খরচ ও জোগানের অগ্রাধিকার ঠিক করাই বড় চ্যালেঞ্জ

জাহিদ হোসেন।
জাহিদ হোসেন।
>

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। করোনা পরিস্থিতিতে আগামী বাজেট কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। উঠে এসেছে বাজেটের খাতওয়ারি অগ্রাধিকার, অর্থের জোগান, ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব প্রভৃতি। জাহাঙ্গীর শাহ।

প্রথম আলো: করোনার প্রেক্ষাপটে আগামী বাজেটে কোন কোন খাতকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত?

জাহিদ হোসেন: শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্ব একটি অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই আগামী অর্থবছরের জন্য গতানুগতিক বাজেট করলে প্রয়োজন মেটানো যাবে না। আগামী বাজেটে দুটো বিষয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। যেমন কোথায় অর্থ খরচ হবে, আর সেই টাকা কোথা থেকে আসবে। খরচ ও জোগানের অগ্রাধিকার ঠিক করাই আগামী বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ। করোনার পরিস্থিতিতে বাজেটে অগ্রাধিকার পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। সেখানে বর্তমান প্রয়োজন এবং অদূর ভবিষ্যতে কী প্রয়োজন হতে পারে, সেটা বিবেচনায় আনতে হবে। আমার মতে, আগামী বাজেটে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত স্বাস্থ্য খাতে। এ ছাড়া শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা, খাদ্যনিরাপত্তা, কর্মসংস্থান—এসবেও প্রাধান্য দিতে হবে। অন্যদিকে বাজেটের অর্থায়নও গতানুগতিক ধারায় হবে না। কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হবে না, বিদেশি সহায়তা বেশি নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। যদি বাজেটের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় এবং অর্থায়নও সঠিক হয়, তবে বাজেট ঘাটতি ৭-৮ শতাংশ হলেও ক্ষতি নেই।

প্রথম আলো: আগামী স্বাস্থ্য বাজেট কেমন হওয়া উচিত?

জাহিদ হোসেন: বরাদ্দের দিক থেকে স্বাস্থ্য এখনো মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশের কম। আবার উন্নয়নে যা বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা পুরোটা খরচ করা সম্ভব হয় না। স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতাগুলো এবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে করোনার প্রাদুর্ভাব। আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) চূড়ান্ত হয়ে গেছে। সেখানে দেখা গেছে, উন্নয়ন বরাদ্দের দিক থেকে স্বাস্থ্য খাত এখনো নিচের দিকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি বিস্ময়কর। অথচ এটি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বেশি বরাদ্দ পাওয়ার কথা ছিল। এ ছাড়া আগামী অর্থবছরে করোনা প্রতিরোধে ভ্যাকসিন বের হলে তা কেনার জন্য বড় বরাদ্দ রাখা দরকার।

প্রথম আলো: অনেকেই বেকার হয়ে গেছেন, দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন। এই পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করা হবে?

জাহিদ হোসেন: সামাজিক সুরক্ষায় আগের চেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। করোনার কারণে লাখ লাখ মানুষ আয়শূন্য হয়ে গেছেন। তাঁদের জীবন চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে চার কোটি দরিদ্র মানুষ আছেন। অতিদরিদ্র দেড় থেকে দুই কোটি। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দৈনিক ১ ডলার ৯০ সেন্ট থেকে ৩ ডলার ৮০ সেন্টের মধ্যে আয় করা কর্মজীবী মানুষ ৫৫ শতাংশ। তাঁরা এখন ঝুঁকির মধ্যে আছেন। তাঁদের অনেকেই নতুনভাবে গরিব হয়েছেন, অনেকেই গরিব হওয়ার আশঙ্কায় আছেন। এই মানুষগুলোর সামাজিক সুরক্ষা প্রয়োজন। আগামী বাজেটে তাঁদের কর্মসংস্থানের জন্য বিশেষ কর্মসূচি থাকা উচিত। কেননা, ক্ষুধার ঝুঁকির সম্মুখীন হলে তাঁরা করোনার ঝুঁকিকে ভয় পাবেন না। অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা ও সুবিধাভোগী বাড়াতে হবে। এটি খুব দ্রুত করতে হবে। পর্যাপ্ত বরাদ্দ, প্রকৃত সুবিধাভোগী চিহ্নিত করা—এসব দ্রুত করতে না পারলে সংকট বাড়বে। সরকারি সুরক্ষা দেওয়া না হলে তাঁরা করোনা পরিস্থিতি উপেক্ষা করেই রাস্তায় বেরিয়ে যাবেন, যা আরও ঝুঁকি বাড়াবে। ‘রোগী মারা যাওয়ার পর ডাক্তার এনে লাভ নেই’, এমন অবস্থা যেন না হয়। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

প্রথম আলো: করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেকে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। আপনার মত কী?

