বাংলাদেশের জর্জ ফ্লয়েড ছিলেন যে আলতাব আলী

১৯৭৮ সালের ৪ মে লন্ডনের এডলার স্ট্রিটে খুন হয়েছিলেন ২৪ বছর বয়সী আলতাব আলী। ছবি: সংগৃহীত
১৯৭৮ সালের ৪ মে লন্ডনের এডলার স্ট্রিটে খুন হয়েছিলেন ২৪ বছর বয়সী আলতাব আলী। ছবি: সংগৃহীত

যে ঘটনা কেবল মৃত্যু দিয়ে শেষ হয়নি

বিশ্বের দেশে-দেশে এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের কালোদের নিরাপত্তার সমর্থনে সংহতি সমাবেশ হচ্ছে। বাংলাদেশে এখনো তেমন কিছু হয়েছে বলে শোনা যায়নি। তবে আন্তর্জাতিক পরিসরে বর্ণঘৃণাবিরোধী লড়াইয়ে বাংলাদেশিদের গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে। বিশেষ করে এ উপলক্ষে লন্ডনের আলতাব আলীর ঘটনা আবারও আমরা স্মরণ করতে পারি।
১৯৭৮ সালের ৪ মে লন্ডনের এডলার স্ট্রিটে খুন হয়েছিলেন ২৪ বছর বয়সী আলতাব আলী। বাংলাভাষী-অধ্যুষিত ব্রিক লেনের কাছেই এডলার স্ট্রিট। আলতাব আলীর মৃত্যু হঠাৎ সংঘটিত চোরাগোপ্তা খুনের কোনো ঘটনা ছিল না। ব্রিটেনের বাংলাদেশি সমাজ সেখানকার বর্ণবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত অবস্থায় ওই আক্রমণ ঘটে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দিনে রাজপথে গলায় ছুরি মেরে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। পেশাগতভাবে তিনি বস্ত্র খাতের একজন কর্মী ছিলেন।
লন্ডনে ১৯৭৭-এর শেষার্ধ থেকে শুরু হওয়া বাংলাদেশিদের ওই লড়াই এবং আলতাব আলীর খুনের ঘটনা ব্রিটেনসহ ইউরোপে বর্ণবাদবিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায় হয়ে আছে আজও। জর্জ ফ্লয়েডের মতোই ওই ঘটনা কেবল মৃত্যু দিয়ে শেষ হয়নি, বরং নতুন এক জাগরণের জন্ম দিয়েছিল।
সীমিত পরিসরে হলেও কয়েক বছর ধরে ব্রিটেনে ৪ মে ‘আলতাব আলী দিবস’ পালিত হচ্ছে। তারও আগে ১৯৯৮-এ তাঁর নামে সেখানে একটা উদ্যানও হয়েছে, আগে যা ছিল সেইন্ট মেরি পার্ক। কোনো বাংলাভাষীর নামে এটাই লন্ডনের একমাত্র উদ্যান। আলতাব আলী ও বাংলাভাষীদের তৎকালীন বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামকে উপজীব্য করে একটা ডকুমেন্টারিও তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যে, ‘আলতাব আলী অ্যান্ড দ্য ব্যাটল অব ব্রিকলেইন’ নামে।

আলতাব আলীর নামে প্রতিষ্ঠিত পার্কের ফলক। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
আলতাব আলীর নামে প্রতিষ্ঠিত পার্কের ফলক। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

বাংলাভাষীদের মিছিল গিয়েছিল ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন পর্যন্ত
মৃত্যুর ৯ বছর আগে এক নিকটাত্মীয়ের হাত ধরে আলতাব আলী বাংলাদেশ থেকে ব্রিটেনে গিয়েছিলেন রুটি-রুজির সংগ্রামের অংশ হিসেবে। ১৯৭৫-এ এক দফা দেশে এসেছিলেন তিনি। বিয়েও করেন। যদিও স্ত্রীকে ছাড়াই সে দফায় লন্ডন ফিরেছিলেন। ১৯৭৮-এর ৪ মে ১৬-১৭ বয়সী যে তিন শ্বেতাঙ্গ কিশোর তাঁকে খুন করে, তাদের সঙ্গে আলতাব আলীর কোনো পরিচয় বা বৈরিতা ছিল না। আজও বিশ্বব্যাপী জাতিঘৃণা এবং বর্ণঘৃণার প্রকৃতিই এমন। আক্রমণকারীরা বিষাক্ত আদর্শে অন্ধ থাকে। নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করতে তাদের অজুহাতেরও দরকার হয় না।
তবে আলতাব আলীর আত্মদান ব্রিটেনে বাংলাদেশি কমিউনিটির সংঘবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রেও একটা উল্লম্ফন ঘটিয়েছিল সেদিন। তাঁর মৃত্যুর প্রতিবাদে ব্রিটেনের ইতিহাসে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বড় মিছিলগুলো হয়। বৃষ্টিস্নাত এ রকম অন্তত একটা মিছিলের গন্তব্য ছিল দেশটির প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন পর্যন্ত। ব্রিটেনপ্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবনে সেটি ছিল আবেগময় একটি দিন।
এসব মিছিল দেখে জুনে ব্রিক লেনের বাংলাভাষী বসতিগুলোতে আবারও বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ তরুণেরা হামলায় চালায়। তাতে অবশ্য এশীয়দের আন্দোলন আরও তীব্র হয়। এর মধ্যে সেখানে ২৪ সেপ্টেম্বরে বর্ণদাঙ্গাবিরোধী বিশাল এক সমাবেশ হয়, যাতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লক্ষাধিক মানুষ যোগ দেয়।
এসব বড় বড় সমাবেশ ও মিছিল তখন স্থানীয় এশিয়ানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও মৈত্রীর আবহাওয়া তৈরি করে। এই ঘটনা একদিকে যেমন লন্ডনের এশিয়াবাসীর মধ্যে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের তাগিদ তৈরি করে, তেমনি এর প্রভাব পড়ে মূলধারার রাজনীতিতেও।
শ্বেতাঙ্গ ন্যাশনাল ফ্রন্টকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার জন্য বাংলাদেশি আন্দোলনকারীরা সেদিন কোনো সাদা-বিদ্বেষের ফাঁদে পা দেননি। বরং সবাই স্লোগান তুলেছিলেন: ‘সাদা-কালো জোট বাঁধো, বর্ণঘৃণা নির্মূল করো।’ এই কৌশল বেশ ভালো কাজে দেয়। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে ন্যাশনাল ফ্রন্টের আবেদন ক্রমে কমে আসে। পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে তাদের প্রভাব দুর্বল হয়।
১৯৭৮-৭৯ সালে ব্রিটেনে অশ্বেতাঙ্গদের ওই গণবিস্ফোরণ সেখানে বর্ণবিদ্বেষী অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনেরও সূচনা ঘটায়। এর আগে লন্ডনের এই অঞ্চলে নাৎসিবাদী শ্বেতাঙ্গ একাংশের হুমকি ও আক্রমণে বাংলাদেশিসহ এশিয়াবাসীকে খুবই ভীতিতে থাকতে হতো। ‘ব্ল্যাক আউট’, ‘হোয়াইট ইজ রাইট’, ‘কিল দ্য ব্ল্যাক বাস্টার্ড’ প্রভৃতি স্লোগান দিয়ে নিত্যদিন নানানভাবে নাজেহাল করা হতো এশিয়ার মানুষদের। আলতাব আলীর খুনের আগে-পরের গণ-আন্দোলন এ অবস্থার পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। যদিও লন্ডনে এখনো টমি রবিনের নেতৃত্বে ইংলিশ ডিফেন্স লিগের মতো সংগঠন রয়ে গেছে, যারা বর্ণবিদ্বেষী রাজনীতি লালন করে বলে মনে করা হয়। কিন্তু পরিস্থিতি কোনোভাবেই গত শতাব্দীর শেষ দশকগুলোর মতো ভয়াবহ নয়। দেশটির মূলধারার রাজনীতিতেও এখন বাংলাদেশিদের বিপুল অংশগ্রহণ আছে। চার দশক আগের ওই আন্দোলনেরই একটা ইতিবাচক ফল এসব।
আলতাব আলীর রক্তদান সেখানে লাখ লাখ অশ্বেতাঙ্গের জন্য যেমন ঐক্যের শর্ত তৈরি করেছে, তেমনি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দেশটির অনেক শ্বেতাঙ্গের সংগ্রামেও শক্তি জুগিয়েছে। যেমনটি ঘটছে আজকের আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েডের আত্মদানে।

আলতাব আলীর নামে প্রতিষ্ঠিত পার্ক। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
আলতাব আলীর নামে প্রতিষ্ঠিত পার্ক। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

আলতাব আলীর মতো জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুও পরিবর্তনের ছাপ রেখে যাবে
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে আলতাব আলীর ঘটনা কমই স্মরণ করা হয় এখন। বর্ণ ও জাতিঘৃণার বিরুদ্ধে বৈশ্বিক সংগ্রামে বাংলাদেশিদের অনন্য অংশগ্রহণের এই অধ্যায় সম্পর্কে এখানকার তরুণ প্রজন্ম কমই জানে।
তবে আলতাব আলীর মৃত্যু স্পষ্ট প্রমাণ দিচ্ছে, কোনো প্রতিবাদ ব্যর্থ হয় না। আমেরিকার কালোদের আজকের সংগ্রামও বিশ্বে পরিবর্তনের একটা ইতিবাচক ছাপ রেখে যাবে, যা থেকে বাড়তি সুরক্ষা তৈরি হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাভাষী এবং অন্যান্য সব মিশ্রবর্ণের মানুষের জীবনেও।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক