ঢের হয়েছে, পাশবিকতার সংজ্ঞাটা এবার বদলাক

ভারতের কেরালায় আনারসের সঙ্গে পটকা বেঁধে অন্তঃসত্ত্বা হাতিটিকে খাওয়ানো হয়। পেটের ভেতর একের পর এক পটকা বিস্ফোরণের একপর্যায়ে পানিতে নামে হাতিটি। পরে মারা যায়। ছবি: রয়টার্স
ভারতের কেরালায় আনারসের সঙ্গে পটকা বেঁধে অন্তঃসত্ত্বা হাতিটিকে খাওয়ানো হয়। পেটের ভেতর একের পর এক পটকা বিস্ফোরণের একপর্যায়ে পানিতে নামে হাতিটি। পরে মারা যায়। ছবি: রয়টার্স

অভিধানটা খুলে বসলাম। মানব শব্দের বিশেষণ লেখা, মানবিক। মনুষ্যোচিত, মনুষ্যসুলভ, লোকহিতকর, মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন বলে যা কিছু প্রতিপন্ন সবই মানবিক। শব্দটির অর্থের ব্যাখ্যা এটাই। একই অভিধান বলছে, পাশবিক শব্দের অর্থ পশুবৎ। মানে পশুর মতো আচরণ।

অভিধান খুলে রেখে ভেবেই চলেছি, পশুসুলভ আচরণের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো কেমন। বাড়ির সামনে একপাল কুকুর থাকে। আমরা অনেকে মিলে ভাগাভাগি করে তাদের খাওয়াই। একটা বাড়ির বারান্দায় প্রতিদিন পাখিদের জন্য খাবার দেওয়া হয়। যার যখন খিদে পায় এসে খেয়ে যায়। তাদের পানের জন্য মাটির পাত্রে জল থাকে। এই সব পশুপাখিকে কখনো বেহায়া হতে দেখিনি! কাউকে কামড়াতে-আঁচড়াতে দেখিনি। ভালোবাসা, মায়া বা দাতা ও গ্রহীতার সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, সেই শিক্ষাও কেউ তাদের দেয়নি। সহাবস্থানই যেন তাদের স্বাভাবিকতা। ভাবতে থাকি, পশুরা কি কখনো কাউকে ধর্ষণ করে? ধর্ষণের পর নৃশংস অত্যাচারে মেতে ওঠে? অযথা ও অকারণে আঁচড়ে-কামড়ে কাউকে ক্ষতবিক্ষত করে? পশুসুলভ আচরণ তবে কেন সহিংসতাজনিত একটা গা-ঘিনঘিনে ব্যাপার হিসেবে চিত্রায়িত হবে? ভাবতেই থাকি, কোন আচরণটা প্রকৃত ‘পশুসুলভ’ আর কোনটাই বা ‘মানবিক’!

যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার মিনিয়াপোলিস শহরে প্রকাশ্য রাজপথে গলায় হাঁটু চেপে ধরে ফ্লয়েডকে হত্যা করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার মিনিয়াপোলিস শহরে প্রকাশ্য রাজপথে গলায় হাঁটু চেপে ধরে ফ্লয়েডকে হত্যা করা হয়।

ভাবছি আর চোখের সামনে ভেসে উঠছে পরপর দুটো দৃশ্য। একটা সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার। সেখানে মিনিয়াপোলিস শহরে প্রকাশ্য রাজপথে ডেরেক শবিন নামে ৪৪ বছরের এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ ৪৬ বছরের জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গের ঘাড় হাঁটু দিয়ে চেপে রেখেছেন। জর্জের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। মাথাটা একদিকে কাত হয়ে রয়েছে। যন্ত্রণায় জর্জ কাতরাচ্ছেন আর বলছেন, আমি শ্বাস নিতে পারছি না। প্লিজ, প্লিজ অফিসার, ওরা আমায় মেরে ফেলবে। বাঁচার সেই আকুল আর্তিতেও ডেরেক শবিন অচঞ্চল। বাঁ হাত পকেটে ঢুকিয়ে নির্বিকার বসে রইলেন! মাত্র নটা মিনিট! হাঁটুর চাপে নয় মিনিটেই দম বন্ধ হয়ে নিথর হয়ে গেল জর্জের শরীর। কী ছিল কালো মানুষটির অপরাধ? কুড়ি ডলারের একটা জাল নোট চালানোর চেষ্টা!

দ্বিতীয় ছবিটা দক্ষিণ ভারতের সেই রাজ্যে যেখানকার মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রসার সবচেয়ে বেশি। সাক্ষরের হার সবার ওপরে। মারণরোগ করোনার মোকাবিলায় যে রাজ্যকে মডেল বা আদর্শ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। সেই রাজ্য, যার নাম কেরালা, সেখানকার শহর মল্লপুরমের কিছু মানুষ বিস্ফোরকভর্তি আনারস খাইয়ে মেরে ফেলেছে জঙ্গলছুট অন্তঃসত্ত্বা এক হস্তিনীকে। জঙ্গল ছেড়ে পশুটা লোকালয়ে চলে এসেছিল। সম্ভবত একটু খাবার পাওয়ার আশায়। কোনো অর্বাচীন বিস্ফোরক ঠাসা আনারস খাইয়ে শিক্ষা দিল তাকে। নামহীন হস্তিনীটি ‘অমানুষ’ হতে পারেনি। বিস্ফোরকে জর্জরিত ও যন্ত্রণায় কাতর হস্তিনী কারও অনিষ্ঠ না করে নদীগর্ভে নিমজ্জ থেকে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়!

সেই থেকে শুরু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মনুষ্যকুলের বিলাপ। কেউ লিখলেন, ‘হাতিটা মানুষকে বিশ্বাস করেছিল। সেটাই ছিল তার মস্ত ভুল।’ কেউবা, ‘হাতিটা মরে গেল। গল্প এটুকুই। বাকিটা লজ্জার।’ কেউ প্রবল অভিশাপে গর্জে উঠে বলল, ‘মানুষকে এর ফল ভুগতে হবে। প্রকৃতি ঠিক এই পাপের শোধ তুলবে।’ কারও কণ্ঠের রায় শীতল ও নির্বিকার, ‘করোনাই এই সব মানুষের উচিত শাস্তি।’

আমি শৈশবে ফিরে যাই। কী খেয়াল যে হয়েছিল কে জানে, কালীপুজোর রাতে গ্রামের বাড়িতে কুকুরের লেজে ফুলঝুরি বেঁধে বিপত্তি ঘটিয়েছিলাম। আতঙ্কগ্রস্ত কুকুরটা প্রাণভয়ে এদিক–ওদিক দৌড়াদৌড়ি করতে করতে খড়ের গাদায় ঝাঁপ দিয়েছিল। আগুন মারাত্মক হয়ে ওঠার আগেই গ্রামের বড়রা সামাল দিয়েছিলেন। সেই অমাবস্যার রাতে আমিও পেয়েছিলাম জীবনের এক বড় শিক্ষা।

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবের সময় শামুকখোল পাখিগুলো গাছে টিকতে না পেরে মাটিতে পড়ে যায়। নাটোরের বাজিতপুর গ্রামের অনেকেই সেই অসহায় পাখিগুলোকে ধরে কেটেকুটে রান্না করে খায়। ছবি: প্রথম আলো
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবের সময় শামুকখোল পাখিগুলো গাছে টিকতে না পেরে মাটিতে পড়ে যায়। নাটোরের বাজিতপুর গ্রামের অনেকেই সেই অসহায় পাখিগুলোকে ধরে কেটেকুটে রান্না করে খায়। ছবি: প্রথম আলো

কিন্তু স্মৃতিচারণা নয়। অভিধান খুলে ভেবে চলেছি, ‘পাশবিক আচরণ’ আদতে ঠিক কি? পশুজগতের কোন আচরণটা বাস্তবিকই ‘পাশবিকতার’ সংজ্ঞায় মোড়া? জঙ্গলের নিয়মের বাইরে পশুরা আর কি কিছু করে, যা চোখ টাটায়? পশুরা কি ধর্ষণ করে? ধর্ষণের পর বিকৃত কাম লালসার চিহ্ন রাখে? খিদে না পেলেও কি তারা সহজলভ্য প্রাণী হত্যা করে? অকারণে এলাকা দখলের তাড়নায় ভোগে? কেউ কি কোনো দিন শুনেছে পশুরা শিশুখাদ্যে ভেজাল দেয়? ব্যাংক লুট করে? বিষ খাইয়ে মারে? মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে জেতে? দেশের সম্পত্তি বিদেশে পাচার করে? গায়ের জোরে অন্য কারও সম্পত্তি হাতায়? নিজেদের মধ্যে সাদা-কালোর বিভাজন করে? পশুজগতে কি ধর্মীয় বিভাজন থাকে? কাউকে বিধর্মী তকমা দিয়ে পিটিয়ে মারে? জাতিভেদ আছে? কিংবা বর্ণভেদ? আধিপত্যবাদ কায়েম করতে তারা কি যুদ্ধে মেতে অন্য অনেক পশু মেরে ফেলে?

কী আশ্চর্য, একটাও মেলাতে পারছি না! অথচ মনুষ্যকৃত ‘অমানবিক’ কাজগুলোকে আমরা অবলীলায় ‘পাশবিক’ দেগে দিই! দ্বিধাহীনভাবে! কেন দিই? কোন যুক্তিতে? প্রকৃতি ও প্রাণিকুলের সর্বনাশ ঘটিয়ে সভ্যতার তকমাধারী ‘মানবিক’ মানুষ যখন ‘পাশবিকতার’মোড়কে চিহ্নিত হয়, মাথাটা তখন ভোঁ ভোঁ করে ওঠে। প্রাণিজগতের স্বর আমরা বুঝি না। বুঝতে চাইও না। তাই বুঝতে পারি না, তারাও প্রতিবাদী হয়। মানুষের তৈরি ‘পাশবিক’ বিশেষণ তাদের আহত করে। তারা জানে, মানুষের মতো ‘অমানবিক’ হওয়া তাদের ধর্মে নেই। অথচ তবু ‘পাশবিক’ শব্দটা বিশেষণ হয়ে অভিধানে জ্বলজ্বল করে!

মনে হয়, চিৎকার করে বলি, ঢের হয়েছে, ‘পাশবিক’-এর সংজ্ঞাটা এবার বদলাক।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি

আরও পড়ুন: