আংশিক নয়, সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দরকার

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

মাস দেড়েক আগে জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তা এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলছিলেন, করোনার মধ্যে অনেক দেশই ‘অর্থনীতি নিয়ে খুব বেশি তাড়াহুড়া’ করছে। করোনার কারণে শুধু অর্থনীতি নয়, আরও বহু কিছু বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। জীবনযাত্রা এবং প্রচলিত নীতি-আদর্শ, মূল্যবোধসহ অনেক কিছুই আর আগের মতো থাকবে না। তিনি বলছিলেন, সেসব দিকেও দৃষ্টি দেওয়া দরকার। লকডাউন ও আইসোলেশনের সময় ধর্ষণ, নারী নির্যাতন বেড়ে গেছে বলে মহাসচিব মন্তব্য করেন।

করোনার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির যে সংকট, তার একটা সমাধান বেরিয়ে যাবে। মানবজাতির কোনো সমস্যাই কখনো সমাধানের ঊর্ধ্বে নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকেই আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। বহুপাক্ষিকতার সূচনাও তখন থেকে। হাজার হাজার কোম্পানি ও বিনিয়োগকারী ‘ইউএন গ্লোবাল কম্প্যাক্ট’-এ স্বাক্ষর করে। তবে জাতিসংঘের ‘প্রিন্সিপল ফর রেসপনসিবল ইনভেস্টমেন্ট’ খুব কমই হতে দেখা গেছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ব্যবস্থায় ছোট ছোট দেশ, যারা শিল্পোন্নত নয়, বিশেষ লাভবান হয়নি।

বৈশ্বিক নেতারা আছেন আমাদের মতো দেশগুলোর মাথার ওপরে। শক্তিশালী দেশগুলোর স্বার্থরক্ষাকারী ওই সব দেশের নীতিনির্ধারকদের সব ব্যবস্থাপত্র অগ্রাহ্য করা সম্ভব হবে না। বিশেষ করে যখন তাঁদের পরামর্শে সায় দেওয়ার মতো মানুষ আমাদের দেশেও রয়েছেন যথেষ্ট। সব দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এক রকম নয়। বাংলাদেশের মতো খুব কম উন্নয়নশীল দেশেই ৪০ লাখ তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক নেই। তঁাদের অর্ধেক যদি কাজ হারান, তা হবে খুব বড় সামাজিক বিপর্যয়।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এক সমীক্ষা করে বলেছে, করোনার কারণে দেশে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। তার ফলে এখন আগের গরিব এবং নতুন গরিব মিলিয়ে জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে। ওই দুই প্রতিষ্ঠানের হিসাবে গ্রামে ৪ কোটি ২৯ লাখ ৯৪ হাজার ১২৭ জন এবং শহরে ২ কোটি ৭০ লাখ ২৮ হাজার ৭১৯ জন অভাবগ্রস্ত। অভাবী মানুষকে আইনকানুন প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। অভাবের তাড়নায় তারা যেকোনো বেআইনি কাজ করতে পারে। তার ফলে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে।

করোনার মধ্যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতা শুধু নয়, রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রের দুর্বলতা ধরা পড়েছে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা যে মোটেই কার্যকর নয়, সেটা সরকারকে একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। কাজ যা করার, প্রশাসনের কর্মকর্তারাই করছেন। তার প্রমাণ হলো, প্রশাসনের কর্মকর্তা, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ১৫ জনের বেশি পুলিশ সদস্য জীবন দিয়েছেন কর্তব্য পালন করতে গিয়ে। কয়েক হাজার পুলিশ সদস্য হয়েছেন করোনায় আক্রান্ত। দেশে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি লাখের বেশি। তাঁরা নিরাপদে রয়েছেন। মানুষের পাশেও তাঁরা নেই—বিরল ব্যতিক্রমী জনপ্রতিনিধি ছাড়া।

মোবাইলে ফোন করলেই শোনা যায়, ‘করোনাভাইরাসের সময় সবার সঙ্গে মানবিক আচরণের মাধ্যমে সম্প্রীতি বজায় রাখুন’। উপদেশ হিসেবে এটা মূল্যবান। পরিবারের সদস্যের লাশ ফেলে পালাচ্ছে ‘প্রিয়জনেরা’। সেই লাশ যথারীতি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে সৎকার করেছেন অপরিচিত পুলিশ সদস্য। মানবিক আচরণ কে পালন করল?

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ কোনো সমস্যায় প্রথম যাবে জনপ্রতিনিধির কাছে। জনপ্রতিনিধি প্রয়োজনে প্রশাসনের সাহায্য চাইবেন। জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা মিলেই কাজ করার কথা। কিন্তু আমাদের জনপ্রতিনিধিরা আমলাদের চেয়ে বেশি ব্যুরোক্রেটিক। এককালে জনপ্রতিনিধিরা ছিলেন নিঃস্বার্থ ও পরোপকারী। এখন সম্পূর্ণ বিপরীত। গরিবের জন্য ত্রাণের চাল, আটা, চিনি সরকারি গুদাম থেকে ট্রাকে তুলে সোজা নিয়ে তুলছেন গঞ্জে নিজের দোকানে।

বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি-শাসিত দেশ নয় যে সব দায়দায়িত্ব সরকার একা পালন করবে। আর্থসামাজিক উন্নয়নে এখানে ব্যক্তির ভূমিকা রাখার সুযোগ যথেষ্ট। গত ৪০ বছরে প্রায় ২ কোটি মানুষ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজ নিয়ে গেছেন। তাঁদের পাঠানো রেমিট্যান্সে রাষ্ট্র উপকৃত হয়েছে, কিন্তু তাঁদের অধিকাংশের অবস্থার টেকসই পরিবর্তন ঘটেনি। কারণ, চরিত্রগতভাবে বাঙালি মুসলমানের সঞ্চয়ের অভ্যাস নেই। অভিবাসী শ্রমিকদের পরিবার কষ্টার্জিত টাকায় পাকা বাড়ি করেছেন, বিলাসী দ্রব্য কিনে ঘর সাজিয়েছেন, পরিবারের অন্যরা বসে বসে খেয়েছেন। যদি তাঁরা কিছু অর্থ উৎপাদনমূলক কাজে লাগাতেন, সম্পদ তৈরি হতো, কয়েক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানও হতো। করোনার ক্ষতি পোষাতে এবং তেলের দাম কমে যাওয়ায় সৌদি আরব থেকে ১০ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিককে ফেরত পাঠানো হবে বলে খবরে জানা গেছে। অন্যান্য উপসাগরীয় দেশ থেকেও সমপরিমাণ অবৈধ শ্রমিককে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যেই কয়েক হাজার ফেরত আনা হয়েছে।

ব্র্যাকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, গত আড়াই মাসে ফেরত আসা অভিবাসী শ্রমিকের ৮৭ শতাংশের কোনো আয় নেই। তিন মাসের বেশি চলতে পারবেন মাত্র ৩৩ শতাংশ। অবশিষ্টরা সরকারের সাহায্য ছাড়া চলতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন। যাঁদের বাড়িতে পাকা ঘর আছে, তাঁরা রিলিফের লাইনে গিয়েও দাঁড়াতে পারবেন না। দেশের দুর্দিনে সরকারের কাজ সরকার করবে, কিন্তু নাগরিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। পঞ্চাশের দশকে চীনের বিভিন্ন জায়গায় দুর্ভিক্ষ হয়েছে। মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গেছে। ওই সময় বিভিন্ন দেশে কর্মরত কূটনীতিকেরা দেশে যাওয়ার সময় কাপড়চোপড় বা কসমেটিক নয়, লাগেজে ১০-১৫ কেজি চাল বা গম নিয়ে গেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। তাঁর এই কথাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করতে হবে। মানুষ শুধু চাল খেয়ে বাঁচে না, তার শাকসবজিও চাই। ত্রাণসামগ্রীর বস্তার দিকে তাকিয়ে না থেকে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। সরকারের বড়লোকি ভাবটাও কমাতে হবে। তার পরিবর্তে হতে হবে মিতব্যয়ী। দুর্নীতি কমবে না। বাহুল্য খরচ, দামি গাড়ি কেনা, আসবাব ইত্যাদি কেনাকাটা কিছুকালের জন্য বাদ দেওয়া যায়।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক অপরাধের ধরন বদলায়। আমরা সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিক্ষাবাণিজ্যকে প্রশ্রয় দিয়ে শিক্ষিত বেকার তৈরি করেছি। তাদের প্রত্যাশা পূরণের সক্ষমতা আমাদের নেই। হতাশাগ্রস্ত শিক্ষিত বেকারেরা বিপথগামী হলে তাদের অপরাধের ধরন হবে এক রকম। অশিক্ষিত অভাবী তরুণের অপরাধ হবে অন্য রকম। কম বয়সী ক্ষুধার্ত নারীর অসামাজিক কাজের চরিত্র ভিন্ন। ব্যাপক বেকারত্বে সামাজিক ক্ষেত্রে অভাবিত নৈরাজ্য দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। সুতরাং খণ্ড খণ্ডভাবে নয়, সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যুবসমাজকে সম্পৃক্ত করে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করার কোনো বিকল্প নেই।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক