জাতীয়তাবাদ নয়, প্রয়োজন আন্তর্জাতিকতাবাদ

একটা নিরাপদ ও কার্যকর টিকা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত করোনাভাইরাসকে পরাস্ত করা সম্ভব হবে না। ছবি: রয়টার্স
একটা নিরাপদ ও কার্যকর টিকা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত করোনাভাইরাসকে পরাস্ত করা সম্ভব হবে না। ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসের আগে আমরা পরিচিত হয়েছি ইবোলা, সার্স ও মার্স—এই তিন সংক্রামক ব্যাধির সঙ্গে। তার আগে ছিল স্প্যানিশ ফ্লু, সেটি বিগত শতকের কথা। কিন্তু তারও অনেক অনেক আগে ছিল আরেক সংক্রামক ভাইরাস, যার নাম ভ্যারিওলা, আমাদের কাছে যা গুটিবসন্ত নামে পরিচিত। আমরা এখন জানি, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেও এই ভাইরাস ছিল, মিসরের তিনটি মমিতে তার চিহ্ন রয়েছে। মাত্র ৪০ বছর আগে পৃথিবীর বুক থেকে এই ভাইরাসের নির্মূল সম্ভব হয়।

গুটিবসন্ত নির্মূলের সঙ্গে বাংলাদেশের নাম জড়িত। ভোলার কুরালিয়া গ্রামের তিন বছর বয়সী রহিমা বেগম ছিল এই রোগের শেষ চিহ্নিত রোগী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুটিবসন্তবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে ১৯৭৬ সালে কুরালিয়ার রহিমার খোঁজ মেলে। সে খোঁজ এনে দেয় এই গ্রামের আরেক মেয়ে, আট বছর বয়সী বিলকিস। এ জন্য সে বিশেষ পুরস্কার পেয়েছিল, নগদ ২৫০ টাকা। এই ঘটনার চার বছর পর, ৮ মে ১৯৮০ সালে, জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদের বার্ষিক সভায় বিশ্বনেতারা ঘোষণা করেন, ‘বিশ্বের মানুষ গুটিবসন্ত থেকে মুক্তি পেয়েছে।’

খুব সহজ ছিল না কাজটা। প্রায় পৌনে দুই শ বছর আগে ইংরেজ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার প্রথমবারের মতো গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে কার্যকর এমন একটি টিকা আবিষ্কারে সক্ষম হন। আরও এক শ বছর পর আরেক ইংরেজ বিজ্ঞানী সিডনি কপারম্যান অধিক নিরাপদ একটি টিকা আবিষ্কার করেন। এই টিকা ব্যবহার করেই পরবর্তী ৫০-৬০ বছরের মধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে গুটিবসন্ত কার্যকরভাবে নির্মূল করা সম্ভব হয়। কিন্তু পৃথিবীর বাকি অংশ—দরিদ্র, অবহেলিত ও বিদেশি শাসনাধীন—এই ব্যাধি থেকে তখনো মুক্ত হতে পারেনি। তাদের কথা আদৌ বিবেচনায় আনা হয়নি। ষাটের দশকের শেষ নাগাদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে। তার ফলেই পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে এই ব্যাধির নির্মূল সম্ভব হয়।

মনে রাখা ভালো, আমরা এমন এক সময়ের কথা বলছি, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ‘ঠান্ডা লড়াই’ তুঙ্গে। তা সত্ত্বেও বিশ্বের দেশগুলো গুটিবসন্তের মতো একটি ভয়াবহ ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হাতে হাত মেলাতে সম্মত হয়। অন্য কথায়, গুটিবসন্তের মতো বিশ্বজোড়া মহামারি নির্মূল সম্ভব হয় বিশ্বের দেশগুলোর সম্মিলিত চেষ্টার ফলে। করোনাভাইরাস ঠিক সেই রকম একটি বিশ্বজোড়া মহামারি, একে নির্মূল করতে হলে বিশ্বের দেশগুলোকে আবার হাতে হাত মেলাতে হবে।

৪০ বছর আগে বিশ্বজোড়া উদ্যোগ গ্রহণ সম্ভব হলেও আজ তেমন উদ্যোগ গ্রহণ খুব সহজ হবে না। এক-দেড় দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দক্ষিণপন্থী সরকারের উত্থান ঘটেছে, যারা আন্তর্জাতিকতাবাদের বদলে জাতীয়তাবাদের প্রতি অধিক অনুগত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘সবার আগে আমেরিকা’ নীতি এই জাতীয়তাবাদী রাজনীতির একটি প্রকাশ। গত বছরে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে এসে এক ভাষণে তিনি বিশ্বনেতাদের পরামর্শ দেন, বহুপাক্ষিকতার বদলে জাতীয়তাবাদ আঁকড়ে ধরো, সেটাই প্রকৃত দেশপ্রেমের প্রকাশ হবে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রশ্নে বিশ্বের ধনী দেশগুলো মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছেন।

চীনে করোনাভাইরাস প্রথম ধরা পড়ার পর তা দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লে অধিকাংশ দেশের প্রতিক্রিয়া ছিল চাচা, নিজের প্রাণ বাঁচা। ধনী দেশগুলো শুধু যে নিজেদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয় তা–ই নয়, যে যেখান থেকে সম্ভব মাস্ক ও গ্লাভস থেকে শুরু করে ভেন্টিলেটর পর্যন্ত কিনে নিজের দেশে জমা করা শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র আরও এক কাঠি এগিয়ে অতিরিক্ত সরবরাহের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোকে চাপ দেওয়া শুরু করে। যেমন একটি জার্মান বায়োটেক কোম্পানি, যারা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কারে বেশ কিছুটা এগিয়ে ছিল, তাদের বার্লিন ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসে উৎপাদন শুরুর জন্য গোপন আলাপ-আলোচনা শুরু করে।

আমরা জানি, একটা নিরাপদ ও কার্যকর টিকা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত করোনাভাইরাসকে পরাস্ত করা সম্ভব হবে না। এর জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ সম্পদের বিনিয়োগ, যার কণামাত্র বিশ্বের উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোর নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো এই কাজে বেশ এগিয়েছে, আগামী এক বছরের মধ্যেই এই টিকা আবিষ্কৃত হবে বলে ভাবা হচ্ছে। সে টিকা কি বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে মিলবে? আর যদি পাওয়াও যায়, কত দাম হবে সেই টিকার? পৃথিবীর সব দেশই করোনাক্রান্ত, এই ব্যাধি নির্মূল করতে হলে কোটি কোটি টিকার প্রয়োজন পড়বে। ধনী দেশগুলো কি আমাদের প্রয়োজনের কথাটা মাথায় রাখবে?

ধনী দেশগুলো যদি ধরে নেয় নিজেদের প্রয়োজন মেটানো গেলেই সমস্যার সমাধান হবে, তাহলে ভুল করবে। কোনো এক দেশে এই ভাইরাস নির্মূল করতে হলে সব দেশেই তার নির্মূলের উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় পৃথিবীর সবচেয়ে মজবুত দেয়াল ডিঙিয়ে সে এসে হানা দেবে।

করোনাভাইরাসের কারণে আরও একটি মহামারি পৃথিবীর দেশগুলোকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর নাম অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা। ছোট-বড় সব দেশকেই বিপদে পড়তে হয়েছে। দারিদ্র্য বাড়ছে, বাড়ছে বেকারত্ব। ধনী দেশগুলো এই সংকট হয়তো সামলে নেবে, কিন্তু গাড্ডায় পড়বে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। তারা এমনিতেই বাণিজ্য ও সম্পদের অসম বণ্টনের কারণে বড় ধরনের বিপদে রয়েছে। এখন করোনার কারণে এই সংকট আরও তীব্র হবে। জাতিসংঘ বলেছে, আন্তর্জাতিক সমর্থন ছাড়া এসব দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতসহ অর্থনীতির অধিকাংশ ক্ষেত্র ভেঙে পড়বে।

আগেই বলেছি, করোনা থেকে মুক্তি পেতে হলে ধনী-দরিদ্র সব দেশেই টিকা ও অন্যান্য প্রতিষেধকের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনৈতিক বিপর্যয় রোধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশকে বাদ দিয়ে ধনী দেশগুলো একা নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হবে না। নিজেদের সমৃদ্ধির জন্যই তাদের প্রয়োজন পড়বে তৃতীয় বিশ্বের বাজার, তাদের উৎপাদনব্যবস্থা।

আমরা প্রায়ই বলি পৃথিবী একটা বড় গ্রাম। গ্রামের মানুষ যেমন নিজেদের সুরক্ষার জন্য একে অপরের ওপর নির্ভর করে, তেমনই বিশ্বের সুরক্ষা সম্ভব যদি সবাই একে অপরের প্রয়োজনে পাশে এসে দাঁড়াই। অর্ধশতক আগে পৃথিবী এককাট্টা হয়েছিল বলেই তারা গুটিবসন্তের মতো ব্যাধি নির্মূলে সক্ষম হয়েছিল। করোনাভাইরাসকে নির্মূল করতে হলে আমাদের আবার একজোট হতে হবে।

হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক