সেভাবে চলে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নাকের ডগায় সব ধরনের ট্রাফিক আইন লঙ্ঘিত হয়। আইন বা শৃঙ্খলা মেনে না চলার কারণে কে বা কারা বেশি দায়ী, সেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা যেমন, তেমনি গণপরিবহনের মালিক-চালক-কর্মীরা কিছু ব্যতিক্রম বাদে সবাই কমবেশি বেপরোয়া। আর যাত্রীরাও কোনো অংশে কম যান না। সবকিছুতে তাড়াহুড়ো ও ম্যানেজ করে চলাই গণপরিবহনের যাত্রীদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অবশ্যই চূড়ান্ত বিবেচনায় এটি রাষ্ট্রীয় অক্ষমতা। কারণ, প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সড়ক ও যানবাহন—দুটোর কোনোটিরই সুব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। তাই আজ যখন জীবন না জীবিকা—এমন প্রশ্ন দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে, তখন সংশ্লিষ্ট সবাই পুরোপুরি ভিন্ন আচরণ করবে, সেটা আশা করা কঠিন।

সবকিছু যেহেতু খুলে দেওয়া হয়েছে, তাই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন হচ্ছে, সেটা কে নিশ্চিত করবে? আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে সুখকর নয়। আমরা দেখছি, সচিবালয়েও পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি। সেখানে অন্য সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিপণিকেন্দ্রগুলোর অবস্থা কী হবে? করোনা সংক্রমণ যখন বাড়ছে এবং মৃত্যুর সংখ্যাও যখন বাড়ছে, এমন পরিস্থিতিতে সবকিছু খুলে দেওয়া তাই সবার মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে।

এখন লাফিয়ে লাফিয়ে সংক্রমণের বিস্তারের ঝুঁকি রোধ বা হ্রাসের উপায় হলো লকডাউন প্রত্যাহারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শর্তগুলো যাতে বাস্তবায়িত হয়, সেটা নিশ্চিত করা। এ জন্য বিভিন্ন বাহিনী, সংস্থা ও কর্তৃপক্ষের নিবিড় নজরদারি লাগবে। এটা করতে হবে যেকোনো মূল্যে। লকডাউনে আমরা দুঃখের সঙ্গে দেখেছি যে দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন এবং সংক্রামক ব্যাধি আইনের কার্যকর প্রয়োগের প্রশ্ন অগ্রাহ্য করা হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রমাণিত যে এই উপেক্ষাই ভয়ানক ফল বয়ে এনেছে। এবং পরিস্থিতি এখনো যতটুকু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে, তা আরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে বিশ্বের অন্য অনেক দেশ যারা সংক্রামক ব্যাধি মোকাবিলার বিজ্ঞানসম্মত ও বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত নিয়মরীতি যেমনটা মেনেছে, সেটা আমরা পারিনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ অনেক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যার যা কাজ সেটা তারা করেনি। সেটা যাতে তারা করে, সে জন্য গত তিন মাসের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে।

জাতীয় কারিগরি কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী অবিলম্বে প্রতিদিন ৩০ হাজার টেস্ট চালু নিশ্চিত করতেই হবে। এই টেস্ট যাতে ক্ষতিগ্রস্ত বা হটস্পটে বেশি করে হয়, সে জন্যও বিশেষ নজরদারি লাগবে। টেস্ট, হটস্পট ও গণপরিবহন সামলানো, হাসপাতালে সুচিকিৎসা এবং হাত ধোয়া, মাস্ক পরা ও শারীরিক দূরত্বের শর্ত মানা হচ্ছে কি না, এই বিষয়গুলোতে সর্বোচ্চ মনোযোগ প্রত্যাশিত।