যে কারণে তালেবানের সঙ্গে শান্তি চায় যুক্তরাষ্ট্র

রয়টার্স ফাইল ছবি
রয়টার্স ফাইল ছবি

গত ঈদের ছুটিতে ২৩ মে থেকে তিন দিনের জন্য তালেবান অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দিয়েছে। ঘটনাক্রমে আফগান সরকারের পক্ষ থেকেও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রবিরতির ঘোষণা আসে। এই অস্ত্রবিরতির মেয়াদ অতি সংক্ষিপ্ত হলেও দেশটিতে যেভাবে একের পর এক সহিংসতা হচ্ছে, তা কমিয়ে আনতে এর গুরুত্ব আছে। 

যুক্তরাষ্ট্র ও আফগানিস্তানের মধ্যে যে কূটনৈতিক টানাপোড়েন চলছে, তা কমাতেও এ ঘোষণা যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে বলা যায়। এ ছাড়া ওয়াশিংটন কাবুলের সঙ্গে তালেবানের শান্তি আলোচনার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তাতেও খানিকটা সাহায্য করেছে দুই পক্ষের এই সংক্ষিপ্ত অস্ত্রবিরতি। 

গত ১২ মে কাবুলের হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডে তালেবানের ভয়াবহ হামলার পর আফগানিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অনেকখানি তেতে ওঠে। এর কারণ হলো আফগান সরকারের কোনো প্রতিনিধি না রেখেই যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিল। সেই আলোচনার পর তালেবান সন্ত্রাসী হামলা চালাবে না বলে আশা করেছিল কাবুল। কিন্তু সে রকম কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না বলে আফগান নেতারা এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দুষছিলেন। 

এর পাশাপাশি তালেবানের প্রতি সরকারের আক্রোশ বেড়েছে। আফগান সরকারের জাতীয় প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হামদুল্লাহ মুহিব টুইটারে বলেছেন, তালেবান যদি সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে, তাহলে তাদের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ স্বাভাবিকভাবেই সীমিত হয়ে আসবে। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি বলেছেন, আফগান সেনাবাহিনী রক্ষণাত্মক কৌশল থেকে সরে আক্রমণাত্মক কৌশল বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। 

কিন্তু মজার বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে যেসব বক্তব্য আসছে, তা একেবারে নজিরবিহীন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর প্রয়োজনে তালেবানের সঙ্গে আফগান সরকারের শান্তি আলোচনায় বসা দরকার। যুক্তরাষ্ট্র আর আফগানিস্তানে রক্তপাত দেখতে চায় না। আফগান শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত জালমে খলিলজাদ বলেছেন, শান্তি আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কোনো ধরনের অজুহাত তাঁরা শুনতে চান না। 

আরও লক্ষণীয় বিষয় হলো গত ১২ মে হামলার ঘটনার জন্য ওয়াশিংটন তালেবানকে দোষারোপ করেনি। তাদের ভাষায় আইএস এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এ ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তাদের ধরতে তালেবান ও সরকারকে একযোগে কাজ করতে হবে। গত ১৯ মে পর্যন্ত দেশটির ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ২০টিতেই সহিংসতা চলছিল। 

তিন মাস আগে যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের সঙ্গে যে চুক্তি করেছে, তা বাস্তবায়নের জন্য ওয়াশিংটন এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। দুটি কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখন আফগান সরকার ও তালেবানের মধ্যে সন্ধি করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। একটি হলো, ১৯ বছরের একটি নিষ্ফল যুদ্ধে সমাপ্তি টানার ক্ষেত্রে আফগানিস্তান যে আকাঙ্ক্ষা করছে, তাকে সফল হতে দেওয়ার একটি চেষ্টা। আরেকটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব রাজনীতি। এটি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী বছর। ট্রাম্প প্রশাসন চলতি বছরেই আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা সরিয়ে আনার বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। তিনি এমনভাবে সেনা সরিয়ে আনতে চান, যাতে সেটিকে সম্মানজনক প্রত্যাহার মনে হয়। 

আফগান সরকারের সঙ্গে তালেবানের শান্তি আলোচনা যদি শুরু হয়, সে সময় যদি মার্কিন সেনা সরিয়ে আনা হয়, তাহলে তারা পরাজিত হয়ে ফিরছে বলে মনে হবে না বলে ট্রাম্প প্রশাসন মনে করে। কাবুলে হাসপাতালে হামলার দিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা রবার্ট ও’ ব্রিয়েন বলেছেন, ‘আফগানদের এখন একটি অর্থবহ শান্তি আলোচনায় একসঙ্গে বসার এবং আমেরিকার ঘরে ফেরার সময় হয়েছে।’

‘তোমাদের শান্তি প্রতিষ্ঠা করা দরকার আর আমাদের সব গুটিয়ে দেশে ফেরা দরকার’—যুক্তরাষ্ট্রের এমন নীতির কারণেই একের পর এক হামলা হওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্র তালেবানকে হামলা থেকে সরে আসতে বলছে না। তারা চাইছে এই কাজ এখন থেকে আফগান সরকারই করুক। খুবই লক্ষণীয় বিষয় হলো কাবুলকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের সঙ্গে যে চুক্তি করেছে, তাতে তালেবানকে সহিংসতা কমানোর কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র এখন তালেবান ইস্যুকে আফগানিস্তানের একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পরিণত করার চেষ্টায় আছে। 

  গত ১৭ মে আশরাফ ঘানির সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর একটি চুক্তি হয়েছে। বিরোধীরা এত দিন তালেবানের সঙ্গে সরকারের শান্তি আলোচনা চেষ্টার বিরোধিতা করে আসছিল। এই চুক্তির ফলে ধারণা করা হচ্ছে এবার আর তারা তাতে বাধা দেবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের যে চুক্তি হয়েছে, তাতে তালেবান বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার শর্ত আছে। ধারণা করা হচ্ছে সেই শর্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সরকার দুই হাজার তালেবান বন্দীকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে। 

তবে তালেবান যে শান্তি চুক্তি হলেও সহিংসতা বন্ধ করবে, এমনটা কেউ বিশ্বাস করতে চাইছে না। তালেবান বুঝতে পারছে, আমেরিকার পিছু না হটে কোনো উপায় নেই, আর আমেরিকান মদদ ছাড়া কাবুলের সেনাবাহিনীর যে ক্ষমতা, তার চেয়ে তাদের ক্ষমতা অনেক বেশি। এ অবস্থায় কাবুল বেইজিং, মস্কো ও তেহরানের সহায়তা চাইতে পারে। কারণ, এই তিন শক্তি আফগান সরকারেরও মিত্র আবার তালেবানকেও সাহায্য করে থাকে। এই তিন শক্তি যদি তালেবানকে নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকতে বলে, তাহলে তারা হয়তো শান্ত হতে পারে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

মাইকেল কুগেলম্যান ওয়াশিংটন ডিসির উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলার্সের সাউথ এশিয়া উইথ দ্য এশিয়ান প্রোগ্রামের উপপরিচালক