করোনাকালে সৃজনশীল প্রকাশনা ধ্বংসের মুখে

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে একটানা প্রায় দুই মাস দেশব্যাপী বাণিজ্য বিতান, মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসা বন্ধ থাকে। এ কারণে সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্প মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসের মুখোমুখি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ১৭ মার্চ ২০২০-১৭ মার্চ ২০২১ (এক বছর) মুজিব বর্ষ ঘোষণা করা হয়। বইমেলা-২০২০ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে উৎসর্গ করা হয়।

‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০’ শুরুর আগেই সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক শুরু হয়। এই আতঙ্ক ফেব্রুয়ারি-২০২০ বইমেলাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। বইমেলা শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পরই বাংলাদেশে করোনায় সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়। এর কয়েক দিন পরই আসে দেশব্যাপী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা। বন্ধ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। বইমেলা শেষে দেশব্যাপী বইয়ের দোকানগুলোতে নতুন বই ছড়িয়ে দেওয়া বা বিক্রি হয়ে ওঠেনি। এই বন্ধের কারণে প্রকাশনা ব্যবসা স্থবির হয়ে পড়ে। যে সময়টায় সারা দেশে বই বাজারজাত করার কথা, সে সময় প্রকাশকদের বাজারজাতের পরিবর্তে বইগুলো গুদামজাত করতে হয়েছে।

গত ৩১ মে থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরুর ঘোষণা এসেছে। সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে। ব্যবসায়ীরা আবার যাঁর যাঁর মতো করে সচল করতে চেষ্টা করবেন নিজের ব্যবসা। কিন্তু সৃজনশীল প্রকাশনা ব্যবসা সচল হতে আরও কত দিন লাগবে, তা অনিশ্চিত। আমাদের দেশের মানুষের মনে সৃজনশীল বই সম্পর্কে একটি ধারণা আছে। তা হচ্ছেÑমেধাবিকাশ, মানবিক উৎকর্ষ বৃদ্ধি, অতিরিক্ত কিছু জানা কিংবা বিনোদনের জন্য সৃজনশীল বই পড়তে হয়। এগুলো দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করার অভ্যাস আমাদের গড়ে ওঠেনি।

করোনা-উত্তরকালে সৃজনশীল বই কেনায় মানুষের আগ্রহ কতটা থাকবে, তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়। প্রকাশনায় অভিজ্ঞদের অভিমত,Ñফেব্রুয়ারি বইমেলা ২০২১-এর আগে সৃজনশীল বই বিক্রি তলানিতে ঠেকবে। ফেব্রুয়ারি ২০২১ বইমেলার জন্য আরও ০৮ (আট) মাসের অপেক্ষা। এই দীর্ঘ সময় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ খুবই প্রয়োজন।

সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিপুলসংখ্যক মানুষ। প্রকাশক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সরাসরি প্রকাশনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ ছাড়া বই ছাপা ও বাঁধাইয়ের কাজে প্রায় ১০ হাজার কর্মচারী এবং সারা দেশে বই বিক্রির কাজে নিয়োজিত আরও হাজার হাজার কর্মচারীর স্বার্থ রক্ষাই শুধু নয়, দেশের সংস্কৃতি, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারাকে অব্যাহত রাখতে এই শিল্পকে চলমান রাখা অত্যাবশ্যক।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে একজন সুলেখক। সৃজনশীল প্রকাশকদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় দীর্ঘদিনের। এই শিল্প সম্পর্কে তিনি সম্যক ধারণা রাখেন। তাঁর কাছে আবেদন, বই কেনার মাধ্যমে সহযোগিতা করে সৃজনশীল প্রকাশনার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে আপনার অবদান রাখবেন। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা কর্তৃক বই কেনা ও প্রণোদনার মাধ্যমে এই শিল্পকে সহায়তা প্রদানের জন্য নিয়ে কিছু প্রস্তাব পেশ করা হলো।

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রতিবছর বই কিনে বিভিন্ন পাঠাগারে দেওয়া হয়। কিন্তু এই বই কেনার জন্য বরাদ্দ খুবই কম। বই কেনার এই বরাদ্দ অন্তত ১০ গুণ বৃদ্ধি করার সুপারিশ করছি। প্রাথমিকভাবে বর্তমান অর্থবছরে সমন্বয় বাজেট থেকে আরও অন্তত ৫ কোটি টাকা জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের বই ক্রয় খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে ৩০ জুনের আগে বই ক্রয়প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জোর সুপারিশ জানাচ্ছি।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এ বছর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত জাতীয় গ্রন্থ দিবসের অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন এবং দেশব্যাপী বইমেলা আয়োজন সম্ভব নয়। এই খাতের অর্থ প্রকাশকদের বই কেনার জন্য বরাদ্দ দেওয়ার সুপারিশ জানাচ্ছি।

গত বছর (২০১৯ সালে) এ সময় বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি থেকে ওই মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছিল মুজিব বর্ষ উপলক্ষে প্রতিটি পাঠাগারে বঙ্গবন্ধু কর্নার প্রতিষ্ঠার জন্য। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তালিকাভুক্ত প্রায় ১২০০ বেসরকারি পাঠাগার এবং গণগ্রন্থাগারের আওতাধীন জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের ৮০টি পাবলিক লাইব্রেরিতে প্রস্তাবিত ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ দ্রুত বাস্তবায়ন করে বই কেনার প্রক্রিয়া শুরু করার অনুরোধ জানাচ্ছি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সারা দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর যেগুলোতে পাঠাগার আছে, তা আরও সমৃদ্ধ করে প্রতিটি পাঠাগারে অন্তত ২ লাখ টাকার বই দেওয়া হোক। এ ছাড়া যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাগার নেই, পর্যায়ক্রমে সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পাঠাগার স্থাপন করে সমপরিমাণ বই দেওয়া হোক।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে শিক্ষা উপকরণের মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সৃজনশীল বই অন্তর্ভুক্ত করে প্রণিধানযোগ্য পরিমাণ কেনার ব্যবস্থা করার সুপারিশ জানাচ্ছি। এখানে উল্লেখ্য, পূর্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে বই কেনার উদ্যোগ থাকলেও বর্তমানে বিষয়টি দৃশ্যমান নয়। এই বিষয়ে পুনরায় উদ্যোগ গ্রহণের সুপারিশ জানাচ্ছি।

ধর্ম মন্ত্রণালয়

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আওতাধীন দেশব্যাপী কয়েক হাজার মসজিদভিত্তিক সমাজ পাঠাগার আছে। প্রতিটি পাঠাগারে ধর্মীয় বইয়ের পাশাপাশি সৃজনশীল বই কেনার আওতা বৃদ্ধি করতে হবে। এবং প্রতিটি পাঠাগারে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যবিষয়ক বই কেনার পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সুপারিশ করছি।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় দেশের জেলা উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সমাজসেবা কেন্দ্র আছে। প্রতিটি কেন্দ্রে পাঠাগার আছে। প্রতিটি পাঠাগারে বই কেনার জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হোক। এবং প্রতিটি পাঠাগারে আলাদাভাবে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যবিষয়ক বই কেনার পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সুপারিশ করছি।

অর্থ মন্ত্রণালয়

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিহত করতে দেশব্যাপী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় এ খাতের যে ক্ষতি হয়েছে তা থেকে উত্তরণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের জন্য আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, যে প্যাকেজে মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প/ব্যবসার জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা বরাদ্দ করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬-এর অধ্যায় ৩-এর শিল্প ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞা ও শ্রেণিবিন্যাসে ‘সৃজনশীল শিল্প’ (৩.৩. ১৬) ধারায় ‘পাবলিশিং’ ব্যবসাটি অন্তর্ভুক্ত আছে। কিন্তু বিদ্যমান ব্যাংক ব্যবস্থা এবং নীতিমালায় অনেক সময় প্রকাশকদের ঋণ প্রদানে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের অনীহা ও দীর্ঘসূত্রতা দেখা যায়।

এ অবস্থায় সৃজনশীল প্রকাশকদের প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের আওতায় ঋণ গ্রহণের প্রক্রিয়া সহজতর করা এবং ঋণ গ্রহণকালে স্থায়ী সম্পদ (জমি/বাড়ি) বন্ধক রাখার পরিবর্তে প্রকাশকদের উৎপাদিত পণ্য ‘বই’ বন্ধক হিসেবে রেখে এবং যেকোনো সাপ্লাইয়ের কার্যাদেশের বিপরীতে ঋণ মঞ্জুর করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ জানাচ্ছি।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি