ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পুনরায় লকডাউন দরকার

এম এ ফয়েজ।
এম এ ফয়েজ।
>

এম এ ফয়েজ মেডিসিনের অধ্যাপক। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক। বর্তমানে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারিভাবে চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। লকডাউন তুলে নেওয়া পরবর্তী পরিস্থিতি মূল্যায়নে তিনি প্রথম আলোর মুখোমুখি হন।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: লকডাউন তুলে দেওয়ায় ঝুঁকি আরও বাড়ল কি না?

এম এ ফয়েজ: আমরা সবাই জানি, এ রোগ মারাত্মক ছোঁয়াচে। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে ওষুধ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধব্যবস্থা (এনএফআই, অর্থাৎ নন-ফারমোকোলজিক্যাল ইন্টারভেনশনস) এবং সংক্রমণ না ছড়ানোর উপায়গুলো বেশ পুরোনো ও স্বীকৃত। এসব বিজ্ঞানসম্মত কর্মকৌশল যথাযথ প্রয়োগ করা গেলে ৮ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত দৈনিক ক্রম ঊর্ধ্বমুখী রোগী মোট ৪৭ হাজার ১৫৩ জনে উন্নীত হতো না। এখন দেশের ৩৩ জেলায় প্রতিটিতে শতাধিক রোগী আছে এবং কিছু জেলায় ঘনীভূত রোগী আছে। এই শিথিল অবস্থায় অসংক্রমিত ও সংক্রমিত জনগোষ্ঠীর যোগাযোগ ও মিশ্রণের ফলে রোগীর সংখ্যা আরও দ্রুত বাড়তে পারে।

প্রথম আলো: কেউ বলেন, পরিস্থিতি দ্বিতীয় লকডাউনও ডেকে আনতে পারে। কেউ বলেন, হটস্পটভিত্তিক আংশিক লকডাউন কার্যকর করা হতে পারে। আপনি কী মনে করেন?

এম এ ফয়েজ: বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যা তথ্য আছে, তা যথেষ্ট নয়। তবে যা আছে, তার ভিত্তিতেই বিশ্লেষণপূর্বক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেমন দেশের সব জেলায় এক রকম ঘনীভূত রোগী নেই। কিংবা দৈনিক রোগী বৃদ্ধির হারও এক রকম নয়। তথ্য বিশ্লেষণে যদি দেখা যায়, ‘আর নট’ (একজন আক্রান্ত কতজনকে ছড়ায়, তার স্বীকৃত সূত্র) যেসব জায়গায় একাধিক, সেসব স্থানে শারীরিক দূরত্ব বজায়ে দৃঢ় পদক্ষেপ লাগবে। সেখানে এমনকি ‘লকডাউন’ পুনরায় প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এর উদ্দেশ্য হবে সংশ্লিষ্ট এলাকাটিকে ‘আর নট ১’-এর নিচে আনা। এটা করতে না পারলে ব্যাপক সংক্রমণ ঠেকানো যাবে না।

প্রথম আলো: কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ আমাদের বলেছেন, তাঁরা প্রতিদিন ৩০ হাজার পর্যন্ত টেস্ট করাতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এর ভিত্তি কী? এটা বাস্তবায়ন না করার পরিণতি কী হতে পারে?

এম এ ফয়েজ: অনেক পরীক্ষা করা প্রয়োজন, তা ঠিক। আবার শুধু পরীক্ষা করলে এবং তার সংখ্যা বাড়ালেও হবে না। সুবিবেচিতভাবে পরীক্ষা করা এবং তার ফল কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে দ্রুত প্রয়োগ করা জরুরি। যেমন সন্দেহজনক উপসর্গসহ রোগীর পরীক্ষা করার সময় থেকেই তাঁকে আইসোলেশনে নিতে হবে। পরীক্ষার ফলের জন্য অপেক্ষা করা যাবে না।

এখন আমাদের দৈনিক দুই থেকে আড়াই হাজার রোগীর সবাইকেই আইসোলেশনে নেওয়া আবশ্যিক। যত বেশি সন্দেহজনক রোগীর পরীক্ষা করা হবে, তত বেশি রোগী শনাক্তকরণ হবে। উপসর্গবিহীন জনগণেরও কোভিড-১৯ পরীক্ষা পজিটিভ হতে পারে, তবে কমসংখ্যক। সামাজিক কারণে যাঁরা পরীক্ষা করাতে চান, তাঁদের থেকে, যাঁদের উপসর্গ আছে, টেস্টে তাঁদের অগ্রাধিকার থাকতে হবে।

প্রথম আলো: বেসরকারি খাতের চিকিৎসাব্যবস্থা কী প্রমাণ করল? তারা সরকারি খাতের দুর্বলতা কতটা ঘোচাতে পারল এবারের সংকটে?

এম এ ফয়েজ: দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা সব জনগণের কল্যাণে নির্ধারিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থায় সমতার নীতির প্রতিফলন নেই। অনেকেই মনে করতে পারেন, সংক্রামক ব্যাধি দরিদ্র শ্রেণির জনগণের রোগ। কাজেই তাঁরা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেবেন। কিন্তু মহামারি ধনী-দরিদ্র কাউকে অব্যাহতি দেবে না। অপেক্ষাকৃত ধনী জনগোষ্ঠী, যাঁরা দেশের বা বিদেশের ব্যয়বহুল বেসরকারি ব্যবস্থায় চিকিৎসা নিতেন, তাঁরা এখন সেটা পারছেন না।

প্রথম আলো: একই হাসপাতালকে কোভিড, নন-কোভিডে ভাগ করে চলা বাস্তবে সম্ভব কি না?

এম এ ফয়েজ: একীভূত সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থায় একই ছাদের নিচে সব ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই বহু ধরনের বিশেষায়িত বিভাগের সমন্বয়ে আধুনিক চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা তৈরি। সংক্রামক ব্যাধি যেহেতু পৃথিবী থেকে চলে যাবে না, তাই উন্নত দেশেও সংক্রামক ব্যাধি বিভাগ চিকিৎসাবিজ্ঞানের সব প্রতিষ্ঠানে আছে। তাই ব্যক্তিগত সুরক্ষা পদ্ধতি প্রয়োগ করে একই হাসপাতালের পৃথক স্থানে জরুরি বিভাগ ও ওয়ার্ড ব্যবস্থাপনা করা যেতে পারে।

প্রথম আলো: টিকা না আসা পর্যন্তই কি অস্থিরতা চলতেই থাকবে?

এম এ ফয়েজ: কোভিড-১৯ টিকা তো আবিষ্কার হয়েই গেছে। এখন এর কার্যকারিতা, নিরাপত্তা, প্রতিরোধ স্থায়িত্ব এবং সফলভাবে সব জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োগ করার বিষয়ে গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত হলেও ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা গেলে তখন এর সুফল পাওয়া যাবে। অনেক রোগ আছে, যার টিকা আছে কিন্তু ব্যাপকভাবে সব জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োগ করা হয়নি বা যায়নি। যেমন জলাতঙ্ক, জাপানিজ, এনকেফালাইটিস ইত্যাদি রোগের টিকা আছে, কিন্তু সবার জন্য কি তা ব্যবহার করা হচ্ছে?

প্রথম আলো: হার্ড ইমিউনিটি (বেশি মানুষ আক্রান্ত হবে, বেশি অ্যান্টিবডি তৈরি হবে) সূত্র বাংলাদেশে কার্যকর হবে?

এম এ ফয়েজ: হার্ড ইমিউনিটি হবে কি না, তা-ই তো জানা নেই। আর এ ধরনের হার্ড ইমিউনিটি হতে গেলে যত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ রোগ ছড়াতে হবে (প্রায় ৮০ শতাংশ), তার খেসারত কিন্তু অনেক বেশি। প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে এ সংক্রমণ ছড়ালে কত লোক আক্রান্ত হবেন, কত লোক মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হবেন, কত মারা যাবেন, তা হিসাব না কষলেও এঁদের রক্ষা করাটা সবার মানবিক দায়িত্ব। দ্রুত পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্তকরণ, শনাক্ত করা রোগী আইসোলেশন, রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের সঙ্গনিরোধ (কোয়ারেন্টিন) করাটা এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথম আলো: স্বাস্থ্য বাজেট বাড়ানো ও সংস্কার বিষয়ে আপনার বর্তমান ভাবনা কী?

এম এ ফয়েজ: চলমান বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থার পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। আমাদের কাঙ্ক্ষিত এসডিজি টেকসই লক্ষ্যমাত্রা সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার টার্গেট অর্জন করার জন্যও এটা বিবেচনায় নিতে হবে। ভবিষ্যতে নতুন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা আসতে পারে। তখন সেটা নিরসনে সক্ষম রেসিলিয়েন্ট (অভিযোজনযোগ্যতা) স্বাস্থ্যব্যবস্থা তৈরির লক্ষ্যে কাজ দ্রুত শুরু করা প্রয়োজন। সেই কর্মকৌশলের অংশ হিসেবে অর্থের জোগান এবং তার যৌক্তিক ব্যবহার প্রয়োজন তো হবেই।

প্রথম আলো: আইসিইউ, ভেন্টিলেশন, অক্সিজিনেশনের ঘাটতি ও উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

এম এ ফয়েজ: ৮০ শতাংশ কোভিড রোগীরই থাকে মৃদু উপসর্গ। ১৫ শতাংশের অবস্থা হয় মারাত্মক। আর ৫ শতাংশ ক্রিটিক্যাল বা গুরুতর। ক্রমবর্ধমান জটিলতর চিকিৎসার জন্য পর্যবেক্ষণসহ আনুষঙ্গিক চিকিৎসাসামগ্রী ও যন্ত্রপাতির মধ্যে অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা, কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত। ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা নিবিড় পরিচর্যার অংশ (আইসিইউ কেয়ার)। এর জন্য প্রশিক্ষিত চিকিৎসা দল অপরিহার্য। বর্তমান সীমিত ব্যবস্থার মধ্যে দ্রুত নিবিড় পরিচর্যাব্যবস্থা সুচারুরূপে করার বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন, যাতে দেশব্যাপী এ ধরনের আবশ্যক নিবিড় পরিচর্যার ব্যবস্থা তৈরি করা যায়।

প্রথম আলো: আর কী কী উদ্বেগ ও পরামর্শ আপনার?

এম এ ফয়েজ: কোভিড-১৯ বৈশ্বিক স্বাস্থ্যগত-সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকট। প্রতিটি দেশ এটা নিরসনে জ্ঞানের আলোকে অগ্রসরমাণ। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে নিজ নিজ ধারণক্ষমতা অনুযায়ী তারা উপযোগীকরণ নিশ্চিত করে কর্মকৌশল নির্ধারণ করে এগিয়ে চলছে। কোভিড-১৯ মহামারি নিয়ন্ত্রণে এবং উদ্ভূত সমস্যাগুলো মোকাবিলায় কেন্দ্রবিন্দু হলো ‘কমিউনিটি’। আমাদের দুর্যোগ মোকাবিলায় এ ধরনের ‘কমিউনিটি’–সম্পৃক্ততার সফল উদাহরণ আছে। ওষুধবিহীন জনস্বাস্থ্য উপদেশ দৃঢ়ভাবে অনুসরণ, ব্যাপক পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্তকরণ, আইসোলেশন, কন্টাক্ট ট্রেসিং ও সঙ্গনিরোধ সুচারুরূপে করার জন্য কমিউনিটি-সম্পৃক্ততার বিকল্প নেই।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

এম এ ফয়েজ: ধন্যবাদ।