জাহিদ হোসেন: খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলেছে, ওই সময় পর্যন্ত খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকবে। তবু বলা যাবে না যে খাদ্যসংকট হবে না। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিঘ্নিত হচ্ছে। তাই কেউ খাদ্য আমদানি করতে চাইলেও নানা কারণে সমস্যায় পড়বে। পরিবহন ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি আরও কড়াকড়ি হবে। যেসব দেশ থেকে আমদানি করা হবে, সেসব দেশে হয়তো করোনা পরিস্থিতি সন্তোষজনক না-ও থাকতে পারে। এসব বিবেচনায় খাদ্যসংকটের বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই আমাদের অভ্যন্তরীণ খাদ্যনিরাপত্তার দিকে বেশি জোর দিতে হবে। কৃষককে বীজ, সার, যন্ত্রপাতি প্রভৃতির ব্যবস্থা করতে হবে। ভর্তুকির টাকা যেন সঠিকভাবে দেওয়া হয়। এসব কাজ করতে বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করা দরকার। আবার পণ্য উৎপাদনের পর তা বাজারজাত করা এবং ন্যায্য দামের নিশ্চয়তাও থাকতে হবে। তা না হলে কৃষক ফসল ফলানোয় আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। কৃষকদের সহজে কৃষিঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রথম আলো: এত চাহিদা, বিশাল বাজেট দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থনীতির এই পরিস্থিতিতে বাজেটের অর্থায়ন কীভাবে হবে?

জাহিদ হোসেন: ব্যবসা-বাণিজ্য শিগগিরই স্বাভাবিক হবে না, এটা বোঝা যাচ্ছে। তাই আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ও খুব বেশি হবে না। এ ছাড়া করোনার কারণে আগামী অর্থবছরে এমনিতেই নানা ধরনের কর ছাড় দিতে হবে। তাই রাজস্ব ঘাটতি সীমিত রাখতে কর ফাঁকি প্রতিরোধে বেশি মনোযোগী হতে হবে। বাজেটের অর্থ জোগান দিতে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা যেমন বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে অর্থ পাওয়ার দিকেই বেশি মনোযোগী হতে হবে। কেননা, এসব সংস্থা শুধু করোনার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশেষ তহবিল গঠন করেছে। তবে দাতা সংস্থাগুলোর করোনা তহবিল পেতে প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে বাংলাদেশকে। সব দেশই এসব তহবিল থেকে অর্থ পেতে চাইবে। তাই করোনা প্রতিরোধ এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দ্রুত কর্মসূচি ও প্রকল্প বানাতে হবে। কেননা, অর্থ অনুমোদনের আগে ওই সংস্থাগুলো জানতে চাইবে, করোনার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া নিয়মিত তহবিল থেকে অর্থ পাওয়া অব্যাহত রাখতে হবে। তারপরও বাজেট ঘাটতি হবে। এ মুহূর্তে বাজেট ঘাটতি ৭-৮ শতাংশ হলেও ক্ষতি নেই। বাজেট ঘাটতি মোকাবিলায় দেশের অভ্যন্তরের ব্যাংক থেকে টাকা পাওয়া কঠিন হবে। কেননা, ব্যাংক সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থের জোগান দিচ্ছে। বাজেট ঘাটতি মোকাবিলায় শেষ অস্ত্র হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ নেওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নেওয়া টাকা সঠিকভাবে ও দুর্নীতিমুক্তভাবে খরচ করতে হবে।

প্রথম আলো: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে করোনার প্রভাব কেমন হতে পারে?

জাহিদ হোসেন: বিশ্ব বাণিজ্য পরিস্থিতি শিগগিরই আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। রপ্তানি খাতে তৈরি পোশাকনির্ভরতা কমাতে হবে। রপ্তানি পণ্য বহুমুখী করতে হবে। তবে শঙ্কার বিষয় হলো, বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি সন্তোষজনক না হলে বিদেশি ক্রেতারা এ দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে আগ্রহ দেখাবেন না। আমি মনে করি, অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্য বহুমুখী ও বিস্তৃত করার সুযোগগুলো তৈরি করতে হবে। যেমন ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলগঠনের পরিকল্পনা আছে। যেগুলোর মধ্যে অগ্রগতি বেশি; যেমন মিরসরাই ও আনোয়ারার কাজ দ্রুত শেষ করা উচিত। তাহলে বিনিয়োগ আসবে, কর্মসংস্থান হবে। সব মেগা প্রকল্পে অগ্রাধিকার না দিয়ে যেখানে বরাদ্দ বৃদ্ধি করলে দ্রুত শেষ হবে, দ্রুত ফল পাওয়া যাবে, তা-ই করা উচিত। যেমন পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের কাজ অনেক এগিয়েছে। এই দুটি প্রকল্পে বরাদ্দ দিয়ে দ্রুত শেষ করা উচিত। কিন্তু এডিপিতে দেখলাম, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিশাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এতে বেশ অবাক হয়েছি। বাংলাদেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ‘সারপ্লাস’। তাই অর্থনীতির এই ক্রান্তিকালে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণে বেশি বরাদ্দ দেওয়া কোনোভাবেই অগ্রাধিকার হতে পারে না।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

জাহিদ হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।