মোড়কের রাজনীতি

দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি দুটি মোড়কের লড়াইয়ে পর্যবেশিত হচ্ছে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ আর ‘ইসলামি চেতনা’। এদের মোড়ক বলছি এ জন্য যে চেতনা রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোর বিষয়। এ থেকে রাষ্ট্রের অর্থনীতি, উৎপাদন সম্পর্ক ইত্যাদি ভেতরকাঠামোর চরিত্র বোঝা যায় না। তার পরও মোড়ক রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই মোড়কের মাধ্যমে একটি সরকার বা রাজনৈতিক দল মানুষকে আকৃষ্ট করে। একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য এমন চেতনাগত মোড়কের ভূমিকা জরুরি। দেখা যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ইসলামি চেতনার সঙ্গে একটি বিভ্রান্তিমূলক বিরোধ তৈরির চেষ্টা চলছে। 

স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রের চেতনাগত একমাত্র মোড়ক ছিল মুক্তিযুদ্ধ, যার আলোকে রাষ্ট্রের ভেতরকাঠামোর মৌলিক পরিবর্তনের কিছু উদ্যোগও ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে রাজনীতির ঘটনা-দুর্ঘটনায় রাষ্ট্রের ভেতরের চরিত্র পাল্টানোর প্রক্রিয়া থেমে যায়। যদিও রাজনীতির মোড়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটি অব্যাহত থাকে। ঐতিহাসিক কারণে এই মোড়কের একচ্ছত্র দাবিদার হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ। আরেক বৃহৎ দল বিএনপি এই মোড়কের ওপর ভাগ বসানোর জন্য একসময় ‘স্বাধীনতার ঘোষক’-বিষয়ক একটি ধারণারও অবতারণা করে। কিন্তু তারপর ক্রমেই নানা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি ‘ইসলাম’ একটি বিকল্প রাষ্ট্রীয় মোড়ক হিসেবে পুষ্টি পেতে থাকে। সেই অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের চেহারা পাল্টায়। 

স্মরণ রাখা দরকার, ইসলামের দোহাই দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র যে শোষণমূলক ব্যবস্থা কায়েম করেছিল, মুক্তিযুদ্ধ ছিল তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। স্বাধীনতার পর মানুষের ধর্মীয় জীবনাচরণের ওপর কোনো রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ তৈরি হয়নি, যেমন হয়েছিল কামাল আতাতুর্কের তুরস্কে। যিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তিনি নির্বিঘ্নে ইসলাম বা অন্য ধর্মচর্চা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি ছিল সব ধর্মাবলম্বীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু ক্ষীণ হলেও বাংলাদেশে এর বিপরীতে একটি স্রোত বরাবর ছিল, যারা এ দেশকে একটি ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চেয়েছে। যেমন, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছে মুসলমান হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থাকার ব্যাপারটিকে। স্বাধীনতার পর জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ থাকলেও তার সমর্থকগোষ্ঠী দেশেই অবস্থান করছিল। কিংবা ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর যাঁরা মূলত মুসলমান হওয়ার কারণে ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন, তাঁদের অনেকের ভেতরই স্বাধীন বাংলাদেশে বসেও একটি মুসলমান পরিচয়ের দেশে থাকার বাসনা মরে যায়নি। এই ক্ষীণ ধর্মীয় স্রোতগুলোর বাংলাদেশে গতি পাওয়ার প্রথম সুযোগ ঘটে জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসে জামায়াতে ইসলামীসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে রাজনীতি করার অধিকার দেওয়া এবং সংবিধানে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা’ কথাটি যুক্ত করে সংবিধানের একটি ধর্মীয় মোড়ক দেওয়ার  মাধ্যমে। পাশাপাশি এর ঠিক কাছাকাছি সময় এ দেশ থেকে প্রচুর শ্রমিক যেতে শুরু করেন সৌদি আরব, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশে। সেই শ্রমিকেরা পেট্রো ডলার আর নানা আরব দেশীয় উপকরণের সঙ্গে গ্রামগঞ্জে নিয়ে আসেন মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষণশীল ধারার ইসলামি ধ্যান-ধারণাও। গ্রামাঞ্চলের আরেক ধারার কিছু তরুণ কাছাকাছি সময়ে আফগানিস্তানে মার্কিন মদদপুষ্ট তালেবান প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েই সঙ্গে করে আনেন ইসলামের অতিরক্ষণশীল কিছু ধারণার। এদিকে জিয়ার মৃত্যুর পর দেশের ভেতর ইসলামি ধারাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে জেনারেল এরশাদ ইসলামকে ঘোষণা করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে। পক্ষান্তরে সামরিক শাসনের এই পর্বগুলোতে দীর্ঘদিন গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ,  রাজাকার ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহার থাকে নিষিদ্ধ, পাঠ্যপুস্তকে পাল্টানো হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ফলে একাধিক প্রজন্ম বড় হয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কোনো স্পষ্ট ধারণা না পেয়েই। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পর্দার আড়ালে নিয়ে ইসলামি চেতনাকে ক্রমেই করে তোলা হয় প্রবল।  

ওদিকে নব্বইয়ের দশকে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের পর যে আদর্শিক সংকট দেখা দেয়, তাতে অনেক তরুণই আকৃষ্ট হয় ধর্মবোধে, নাইন-ইলেভেনের পর ইসলামের বিরুদ্ধে আমেরিকার কঠোর অবস্থানের প্রতিক্রিয়া হিসেবেও ইসলাম পরিচয়কে আরও জোরালোভাবে আঁকড়ে ধরে অনেকে। বাইরের পৃথিবীতে যখন এসব চলছে, দেশের ভেতর তত দিনে জামায়াতে ইসলামী তাদের ব্যাংক, হাসপাতাল, পত্রিকা, টিভি ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যাপক একটি অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করে ফেলেছে। এভাবেই অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক শর্ত সাপেক্ষে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের বিকল্প একটি মোড়ক হিসেবে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে একটি বিশেষ ধারার ইসলাম। এতে দেশে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর চেহারাও পাল্টায়। আমরা দেখতে পাই স্বাধীনতার ঘোষক প্রকল্পের ব্যাপারে বিএনপির উৎসাহ কমে এসেছে। বরং ইতিমধ্যে শক্তি সঞ্চয় করা জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ইসলামের নতুন মোড়কে নিজেদের উপস্থিত করতে তারা তৎপর। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের মোড়কের ধারক আওয়ামী লীগও ক্ষমতার স্বার্থে নানা ধর্মীয় দলকে কাছে টানার ব্যাপারে হয়ে ওঠে আগ্রহী। ইসলামি মোড়ক এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে কোন নেত্রী কী পরিমাণ নামাজ পড়েন ইত্যাদি নিয়েও পরস্পরের বিতর্ক দেখি আমরা। 

কিন্তু জামায়াতের মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি দলের এতটা শক্তিশালী হয়ে ওঠা এবং তাদের সঙ্গে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর তালবাহানাকে প্রথম একটি ব্যতিক্রমী আঘাত হানে শাহবাগ আন্দোলন। রাষ্ট্রের মোড়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে আপস করার তীব্র বিরোধিতা করে তারা। শাহবাগ আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি সন্ধিক্ষণ তৈরি করে। এ রকম একটি সন্ধিক্ষণেই অত্যন্ত কৌশলে বিচ্ছিন্ন কিছু ব্লগীয় লেখার সূত্র ধরে মুক্তিযুদ্ধ এবং ইসলামকে প্রথমবারের মতো পরস্পরের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেয় জামায়াত এবং তাদের সহযোগী বিএনপি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এই শাহবাগ আন্দোলনকারীদের ঢালাওভাবে নাস্তিক এবং ইসলামের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে তারা। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগ শাহবাগকে সমর্থন দিলে আওয়ামী লীগের গায়েও তারা পরিয়ে দেয় ইসলামবিরোধিতার চাদর। এরপর মোড়ক হিসেবে ইসলামকে আরও প্রবল করে তোলার জন্য বিএনপি, জামায়াতকে আমরা দেখি হেফাজতে ইসলামের মতো স্বল্পপরিচিত একটি দলের পেছনে গিয়েও দাঁড়াতে। আমরা দেখতে পাই শাপলা চত্বরে হেফাজতের সহিংস একটি সমাবেশকে সরকার দমন করে বল প্রয়োগের মাধ্যমে। শাপলা আন্দোলন বিএনপি, জামায়াত, হেফাজতের পরিকল্পিত পথে না যাওয়ার পর আমরা লক্ষ করি পুরো বিষয়টিকে তারা আস্তিকতা এবং নাস্তিকতার দ্বন্দ্ব হিসেবে উপস্থাপন করে এক মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের সূচনা করে। সরকারের শাহবাগ চত্বরের আন্দোলনকে সমর্থন অথচ শাপলা চত্বরের আন্দোলনকে দমন ব্যাপারটিকে তারা কৌশলে আস্তিকতার বদলে সরকারের নাস্তিকতার প্রতি পক্ষপাতিত্ব বলে প্রচার করে। সমাজে দীর্ঘদিন ধরে পুষ্টি পাওয়া ইসলামি চেতনার প্রেক্ষাপটে এই প্রচার বেশ কাজে দিয়েছে বলেই প্রমাণ মিলছে। সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফলের পেছনে আওয়ামী সরকারের নানা ব্যর্থতার সঙ্গে ইসলামপন্থীদের সরকারবিরোধী এই ধর্মীয় অপপ্রচারের উল্লেখযোগ্য প্রভাব আছে বলেই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।  

‘জনগণ কখনো ভুল করে না’, এ কথাটিকে অনিবার্য সত্য বলে ধরে নিলে আমাদের এ কথাও মানতে হবে যে তার দেশের জনগণ ব্যাপক সমর্থনের মাধ্যমে হিটলারকে ক্ষমতায় বসিয়ে তাঁকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংস কর্মকাণ্ডের যে সুযোগ করে দিয়েছিল, সেটা জনগণ ঠিকই করেছিল। কিন্তু জনগণ যে একটি বিমূর্ত সত্তা এবং তার মতামতকে যে কৌশলে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করা যায় তা হিটলার ভালোই জানতেন। হিটলার ক্ষমতায় গিয়ে ‘প্রপাগান্ডা মন্ত্রণালয়’ নামে একটি দপ্তর খুলেছিলেন, যার কাজ ছিল মিথ্যাচারের মাধ্যমে জনগণের মতকে প্রভাবিত করা। এর প্রধান তিনি করেছিলেন গোয়েবলসকে, যিনি মিথ্যাচারকে রীতিমতো একটি বিজ্ঞানে পরিণত করেছিলেন। গোয়েবলস প্রপাগান্ডার তিনটি মূল সূত্রের কথা বলেছিলেন— ১. ব্যাপক মানুষকে প্রভাবিত করতে হলে ছোটখাটো নয় মিথ্যা বলতে হবে ব্যাপক এবং বিশাল মাত্রায়; ২. মিথ্যা বলতে হবে এমন বিষয়ে, যা মানুষের অন্তরের দুর্বল অংশে গিয়ে আঘাত করে; ৩. এমন বিষয়ে মিথ্যা বলতে হবে, যা যাচাই করা সহজ নয়। (সূত্র: প্রপাগান্ডা: পাওয়ার অ্যান্ড পারসুয়েশন, ডেভিড ওয়েলচ ২০১৩)। শাপলা  চত্বরে হাজার হাজার মানুষ মারা যাওয়া, এক যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে কাবা শরিফে মানববন্ধব ইত্যাদি বড় মাত্রায় মিথ্যাচারের সঙ্গে গোয়েবলসের নীতির মিল পাওয়া যায়।

মোড়কের কথায় ফিরি। যে মোড়কে বাংলাদেশের জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সবাইকে এক সুতায় বাঁধা সম্ভব, সেটি মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে ইসলামের কোনো সাংঘর্ষিক সম্পর্ক নেই। এই চেতনার প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলাদেশ হবে একটি যথার্থ গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র, যেখানে প্রত্যেকটি নাগরিক নিরাপদে তাঁর নিজস্ব ধর্মচর্চার অবাধ সুযোগ পাবেন। জামায়াত, হেফাজত ইত্যাদি সংগঠনের অবস্থান এই চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীতে। আর বিএনপি এখন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এই সংগঠনগুলোর সহযোগী হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শুধু মোড়ক হিসেবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রের ভেতরকাঠামোর কোনো পরিবর্তনই ঘটায়নি। বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র হওয়ারই কথা ছিল, যেখানে সরকারি আর বিরোধী দলের ভেতর মূল লড়াই হবে কে, কতটা, কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে বাস্তবায়ন করবে, সেটা নিয়ে। রাষ্ট্রগঠনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোনো সংগঠনের ভূমিকা থাকার কথা ছিল না। তেমন একটি রাষ্ট্র, তেমন একটি সংসদ কি অলীক কল্পনা? হয়তো নয়। বাংলাদেশে এমন ব্যক্তি, সংগঠন আছে, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে রাষ্ট্রের ভেতরকাঠামোর মৌলিক পরিবর্তনের সেই আকাঙ্ক্ষায় সৎ সংগ্রাম করছেন। কিন্তু সেই ব্যক্তি বা সংগঠনগুলো বিচ্ছিন্ন, অসংগঠিত, দুর্বল। মানুষ একটু ভালোভাবে কান পাতলেই তাঁদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাবেন। মানুষ চাইলে তাঁদেরই করে তুলতে পারেন শক্তিশালী।

শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।