শুধু বাজেট বাড়ালেই শিক্ষা খাতের রোগ সারবে না

সাম্প্রতিক সময়ের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট এমনকি করোনাকালেও বাংলাদেশ অনেকটাই মাথা উঁচু করে থাকতে পেরেছে বা পারছে নিজের অভ্যন্তরীণ বাজারের আকর্ষণীয় রূপান্তরের জন্য, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য। কিন্তু ভবিষ্যতে যেদিকে পৃথিবী এগোচ্ছে, যেভাবে বাংলাদেশ বিশ্ব পরিমণ্ডল-বিশ্ববাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে, সেখানে সবাই বলছে মানবসম্পদ উন্নয়ন হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নই মানবসম্পদ উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হতে পারে।

আমাদের জিডিপি বৃদ্ধি পাচ্ছে, অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে, বহির্বিশ্বে আমাদের বাজার আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে, আমাদের জীবনযাত্রার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে, প্রাত্যহিক জীবনে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে, কিন্তু শিক্ষার মান নিয়ে সবার যেন চিন্তা কমছে না। এখনো শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষায় বিনিয়োগ, শিক্ষক নিয়োগ, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। শিক্ষাকে নিয়ে সবাই যেন ক্রমাগত হতাশায় নিমজ্জিত হতে হচ্ছে। শিক্ষার রাজনীতিকীকরণ, শিক্ষার ব্যবস্থাপনায় থাকা ব্যক্তিদের নিয়েও অনেক সমালোচনা তৈরি হয়েছে।

আগের দিনে যাঁরা শিক্ষকতা পেশায় এসেছিলেন, তাঁরা তাঁদের পেশার প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন। যাঁরা এ পেশায় আসতেন, তাঁরা জেনে–বুঝেই আসতেন। ভারতের জ্যোতি বসু একটি বিধিবিধান রাজ্যসভায় পাস করিয়েছিলেন, যেখানে বলা হয়েছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বেশি বেতন-ভাতা পাবেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকেরা আবার তার চেয়েও বেশি বেতন পাবেন এবং তাঁদের নিয়োগ পদ্ধতি হবে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এটি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোতে বিরাটভাবে কাজ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখেছি, সেখানে সম্ভবত প্রায় প্রতিটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয় বা বিজনেস স্কুলে ৫ থেকে ১০ শতাংশ শিক্ষক ভারতীয় বংশোদ্ভূত, যাঁদের আবার ৯০ শতাংশ এসেছে হয়তো আইআইটি বা আইআইএম থেকে।

শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানমনস্ক কিংবা যুক্তিশীল করে গড়ে তোলা যেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ভেদাভেদ তৈরি হচ্ছে। একটি গ্রুপ ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে, কিন্তু পড়াশোনার চাপে শিশুতোষ জীবন উপভোগ করতে পারছে না। তারা প্রথমেই বাজারের জন্য তৈরি হয়ে যাচ্ছে। সরকারি বিদ্যালয়গুলোর মান অনেক কমে গেছে। আর শিক্ষার মান কমার অন্যতম প্রধান কারণ ওই বিদ্যালয়গুলোর বোর্ড বা পরিচালনা কমিটি। বোর্ডগুলো পুরোপুরি রাজনীতিকীকরণ হয়ে গেছে, জবাবদিহি নেই বললেই চলে। কোনো সমস্যায় পড়লেই দুষ্ট লোকেরা রাজনৈতিক পরিচয়কে সামনে নিয়ে আসেন। এ ছাড়া গ্রামে দেখা যায় শিক্ষকেরা সময়মতো স্কুলে হাজির হন না, অনেক সময় শিক্ষক না আসায় ক্লাসও হয় না। অনেক সময় তো শিক্ষকেরা ছাত্রদের পড়ানোর চেয়ে অন্য কাজকে বেশি গুরুত্ব দেন। এ জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান বা নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা সাংসদ শিক্ষকদের কিছু বলতে পারেন না। কেননা, এই শিক্ষকেরাই নির্বাচনের সময় পোলিং এজেন্ট বা পোলিং অফিসার হিসেবে কাজ করেন। এটি গ্রামে একটি বিরাট বিষয়।

দেখা যাচ্ছে, অনেক কোচিং সেন্টার বিজ্ঞাপন দিয়ে বলছে, তারা জিপিএ ৫ পাওয়ার গ্যারান্টি দেয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে গ্যারান্টি দেওয়া এসব কোচিং সেন্টারের অনেকের নাম এসেছে। বিজি প্রেসের কিছু কর্মচারী, প্রশ্ন আনা-নেওয়ার সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যক্তি, প্রশ্নকে গার্ড দেওয়ার কাজে জড়িত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যেরও নাম আলোচনায় এসেছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে জবাবহীনতার যে রাজনীতি সৃষ্টি হয়েছে, সেটার জন্য আমরা বিচার করতে পারছি না। কারণ, আমাদের ভোট দরকার, সমর্থক দরকার। প্রায়ই শোনা যায়, দুঃসময়ে বা নির্বাচনের বছরে কাউকে রাগানো যাবে না।

ভারতে ল স্কুল, মেডিকেল স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল, বিজনেস স্কুলগুলোর ভর্তি পরীক্ষা নেশনওয়াইড হয়। কিন্তু আমরা মেডিকেলে পারলেও অন্য ক্ষেত্রে পারছি না। অনেকেই অর্থমন্ত্রী মুহিতের প্রাক্‌-বাজেট আলোচনায় প্রায়ই বলেছেন, আমাদের একটি অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল দরকার, যারা বলে দেবে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোন মানের শিক্ষা প্রদান করছে। খবরে বেরিয়েছে, কাউন্সিল হয়েছে, কিন্তু তার কোনো কাজকর্ম এখনো দেখছি না। অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল যদি কাজ করে, তবে মানসম্পন্ন বিদ্যালয় ও শিক্ষক বের হয়ে আসবে। তখন দক্ষ শিক্ষকদের যদি বেতন বাড়ানো হয়, পদায়ন করা হয়, নিদেনপক্ষে যদি পুরস্কৃত করা হয়, তবে অনেক সুবিধাও হয়তো পাওয়া যাবে।

আমরা অনেকেই ক্যাডেট কলেজগুলোর প্রশংসা করি। ক্যাডেট কলেজের ছাত্ররা কি অতিরিক্ত সময় পড়ে? কোচিং করে? ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করা কোনো শিক্ষার্থী বলতে পারবে না, সে দিনে গড়ে দুই ঘণ্টার বেশি পড়ার সুযোগ পেয়েছে। তাহলে দিনে দুই ঘণ্টা পড়ে তারা কীভাবে বোর্ডে ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়েছে? তারা তো খেলার সময় খেলেছে, পিটি করার সময় পিটি করেছে, প্যারেড করার সময় প্যারেড করেছে, সিনেমা দেখার সময় সিনেমা দেখেছে। এখন প্রশ্ন হলো, কেন তবে অন্য বিদ্যালয় বা কলেজের শিক্ষার্থীদের এত কোচিং করতে হয়? আসলে আমাদের ক্লাসরুমে পড়াশোনাতেই সমস্যা রয়েছে।

আমরা দক্ষ শিক্ষকদের প্রণোদিত করতে পারছি না। দেখা যায়, শিক্ষকদের মধ্যে যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদেরই দাপট বেশি। প্রায় শোনা যায়, বিজ্ঞান, গণিত, ইংরেজি শিক্ষকদের মধ্যে যাঁরা ভালো পড়ান তাঁদের উৎসাহিত করা হবে, তাঁদের বয়সও বাড়ানো হবে। কিছু হয়েছেও। তবে কিন্তু কার্যকর ফল এখনো খুব একটা দেখা যায়নি। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি, ইউকেএইড, জার্মানির জিআইজেডের তত্ত্বাবধানে ক্লাসরুমকে উন্নত করার জন্য, ডিজিটাল করার জন্য প্রচুর অনুদান দেওয়া হচ্ছে, সরকারও বরাদ্দ বাড়িয়েছে। কিন্তু দৃশ্যমান উন্নতি এখনো অনুপস্থিত। রিপোর্ট বলছে, পুলিশের পরপরই শিক্ষা বিভাগ সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ বিভাগ। এই দুর্নীতি আমরা রোধ করতে পারছি না যেমন সত্য, আরেক সত্য হচ্ছে, আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেখাপড়ার মান প্রচণ্ডভাবে নেমে গেছে।

সবাই বলছেন, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও ভালো শিক্ষকের অভাব। শিক্ষকেরা শিক্ষকতা বাদ দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক হচ্ছেন, সরকারের রেগুলেটরি বডির সদস্য হচ্ছেন, চেয়ারম্যান হচ্ছেন। আমাদের আপত্তি নেই, তবে শিশুরা যেমন সুন্দর মাতৃক্রোড়ে, বন্যেরা বনে, তেমনি শিক্ষকেরা সুন্দর শিক্ষালয়ে। একপেশে শিক্ষক রাজনীতি বিদ্যমান থাকলে শিক্ষার আধুনিকায়ন সম্ভব হবে না। আবার বাজেটের অধিকাংশ বরাদ্দ বেতন-ভাতায় চলে গেলে ডিজিটাল এডুকেশনসহ অন্য উদ্দেশ্যগুলো ব্যাহত হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ ও পদায়ন নিয়ে কোনো ধরনের জবাবদিহি নেই। সাধারণ রেজাল্ট নিয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিন হচ্ছেন, শিক্ষক হচ্ছেন। গবেষণা কিংবা পাবলিকেশন না থাকলেও শিক্ষকদের অধ্যাপক করা হচ্ছে।

জ্ঞান তো একটি বিশ্বজনীন ব্যাপার। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীনে যাও। কেন বলেছে, কারণ জ্ঞান যখন বিশ্ব পরিমণ্ডলে বিবেচিত হয়, দীক্ষিত হয় তখন জ্ঞান বাড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করা হলেও তারা যে ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, তেমন কি আমরা করতে পেরেছি? তাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল কথা হলো, জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো। সেখানে ছাত্রদের পড়াশোনার যোগ্যতা থাকলেই হবে, বাকি বিষয়গুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দেখে। এমনটা কি আমরা করতে পেরেছি? এর সঙ্গে শুধু বাজেট জড়িত নয়। এটি জড়িত সামাজিক কমিটমেন্টের সঙ্গে, মূল্যবোধের সঙ্গে, অনুশাসনের সঙ্গে।

শুনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে নাকি প্রায়ই জায়গা পাওয়া যায় না, বিশেষ করে চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার আগে। এ শিক্ষার্থীরা কিন্তু জ্ঞান অর্জনের জন্য যান না। তাঁরা চাকরি পাওয়ার উদ্দেশ্যে পড়তে যান। অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান কিংবা আকবর আলি খান লাইব্রেরিতে যেতেন বই পড়তে। আর এখন শিক্ষার্থীরা বিসিএস বা চাকরির পরীক্ষার জন্য পড়তে লাইব্রেরিতে যান। তবে এটি যে খারাপ, তা নয়। বিসিএসের জন্য এখন এত আকাঙ্ক্ষা, কারণ প্রথমত সরকারি চাকরিতে নিশ্চয়তা রয়েছে, দ্বিতীয়ত বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ভালো হয়েছে যে বিসিএসের মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষার্থীরা সরকারে আসছে। একইভাবে শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি ও প্রতিযোগিতামূলক করতে পারলে এখানেও মেধাবীরা আসবেন। শিক্ষকদের দক্ষ করে তুলতে বিদেশে পাঠাতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো, শিক্ষাব্যবস্থাকে নিজের মতো চলতে দেওয়া। এখানে কোনো ধরনের সরকারি হস্তক্ষেপ করা চলবে না। এখানে মেধা লালন-পালন করতে হবে, পুরস্কৃত করতে হবে।

প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়ন প্রয়োজন। কারিগরি শিক্ষাসহ উচ্চশিক্ষার বিকাশ প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় গবেষণা ও পাঠাগার বাড়াতে হবে। পদায়নের ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন জার্নালে লেখা প্রকাশের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করতে হবে। সর্বোপরি শিক্ষাকে রাজনীতিমুক্ত করতে না পারলে কোনোদিনও গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত হবে না। যত দিন পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পোলিং বুথের এজেন্ট হবেন, পোলিং অফিসার হবেন, যত দিন পর্যন্ত স্থানীয় নির্বাচন শিক্ষকদের ওপর নির্ভরশীল থাকবে, শিক্ষকেরা ভোট বা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবেন এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনীতি থাকবে, তত দিন শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হবে না।

টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোর আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। এখানে প্রযুক্তি যুক্ত করতে হবে। জানতে পেরেছি, কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ার মোনাস বিজনেস স্কুল বাংলাদেশে শাখা খুলতে চেয়েছিল। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চাপে তাদের আসতে দেওয়া হয়নি। কারণ, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় এলে এখানকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নাকি পিছিয়ে পড়বে। অনেকটাই দিগ্‌ভ্রষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনিয়োগকে রক্ষা করার জন্য এমন পদক্ষেপ জাতির জন্য ক্ষতিকর। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খেয়ালখুশিমতো চলবে, কোনো দায়বদ্ধতা থাকবে না, নিজেদের ইচ্ছেমতো শিক্ষক নিয়োগ দেবে, অধ্যাপক করবে, তা যুক্তিসংগত হতে পারে না।

শ্রেণিকক্ষের আনন্দ বা ‘ক্লাসরুম ডিলাইটের’ ওপর জোর দিতে হবে। সব সময় চেষ্টা করতে হবে, প্রতি ক্লাসে ছাত্ররা একটি হলেও নতুন কিছু শিখছে কি না, নতুন কিছু শেখাতে পারলাম কি না। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে প্রয়াত স্যার ফজলে হাসান আবেদ একবার বলেছিলেন—‘একটি কথা মনে রাখবে, তোমারা ৯৯ শতাংশ ছেলেমেয়েই চাকরিতে যোগ দেবে। সম্ভবত ১ শতাংশ শুধু শিক্ষকতা বা গবেষণায় যোগ দেবে। তাদের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে, এমন শিক্ষাও দেবে, শুধু বইয়ের কথা বলবে না। ইংরেজির কথা বলবে, ড্রেসের কথা বলবে, আত্মবিশ্বাসের কথা বলবে। বিজ্ঞান বা ব্যবস্থাপনা বিশ্বের অভিনব আবিষ্কার ও কৌশলের কথা বলবে। সে যেন ভালোভাবে কথা বলতে পারে, বাচনভঙ্গি সঠিক হয়, সে কথা বলবে। পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে এসবের শিক্ষা শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তোলে।’

জাতিকে গঠন করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। সঠিক লোককে শিক্ষাব্যবস্থায় আনতে হবে এবং সে যেন এখানে থাকতে পারে, সেটার ব্যবস্থা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহু শিক্ষক-কাম-আমলাকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন দক্ষতা অর্জনের জন্য। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির সফল হওয়ার পেছনে এবং গতিপথ পুনর্নির্ধারণে এসব ব্যক্তি বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন।

ঢাকার বাইরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ভিসি বানানো যায় কি না, এমন আলোচনা শুনতে পেয়েছিলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে মোটেই এর পক্ষে নই। তবে এ ধরনের আলোচনা ওঠার কারণ হলো, সম্ভবত শিক্ষা প্রশাসনের ব্যর্থতা। কেননা, মেডিকেল কলেজসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বেশ সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস, ঠিক সময়ে রেজাল্ট না দেওয়া, খাতা হারিয়ে ফেলার মতো সমস্যা তৈরি হয়েছে। যেহেতু কারণ রয়েছে, তাই সমাধান আমাদেরই করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা দুটি বিষয় ভাবতে পারি, এক. যাঁরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করবেন, তাঁরা শিক্ষা প্রশাসনে আসবেন না। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রে হয়ে থাকে। দুই. শিক্ষা প্রশাসন ব্যবস্থাপনার জন্য অ্যাডমিন ক্যাডার বা যোগ্যতা থাকলে বেসামরিক–সামরিক যেকোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাই তা করতে পারবেন। এমনকি নতুন করে শিক্ষা প্রশাসন ক্যাডারও গঠন করা যেতে পারে।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো বিষয় নিয়ে কেউ যেন চিন্তাও করতে না পারে, সে ধরনের শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি আমরা উৎসাহিত না করতে পারি, তাহলে হয়তো অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশে পরিণত হলেও কেউ আমাদের সম্মান করবে না।

এখনো আছে কিনা জানি না, তবে কিছুদিন আগেও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বেনামি বা স্বল্পখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমনকি অনলাইনেও শিক্ষকদের পিএইচডি নেওয়ার হিড়িক পড়েছিল। যাঁরা এভাবে পিএইচডি নিচ্ছেন বা নিয়েছেন, তাঁরা কী পড়াবেন?

পত্রিকান্তরে জানতে পেরেছি, দেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ডাক্তার তৈরি করা হচ্ছে। এসব ডাক্তারের অনেকেই দক্ষ নন। রাজনৈতিক কারণে হোক, অর্থনৈতিক কারণে হোক, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে, তা না হলে মানুষ যে করেই হোক ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর জন্য নিজ সন্তানদের পাঠাবে, এমনকি বাইরে পাঠিয়ে দেবে। এসব শিক্ষার্থী দেশের কোনো কাজে লাগবে না।

আমরা যেন কোনোভাবেই শিক্ষার ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তায়নকে,অপরিপক্বতাকে, কূপমণ্ডূকতাকে, বিজ্ঞানহীনতাকে এবং জবাবদিহির অভাবকে প্রশ্রয় না দিই। তাহলে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েও তেমন একটা লাভ হবে না।

মামুন রশীদ, অর্থনীতি বিশ্লেষক।