পাশ্চাত্যের চেয়ে প্রাচ্যে মৃত্যুহার কেন কম

পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা থেকে এশিয়া অঞ্চলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে মৃত্যুহার কেন এতটা কম, তা উন্মোচন করার জন্য গবেষকেরা নানা রকম তথ্য বিশ্লেষণ করে যাচ্ছেন। করোনাভাইরাসের আবির্ভাব, বিস্তার এবং প্রভাব বোঝার ক্ষেত্রে মৃত্যুহারের এই আঞ্চলিক ভিন্নতা এক রহস্যময় পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে। কোভিড-১৯-এর আবির্ভাবের প্রাথমিক পর্যায়ে এশিয়ার অধিকাংশ রাষ্ট্র লকডাউনের মাধ্যমে সামাজিক দূরত্ব অনুশীলনের জন্য নাগরিকদের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছিল, যা ইউরোপ-আমেরিকায় অনেক দেরিতে করা হয়েছিল। শুধু এই একটি কারণে দুই অঞ্চলে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত মৃত্যুহারে এই তারতম্য হয়েছে, তা খুব দৃঢ়ভাবে দাবি করা যায় না। কেননা লকডাউন এই সংক্রমণের হারকে স্থবির করতে পারে মাত্র।

অন্যদিকে লকডাউন বলা হলেও সীমিত পরিসরে মানুষের চলাচল ছিল প্রায় প্রতিটি দেশেই, যেখানে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা বেশ কঠিন ছিল। ভারত আর পাকিস্তানেও লকডাউন আক্রান্ত হওয়ার গতিকে হ্রাস করেছে, কিন্তু আক্রান্ত হওয়া থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারেনি। আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং শ্রমজীবী অনেক মানুষই জীবিকার তাগিদে ঘরের বাইরে আসতে বাধ্য হন এবং আক্রান্তের হার অতি দ্রুত বাড়তে থাকে। তবে ইউরোপ-আমেরিকায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুহার যে অনুপাতে বেড়েছে, তার সঙ্গে এশিয়া অঞ্চলের তফাতটা বেশ চোখে পড়ার মতো। এমন পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক এই ভিন্নতাকে বিশ্লেষণ করার জন্য বিভিন্ন দেশের মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা, করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স, এমনকি অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন স্থূলতা, ধূমপান অথবা অ্যালকোহল সেবনের মাত্রা নিয়েও তুলনামূলক আলোচনার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সে বিচারে জীবনযাপনের পদ্ধতি ও খাদ্যাভ্যাসের প্রভাব আমরা করোনায় আক্রান্ত হওয়া এমনকি এ থেকে সুস্থ হওয়ার প্রক্রিয়ায় দেখতে পাই কি না, তা আলোচনার দাবি রাখে। শুরুতেই কোভিড-১৯-এর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।

মৃত্যুর মিছিলে ইউরোপ-আমেরিকা এগিয়ে
সারা বিশ্বে কোভিড-১৯-এ আপনজন হারিয়েছে কয়েক লাখ পরিবার। ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্যানুসারে ২ জুন পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬ মিলিয়ন অর্থাৎ ৬০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এই পরিসংখ্যান অনুসারে পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর মৃত্যুহার এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলো থেকে বহুগুণ বেশি।

এশিয়ার কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রে যেমন ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও মঙ্গোলিয়ায় কোভিড-১৯ সংক্রান্ত মৃত্যুহার প্রায় শূন্য। করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনে প্রতি মিলিয়নে মারা গেছে ৩ জন। বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর ও ভারতে তা ৪ জন। এশিয়ার সবচেয়ে বেশি মৃত্যু দেখা গেছে জাপানে, প্রতি মিলিয়নে ৭ জন। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকার চিত্র একদম ভিন্ন। মর্মান্তিক হলেও সত্য, ইউরোপ ও আমেরিকার ক্ষেত্রে প্রতি এক মিলিয়ন মানুষের মধ্যে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা এশিয়ার দেশগুলো থেকে কয়েক শ গুণ বেশি। ইউরোপের বেলজিয়ামে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি, যা প্রতি মিলিয়নে ৮১০ জন। স্পেন, ইতালি ও যুক্তরাজ্য কাছাকাছি আছে, যা প্রায় ৫৬০ জন। আমেরিকাতে মোট মৃত্যু হয়েছে এক লাখের বেশি এবং প্রতি মিলিয়ন হিসাবে তা ৩৪০ জন।
যেহেতু এর কোনো সঠিক ওষুধ বের হয়নি, তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকর বলে ভাবা হচ্ছে। এর পরও লকডাউন, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ করা অথবা স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বিবেচনা করে পশ্চিম ইউরোপ-উত্তর আমেরিকার সঙ্গে এশিয়ার মৃত্যুহারের আকাশ-পাতাল তফাত ব্যাখ্যা করে বেশি দূর যাওয়া যায় না।

খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচরণ
খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচরণের কারণে উন্নত বিশ্বে স্থূলতা অন্যতম স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে সাম্প্রতিক সময়ে। স্থূলতার কারণে উচ্চ রক্তচাপ থেকে শুরু করে হৃদরোগের নানাবিধ জটিল সমস্যা দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, পশ্চিম ইউরোপে ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের প্রায় ২০ শতাংশ এবং আমেরিকার প্রায় ৩৬ শতাংশ মানুষ স্থূলতাজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে। এর সঙ্গে করোনা যুক্ত হয়ে তাদের মৃত্যুঝুঁকি অনেকটাই বাড়িয়ে তুলছে বলে প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত সাক্ষ্য দেয়। US Centers for Disease Control and Prevention নিউইয়র্কে ৪০০০ জন কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত মানুষের ওপর এক গবেষণা থেকে দেখা যায়, শতকরা ৬২ জন কোভিড-১৯-এ মারা যাওয়া ব্যক্তির শারীরিক ওজন স্বাভাবিকের থেকে অত্যন্ত বেশি ছিল। বিপরীতে শতকরা ৩২ জন মৃত্যুবরণকারীর শারীরিক ওজন ছিল স্বাভাবিক। অন্যদিকে ourworldindata-এর তথ্য অনুসারে উত্তর এশিয়ার দেশগুলোতে স্থূলতার হার বেশ কম (৪-৭ শতাংশ), যেখানে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ দেশের ক্ষেত্রে এই হার শতকরা মাত্র ২-৫।

এবার যদি আমরা ধূমপান ও অ্যালকোহল ব্যবহারের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতিমধ্যে প্রচার করেছে, ধূমপান কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি ল্যানসেটের সাম্প্রতিক একটি গবেষণা প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ধূমপায়ীদের মধ্যে আগে থেকেই শ্বাসযন্ত্রে এবং ফুসফুসে সংক্রামক ব্যাধি থাকতে পারে এবং আবশ্যিকভাবেই কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে ধূমপায়ীদের অসুস্থতা মারাত্মক হওয়ার আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দেয়।

অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি অ্যালকোহলসেবীদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অন্যদের থেকে তুলনামূলক অনেক কম থাকায় যেকোনো সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক বেড়ে যায় বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা দিয়েছে। উল্লেখ্য, Ourworldindata-এর তথ্যানুসারে ইউরোপীয় দেশগুলোতে বার্ষিক অ্যালকোহল সেবনের জনপ্রতি গড় হার ১১-১২ লিটার। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় এই হার ৯-১০ লিটার, অন্যদিকে পূর্ব এশিয়ায় বার্ষিক অ্যালকোহল সেবনের হার গড়ে ৬ লিটার। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও শ্রীলঙ্কা বাদে বাকি দেশগুলোর হার ১ লিটারের কম। ল্যানসেটের একটি প্রতিবেদনেও এ ব্যাপারে সতর্ক করে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনে তীব্র শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা এবং কিডনির সমস্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি অ্যালকোহলসেবী হলে তাঁর স্বাস্থ্যঝুঁকি অবশ্যই বেশি। সে বিচারে সাম্প্রতিক সময়ে প্রাকৃতিক, স্থানীয় ও প্রথাগত বিভিন্ন খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়ার প্রবণতাও আমরা অনেকের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি।

রোগ প্রতিরোধক্ষমতাতেই কি প্রকৃত রহস্য
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণামতে, পূর্ব এশিয়ায় জন্ম নেওয়া এই ভাইরাস ইউরোপ-আমেরিকায় অভিগমনের পথে ক্রমাগত তার কাঠামো পরিবর্তন করেছে এবং শক্তিশালী হয়েছে। এই প্রবণতা এটাও নির্দেশ করে যে এশিয়ার অধিবাসীদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতার কারণে করোনাভাইরাসের সঙ্গে বিশেষভাবে অভিযোজন করতে সক্ষম হয়েছিল। যদিও এখনো বিজ্ঞানীদের হাতে পর্যাপ্ত ক্লিনিক্যাল তথ্য নেই, যার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ওপরও করোনাভাইরাসের ভিন্ন ভিন্ন ধরন (স্ট্রেইন) কী রকম প্রভাব রেখেছে এবং এর কারণে উচ্চ মৃত্যুহারের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা পরিমাপ করা সম্ভব।

হার্ড ইমিউনিটির পক্ষে-বিপক্ষে নানাবিধ আলাপ চারদিকে। সম্প্রতি New York Institute of Technology, College of Osteopathic Medicine-এর একদল গবেষক প্রাথমিকভাবে দেখিয়েছেন, BCG ভ্যাকসিন কার্যক্রম যেসব দেশে বাধ্যতামূলক এবং সর্বজনীনভাবে পরিচালিত হয়, সেখানে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত মৃত্যুহার অন্য দেশগুলো যেখানে BCG ভ্যাকসিন কার্যক্রম বাধ্যতামূলক এবং সর্বজনীন নয়, তার থেকে অনেক কম। আমেরিকাসহ ইউরোপের অনেক দেশেই BCG ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক এবং সর্বজনীন নয় কিন্তু এশিয়ার অধিকাংশ দেশেই এখনো BCG ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক। উল্লেখ্য, BCG ভ্যাকসিনের কারণে মানুষের শ্বাসযন্ত্রে যেকোনো সংক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়। নোবেল বিজয়ী জাপানি চিকিৎসাবিজ্ঞানী তাসুকু হোনজো এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এশিয়া ও ইউরোপের মানুষের ‘human leukocyte antigen’ এ সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। সহজ ভাষায় বললে এই জেনেটিক বৈশিষ্ট্য মানবদেহে যেকোনো ভাইরাসের আক্রমণ হলে তা কীভাবে প্রতিরোধ করা হবে, সেই ইমিউন সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাসুকু মনে করেন, কোভিড-১৯-এর সংক্রমণে এশিয়া অঞ্চলে কম মৃত্যুহারকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে গবেষণা করা যেতে পারে।

তবে এই হার্ড ইমিউনিটির ধারণা নিয়েও বেশ বিতর্ক হচ্ছে; যেখানে দেখা যাচ্ছে, অনেক দেশে এর পক্ষে অবস্থান করে তাদের স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যেতে চাচ্ছে আবার কেউ কেউ এর তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। যেভাবেই দেখা হোক না কেন, আপাতত আমাদের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচরণের দিকে জোর দেওয়ার মাধ্যমে ইমিউনিটি বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরবর্তী উদ্ভাবনের দিকে প্রতীক্ষায় থেকে এই আগ্রাসনকে মোকাবিলায় নানা বিষয়কে আজ সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করার সময় এসেছে। পরিবেশ, আবহাওয়া, আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য এবং ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন এবং খাদ্যাভ্যাস নিয়ে নিত্যনতুন তথ্য করোনাভাইরাসকে মোকাবিলায় মানুষকে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণে সহায়তা করবে।

ইকবাল এহসান: (প্রোগ্রাম অফিসার, পপুলেশন কাউন্সিল) ও বুলবুল সিদ্দিকী (সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক সেন্টার ফর পিস স্টাডিস, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়)