অভিবাসী শ্রমিকদের সামনে হতাশা ছাড়া কিছু নেই

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

উপসাগরীয় অঞ্চলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথমদিকে একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছিল সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি আরামকোর কার্যালয়ের ফটকে দক্ষিণ এশিয়ার বংশোদ্ভূত একজন নিম্নপদস্থ কর্মীর দেহের সঙ্গে একটি স্যানিটাইজার ডিসপেনসার মেশিন বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই মেশিন থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা হাত স্যানিটাইজ করছেন। লোকটির বুকের কাছে লেখা ‘স্যানিটাইজার’। রক্ত–মাংসের ওই মানুষটিকেই ‘লাইফ সাইজড স্যানিটাইজার’ বানিয়ে ফেলায় আরামকোর তীব্র সমালোচনা হয় এবং কোম্পানিটি পরে ভুল স্বীকার করে।

কিন্তু ওই ছবি প্রকাশ্যে আসার অনেক আগেই এই আইডিয়া কর্মকর্তাদের মাথায় এসেছিল, সেই আইডিয়া অন্যরা অনুমোদন দিয়েছে এবং মেশিনটির ডিজাইন করা হয়েছে। সেই ডিজাইন ধরে কার্ডবোর্ড কেটে মেশিনটি বানানো হয়েছে। এই এতগুলো লোক এই কাজ অনুমোদন করলেও তাদের কারও মনে হয়নি এটি একজন কর্মীর জন্য কতটা অবমাননামূলক কাজ। মূলত গরিব দেশগুলো থেকে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিক বা অভিবাসী কর্মীদের এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতে অভ্যস্ত হওয়ার কারণেই বিষয়টিকে আর আরামকোর কর্মকর্তাদের অবমাননাকর কিছু মনে হয়নি।

কোভিড–১৯ সংক্রমণের পর মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় দেশগুলোতে প্রায় তিন কোটি অভিবাসী কর্মী যে কতটা দুর্দশার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন, তা সামনে চলে এসেছে। কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও বাহরাইনে যাঁরা কায়িক শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, তাঁদের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বাইরের গরিব দেশ থেকে যাওয়া। সৌদি আরব ও ওমানের শ্রমিকদের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বাইরের দেশের।

উপসাগরীয় এলাকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ধরন এমনভাবে গড় উঠেছে, যেখানে দেখা যাবে ধনী নাগরিকেরা সরকারি খাতের চাকরি করেন এবং গরিবেরা, বিশেষত গরিব অভিবাসীরা বেসরকারি খাতে কাজ করেন। সেখানে কোভিড–১৯ আসার অনেক আগে থেকেই ‘সামাজিক দূরত্ব’ ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। সেখানে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে অভিবাসীদের খাওয়াদাওয়া, ওঠা–বসার সুযোগ খুবই কম। পরিযায়ী শ্রমিকেরা কাজ করতে এ দেশে আসেন। বিভিন্ন নির্মাণকাজে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা বাসাবাড়িতে কাজ করেন। তাঁদের নোংরা পরিবেশে থাকতে হয়। আধুনিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে তঁাদের শারীরিক ও আর্থিক দূরত্ব অনেক আগে থেকেই।

এখন মহামারির এই সামাজিক দূরত্ব এখন অভিবাসীদের একেবারে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়েছে। সব কলকারখানা বন্ধ। হাতে কোনো কাজ নেই। উপার্জন নেই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো (একমাত্র কাতার বাদে) বেকার হয়ে ঘরে আটকা নাগরিকদের আর্থিক প্রণোদনা দিলেও বিদেশি শ্রমিকদের জন্য এমন কোনো সুযোগ রাখেনি। এসব শ্রমিকের হাতে পয়সা নেই। খাবার কেনার টাকা নেই। বাসাভাড়া দেওয়ারও কোনো উপায় নেই। এসব দেশে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের মূলত আধুনিক দাস বানিয়ে রাখা হয়েছে। ‘কাফালা’ বা স্পন্সরশিপ সিস্টেমের মাধ্যমে শ্রম ব্যবস্থাপনার বেসরকারীকরণ করা হয়েছে। এ সিস্টেমে বৈধভাবে এসব দেশে অবস্থান করতে হলে সেখানকার কোনো নাগরিকের অভিভাবকত্ব নিতে হয়। এসব অভিভাবককে ‘কফিল’ বলে। এসব কফিলের কাছে শ্রমিকের যাবতীয় কাগজপত্র থাকে। ফলে কফিলেরা তাঁদের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। মাস শেষে কফিলকে শ্রমিকদের রোজগারের একটি অংশ দিতে হয়।

ঊষর মরুভূমির দেশগুলোকে যে বিদেশি শ্রমিকেরা তাঁদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় ব্যয় করে এত দিন ধরে তিলোত্তমা করে গড়ে তুলেছেন, তাঁদের কোনো দিনই নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি বা হবে না। এই করোনাকালে কোনো কফিল শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না, উল্টো আয়রোজগার নেই জানার পরও তাঁদের কাছ থেকে প্রতি মাসের অভিভাবকত্বের বিল নিচ্ছেন।

সরকার তঁাদের পাশে নেই। নিজেদের দেশের সরকারও তাঁদের সহায়তা খুব একটা করে না। এখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হচ্ছে এসব দেশ তাঁদের বের করে দিয়ে নিজেদের ‘বোঝা’ কমাতে চাইছে। অতি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকর্মীরা দ্রুত এসব শ্রমিককে বের করে দেওয়ার আন্দোলন করছেন। সরকারগুলোরও তাতে সায় আছে বলে মনে হচ্ছে। চরম আতঙ্কে পড়েছেন বিদেশি শ্রমিকেরা। এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে শুধু অস্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ রাখার কারণে। স্থায়ী অভিবাসন থাকলে আজ এত দুর্ভোগে তঁাদের পড়তে হতো না।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
রিমা কালুশ: অভিবাসীদের অধিকারসংক্রান্ত অনলাইন পোর্টাল মাইগ্র্যান্ট–রাইটস ওআরজির সাংবাদিক