মানবিক মূল্যবোধের ওপর নির্ভরশীলতা আর কত দিন

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে জীবন বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন দেশে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার ফলে জনজীবন আজ বিপর্যস্ত এবং মানুষের জীবিকা পড়েছে ঝুঁকির মুখে। জীবন আর জীবিকার এই দ্বন্দ্বে মানুষ নাস্তানাবুদ। বৈশ্বিক অর্থনীতি, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এখন গভীর মন্দায়; এবং কত দিনে তা থেকে উত্তরণ ঘটতে পারে, তা নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের মহামন্দা বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবজাতি এ রকম সংকটে আর পড়েনি।

অর্থনৈতিক মন্দার ফলে বিভিন্ন দেশে দ্রুত বাড়ছে বেকারত্ব। কোনো কোনো দেশে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তা ইতিমধ্যেই ২০০৭-০৮ সালের বিশাল মন্দার স্তরকেও ছাড়িয়ে গেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসেই যে হার ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, এপ্রিলে তা পৌঁছে গেল ১৪ দশমিক ৭ শতাংশে এবং মে মাসে প্রায় ২০ শতাংশে।

কোনো কোনো দেশ চেষ্টা করছে বেকারত্বের বৃদ্ধি রোধ করতে। কেউ কেউ ছুটিতে পাঠিয়ে দিচ্ছে তাদের কর্মীদের। যুক্তরাজ্য লকডাউন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে যে উদ্ধার কার্যক্রম ঘোষণা করেছে, তাতে বলেছে যে বেসরকারি কোম্পানিগুলো কর্মী ছাঁটাই না করলে তাদের বেতনের ৮০ শতাংশ (মাসে ২ হাজার ৫০০ পাউন্ড পর্যন্ত) সরকার দেবে। স্বনিয়োজিতদের জন্যও এ ব্যবস্থা রয়েছে। এত কিছুর পরও বেকারত্ব বৃদ্ধি ঠেকানো যাবে কি না, সন্দেহ। ম্যাককিনজি এক প্রতিবেদনে বলছে যে দেশটিতে বেকারত্বের হার শিগগিরই ৯ শতাংশে উঠে যাবে। তবে এসব দেশে বেকারদের জন্য রয়েছে বেকারত্ব ভাতা, যাতে কিছুদিন হলেও চালিয়ে নেওয়া যায়।

বাংলাদেশে মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে চলছে লকডাউন; এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত জনজীবন এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল স্থবির। মে মাসে কিছু কিছু করে উন্মুক্ত হলেও কবে নাগাদ সবকিছু পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে, তা কেউ জানে না। অর্থনীতিতে স্থবিরতার প্রভাব কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজারের ওপর পড়েছে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের দেশে এ বিষয়ে বিশেষ কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। কারণ, এখানে নিয়মিতভাবে শ্রমশক্তি জরিপ বা কর্মসংস্থানসংক্রান্ত উপাত্ত সংগ্রহের ব্যবস্থা নেই। শেষ শ্রমশক্তি জরিপ হয়েছিল ২০১৬-১৭ সালে। এর পরের জরিপ কবে হবে, সেটা হয়তো পরিসংখ্যান ব্যুরো বলতে পারবে। অথচ অনেক উন্নয়নশীল দেশে প্রতিবছর শ্রমশক্তি জরিপ করা হয়ে থাকে। যদি ২০২০ সালে জরিপ না করা হয়, তবে এখন বেকারত্বের হার কত সে সম্পর্কে কোনো উপাত্ত আর পাওয়া যাবে না। কারণ, এ–সংক্রান্ত প্রশ্ন জরিপের আগের সপ্তাহ সম্পর্কে করা হয়।

উপাত্ত না থাকলেও কয়েকটি কথা সহজেই বলা যায়। যাঁরা দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োজিত তাঁদের অবস্থা সব সময়ই নাজুক থাকে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু না থাকলে প্রথম খড়্গ তাঁদের ওপরই পড়ে। বাংলাদেশের শ্রমবাজারের একটি বিরাট অংশ এই শ্রেণিতে, তা নির্মাণ, পরিবহন, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, যেকোনো খাতই হোক। এমনকি শিল্প খাতেও, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক ধরনের শিল্পে অনেক শ্রমিক দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োজিত থাকেন। এ ছাড়া রয়েছে স্বনিয়োজিতদের একটি বড় অংশ যাঁরা খুবই ছোট ব্যবসা করেন, তাঁদের অবস্থাও প্রায় দিন এনে দিন খাওয়ার মতো। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল, তখন এই শ্রেণির সবারই কাজ চলে যাওয়ার কথা। যদিও জরিপের সংজ্ঞা অনুযায়ী তাঁরা বেকার হিসবে চিহ্নিত হবেন কি না, সেটা ভিন্ন কথা। এই অনুমান এবং ২০১৬-১৭ সালের উপাত্তকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে আমি হিসাব করে দেখেছি যে এপ্রিল মাসে প্রায় এক কোটি শ্রমিক কর্মহীন ছিলেন। মে মাসে কিছু কিছু কর্মকাণ্ড চালু হলেও অবস্থার কতটা উন্নতি হয়েছে, সেটা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।

যে এক কোটির কথা উপরে বললাম, তার সঙ্গে যোগ করতে হবে আরও ৩০ লাখ, যাঁরা আগেই বেকার ছিলেন । আর তাতে মনে হয় যে মোট শ্রমশক্তির প্রতি পাঁচজনের একজন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে এই বিশালসংখ্যক মানুষের এবং তাঁদের পরিবারের জীবন ধারণের উপায় কী?

অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের সরকারও সহায়তার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে এবং কোনো কোনোটির বাস্তবায়নও শুরু হয়ে গেছে। তবে এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে প্রথমেই ঘোষণা এসেছিল রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য সহায়তা, যার উদ্দেশ্য সেগুলোতে নিয়োজিত শ্রমিকদের বেতনের ব্যবস্থা করা। তারপর পর্যায়ক্রমে এসেছে আরও কয়েকটি পদক্ষেপ, যাদের মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ, কৃষি ইত্যাদি বিভিন্ন খাতের জন্য এবং অন্য যাঁরা কর্মহীন তাদের জন্য সহায়তা। একেবারে যাঁরা দরিদ্র এ রকম ৫০ লাখ মানুষের জন্য দুই হাজার টাকার (পরে বাড়িয়ে আড়াই হাজার টাকার) নগদ সহায়তার ঘোষণা এসেছে ১ মে। যেটি আসা উচিত ছিল সবার প্রথমে, সেটি এসেছে প্রায় সবার পরে। টাকার অঙ্কটিও অতি সামান্য, দারিদ্র্যসীমার পারিবারিক আয়ের এক-চতুর্থাংশ (বিবিএস-এর ২০১৬ সালের খানা আয়-ব্যয়ের জরিপের ভিত্তিতে ২০২০ সালের জন্য আমার হিসাব পরিবারপিছু মাসিক প্রায় ১০ হাজার টাকা)। প্রতি সুবিধাভোগীর জন্য চারজন ধরা হলে এই সহায়তার অধীনে আসবেন দুই কোটি মানুষ, যা মোট দরিদ্রদের প্রায় ৬০ শতাংশ।

অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে এবং অন্যান্যদের কাছ থেকে সমাজের অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান এসেছে সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে আসার জন্য। কিন্তু ডাকের অপেক্ষায় না থেকে সমাজ আগেই এগিয়ে এসেছে যার যেমন সামর্থ্য তাই নিয়ে। প্রতিষ্ঠিত এনজিও, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগ সারা দেশের দুস্থদের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।

আর সে প্রসঙ্গেই মনে পড়ছে ১৯৯৭-৯৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের কথা, যাতে পূর্ব এবং দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশ, বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। উচ্চপ্রবৃদ্ধির জোয়ারে ভাসতে থাকা এসব দেশ পড়ে গিয়েছিল গভীর মন্দায়; আর তার ফলে বেকার হয়ে গিয়েছিল কোটি কোটি শ্রমিক। উচ্চপ্রবৃদ্ধিতে পরিতৃপ্ত এ দেশগুলোতে সে সময় সামাজিক সুরক্ষা বলতে বিশেষ কিছু ছিল না বলে দারিদ্র্যের হার আবার বেড়ে যায়। অনেক শ্রমিক শহর ছেড়ে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ছেড়ে আসা পরিবারের সহায়তায় জীবন ধারণ করেন। আর তখনই সে দেশগুলোতে ‘এশীয় মূল্যবোধ’ কথাটি চালু হয়েছিল। সে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অবশ্য সেই দেশগুলোর কিছুটা হলেও বোধোদয় হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে তারা যথাযথ সামাজিক সুরক্ষার লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ নেয়।

আমাদের দেশে সামাজিক সুরক্ষা বা নিরাপত্তা জালের কথা বলতে গেলে অবশ্য দেখা যাবে যে সরকারের ১০০–র বেশি কর্মসূচি রয়েছে। যদিও এদের মধ্যে কোনো বেকারত্ব ভাতা নেই। বয়স্কদের ও বিধবাদের জন্য ভাতা থেকে শুরু করে কী নেই তার মধ্যে! কেমন তাদের প্রকার? বয়স্ক ভাতার কথা ধরুন। ভাতার পরিমাণ মাসে ৫০০ টাকা, যা একজন অদক্ষ শ্রমিকের এক দিনের মজুরির চেয়েও কম। অবশ্য সুবিধাভোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে ২০১৮-১৯ সালের বাজেটে ৪০ লাখে উন্নীত করা হয়েছিল। কিন্তু সেটাও ৬৫ বছর বয়সের বেশি বয়স্ক মানুষের মাত্র ৪০ শতাংশ।

দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে রয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি, যেগুলো মূলত গণপূর্ত কর্মসূচি। অতিদরিদ্রদের জন্যও রয়েছে একটি। সরকারি উপাত্ত থেকে দেখলাম, ২০১৭-১৮ সালে এর মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৫১ জনের জন্য। আর কর্মমাসের সংখ্যা দেখলে আন্দাজ করা যায় যে গড়ে তাঁরা বছরে এক মাস কাজ পেয়েছিলেন। বিবিএসের খানা জরিপের তথ্য থেকে হিসাব করলে বলা যায় যে দেশে অতিদরিদ্র পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। এই দুটি সংখ্যা তুলনা করলে এবং যদি ধরে নিই যে পরিবারপিছু একজন এ কর্মসূচিতে কাজ করছেন, তাহলে বলা যায় যে অতিদরিদ্রদের প্রায় এক–চতুর্থাংশ এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন। অবশ্য এ ছাড়া রয়েছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) এবং কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) কর্মসূচি। তবে আমার হিসাবে অতিদরিদ্রদের অর্ধেকের কম (প্রায় ৪৫ শতাংশ) এসব কর্মসূচির আওতায় আছে।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা বলা যেতে পারে। পূর্ব এবং দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার যে দেশগুলোর কথা একটু আগে বলেছি, তারা দারিদ্র্য হ্রাসেও সফলতা অর্জন করায় গণপূর্ত কর্মসূচির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৭-৯৮ সালের অর্থনৈতিক দুর্যোগের সময় তাদের প্রয়োজনীয়তা দেখে সাময়িকভাবে হলেও আবার সেগুলোতে ফিরে গিয়েছিল; আর তার মূল কারণ ছিল এই যে কাজ হারানো শ্রমিকদের জন্য কোনো সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতেও এ ধরনের কর্মসংস্থান কর্মসূচির জাল আরও বড় আকারে বিস্তার করা উচিত বলে মনে হয়। ভারতে ২০০৫ সালে আইনের মাধ্যমে এ ধরনের একটি সর্বজনীন কর্মসূচি চালু করা হয়েছে যার মাধ্যমে বেকারত্ব ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। সে ধরনের কিছুও ভাবা যেতে পারে।

সামাজিক সুরক্ষা প্রসঙ্গে কেউ কেউ বলেন, আমাদের মতো দেশের জন্য এটি একটি বিলাসিতা। কারণ, এই সুরক্ষা দেওয়ার সক্ষমতা আমাদের নেই। আবার কেউ কেউ বিষয়টিকে দান-খয়রাতের সঙ্গে সমর্থক মনে করেন। তবে এসব কথা এখন কাটা রেকর্ডের মতো শোনায়। কারণ, আমাদের মাথাপিছু বার্ষিক আয় (সত্তরের দশকের) ১০০ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছে এবং আমাদের লক্ষ্য আগামী ১০ বছরে ৪ হাজার ডলারের ওপরে ওঠা। যা উচ্চমধ্যম আয়ের শ্রেণির ন্যূনতম সীমা। গড় আয়ে মধ্যবিত্ত হয়েও দরিদ্রের মতো ব্যবহার মানানসই নয়।

আমার মনে হয় যে আমরা এখন একটি বড় প্রশ্নের মুখোমুখি: শুধু জিডিপি বৃদ্ধির হারের কথাই ভাবতে থাকব এবং কোনো সংকট এলে মানবিক মূল্যবোধের ওপর নির্ভর করব; নাকি সাধারণ মানুষের জীবনমানের দিকেও নজর দেব এবং প্রবৃদ্ধির সুফল কীভাবে সবার মধ্যে ভালোভাবে ভাগ করা যায় সে চেষ্টা করব? বিষয়টি আসলে অগ্রাধিকার নির্ণয়ের। অগ্রাধিকার ঠিক হলে কত অর্থের প্রয়োজন, তা হিসাব করা যাবে এবং পন্থা বের করার চেষ্টা করা যেতে পারে।

রিজওয়ানুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (জেনেভা) কর্মসংস্থান খাতের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা।