অনুকরণীয় নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন সবখানে

নিলুফার মঞ্জুর
নিলুফার মঞ্জুর

আমার জীবনে আমি যথার্থভাবে যত শুদ্ধ, সুশৃঙ্খল মানুষ দেখেছি, তাঁদের মধ্যে প্রথমে যাঁর নাম করতে হয় তিনি নিলুফার মঞ্জুর, সানবিমসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, বলা যায় সানবিমসের প্রাণ। তাঁর শিক্ষা, তাঁর বিশ্বাস, তাঁর অঙ্গীকার, তাঁর বিনয়, নিরহংকার তাঁকে একজন অনন্যসাধারণ মানুষ হিসেবে সবার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে।

আমি সানবিমসে যোগ দিই ১৯৮৩ সালে। মেয়েকে প্লে গ্রুপে ভর্তি করাতে গিয়ে নিজেই জড়িয়ে গেলাম নিলুফার আপার অবিচ্ছেদ্য স্নেহের বাঁধনে। দীর্ঘ ৩৭ বছরে তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছি কাজ করার সুযোগে। কী অসাধারণ মানের একজন মানুষ ছিলেন, ভাবা যায় না! পরিশীলিত, অসম্ভব ভদ্র, সংবেদনশীল, সংস্কৃতিমনা একজন মানুষ, যাঁর সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল দেশের শিশু-কিশোরদের শিক্ষিত, উদার, রুচিমান, দয়াবান, ভদ্র, সৎ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা—সানবিমস নামের এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে। এবং সে ব্যাপারে তিনি সর্বতোভাবে সফল হয়েছিলেন। আজ সানবিমসের বাচ্চারা (আমরা এখনো ওদের বাচ্চাই বলি) দেশে ও দেশের বাইরে যেকোনো ক্ষেত্রে নিজেদের সম্মানজনকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং শ্রদ্ধাভরে মিসেস মঞ্জুরের অসামান্য ভূমিকা স্মরণে রেখেছে।

নিলুফার আপার রুচিজ্ঞান ছিল অসাধারণ। পুরো স্কুলে কেবল প্লে গ্রুপ ও নার্সারি ছাড়া সব ক্লাসের বোর্ড সাজানো। নতুন নতুন বিষয় ও মাধ্যম আবিষ্কার করা, ছবি আঁকা ছাড়াও বিভিন্ন রকম প্রিন্ট করানো বাটিক, টাই-ডাই, তাঁত, মাটির কাজ—কী না আমি করিয়েছি ছোট বাচ্চাদের দিয়ে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ ছিল নিলুফার আপার, সবকিছু দেখতেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, প্রশংসা করতেন, প্রশ্রয় দিতেন আমাকে, যা খুশি কাজ করানোর জন্য। তবে দেয়ালে ঝোলানো একটা ছবিও বাঁকা হলে তাঁর চোখ এড়াত না।

একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান, বইমেলা, পয়লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বসন্ত উৎসব, পৌষমেলা—কত অনুষ্ঠান যে আমরা করেছি আপার উৎসাহে। তিনি সব সময় চাইতেন দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে যেন বাচ্চাদের একটা প্রাণের যোগ তৈরি হয়।

একবার আমি স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে শান্তিনিকেতনে যাই এক বছরের একটা কোর্স করার জন্য। ফিরে এসে স্কুলে যোগ দেব কি না ভাবছি, নানা কারণে মনটা কিছুটা বিক্ষিপ্ত, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি, অবশেষে স্কুলে যোগ দিলাম। মাস শেষে নিলুফার আপা হাতে বেতনের চেক তুলে দিলেন। বাড়ি এসে খাম খুলে আমি তো থ। আপা তাঁর সই করা একটা ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়ে দিয়েছেন, কোনো টাকার অঙ্ক লেখা ছাড়াই। সঙ্গে সঙ্গে আমি ফোন করে বললাম, আপা, আপনি ভুল করে আমাকে ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়েছেন, কোনো অঙ্ক লেখা হয়নি।

আপা হেসে বললেন, ‘ভুল করে দিইনি, ইচ্ছে করেই দিয়েছি, তোমার যত দরকার তত লিখে নিয়ো। তুমি যে আবার আমার স্কুলে ফিরে এসেছ, আমি এতে খুশি।’ আমার চোখ জলে ভরে এল। এত ভালোবাসা, এত সম্মান আমি কীভাবে গ্রহণ করব?

প্রচারবিমুখ এই মানুষটি সব সময় সবাইকে সামনে এগিয়ে দিয়ে নিজেকে রেখে দিতেন সবার পেছনে, প্রশ্ন করলে বলতেন, ‘ওটাই তো আমার জায়গা।’ সবার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখে অংশ নিতেন। আমাদের মাথার ওপরে ছায়া দিয়ে, পরিবারের বড় বোনের মতো। বাচ্চাদের ভালোমন্দ, কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা—সব দিকে ছিল তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। স্কুলের উন্নতির জন্য তাঁর চেষ্টার অন্ত ছিল না। সারা জীবন যে তাঁর কাছে কত কিছু শিখেছি! সবার অগোচরে থেকেছেন, নিজেকে জাহির করেননি, তবে অনুকরণীয় নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন সবক্ষেত্রে।

তাঁর শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। যে ভালোবাসার টানে আমরা এত বছর সানবিমসে রয়ে গেলাম, দেখা হলে যে মমতাভরা হাত দুটি কাঁধে রাখতেন, তাঁর মায়ায় আমরা তিন প্রজন্ম—আমি, আমার মেয়ে আর নাতি একাধারে পরিপূর্ণ হয়েছি।

তিনি যেখানেই থাকুন, শান্তিতে থাকুন, ভালোবাসায় আবৃত থাকুন।

সাঈদা কামাল: চারুশিল্পী এবং সানবিমস স্কুলের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক