স্পিকার, ড. মিজানের কমিশন ওলিমন

র‌্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমনের বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের বিস্ময়কর মধ্যস্থতার সূত্রে যা জানলাম তা কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোনোর শামিল। হঠাৎ ড. মিজানের পদত্যাগ দাবি বিএনপির চটক। কমিশন গঠনের বাছাই কমিটিতে শহীদ উদ্দীন চৌধুরী অংশ নিতে অপারগ থাকেন। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বাছাই কমিটির আইনবহির্ভূত বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপি এমনকি মানবাধিকার সংগঠনগুলোও প্রশ্ন তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং আইন ও সালিশ কেন্দ্র ড. মিজানের পুনর্নিয়োগ চেয়ে বিবৃতি দিয়েছিল।
ড. মিজান কমিশন সাত সদস্যের। এর মধ্যে দুজন স্থায়ী সদস্য। বাকি পাঁচজন অবৈতনিক। ড. মিজান ও কাজী রিয়াজুল হক স্থায়ী। তাঁরা পদমর্যাদায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারক। বেতন-ভাতাও তেমনই। অন্য পাঁচজন—অধ্যাপক নিরু কুমার চাকমা, সেলিনা হোসেন, ফওজিয়া করিম, এ্যারোমা দত্ত ও নিরুপা দেওয়ান। ২২ জুন তাঁদের তিন বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রেক্ষাপটে ড. মিজান তাঁর বিতর্কিত মধ্যস্থতা প্রস্তাবটি দেন।
২৬ জুন রাতে কথা বলি সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমরা জানি না। এটা তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।’ আরও জানালেন, ‘তাঁকে আগেও আমরা বলেছি, আপনি যখন বক্তব্য দেবেন তখন কোনটা কমিশনের আর কোনটি ব্যক্তিগত, তাতে একটু ফারাক রাখবেন।’
কাজী রিয়াজুলের সঙ্গে ২৬ ও ২৭ জুন কথা বলি। তিনিও অবগত নন। এবং তাঁরা মানেন যে আইনে এ ক্ষেত্রে মধ্যস্থতার সুযোগ অনুপস্থিত। তবে মানতেই হবে, মামুর জোর না থাকা তরুণ লিমনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতা গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত। এর সংবেদনশীলতা ও গুরুত্ব আইনের অধ্যাপক মিজান বিলক্ষণ জানেন। আগে সাহসী বক্তব্য রেখেছেন। আদালত ও হাসপাতালে তাঁকে লিমনের পাশেই দেখেছি। ব্যাগ্রভরে জানতে চাইলাম, মামলা প্রত্যাহারের চিঠি প্রদানের আগে কমিশন কী করেছে। তারা কোনো তদন্ত করেনি। এবং তা শুধু লিমনের ক্ষেত্রে নয়, গত সাড়ে চার বছরে পুলিশ ও র‌্যাবের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি ঘটনারও তারা তদন্ত করেনি। রিয়াজুল হককে বললাম, বলেন কী? এটা কী করে সম্ভব? এই রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যরাই তো মানবাধিকারের বড় লঙ্ঘনকারী। নিশ্চয় সরকারি তদন্তের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তাতে আমাদের আস্থা নেই। স্বাধীন মানবাধিকার কমিশনের ধারণা এ কারণেই যে তারা সরকারের মুখাপেক্ষী হবে না। উত্তরে কাজী রিয়াজুল বললেন, ‘আইন তাঁদের হাত-পা বেঁধে দিয়েছে।’ আইনের ১৮ ধারা বলেছে, ‘শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের ক্ষেত্রে কমিশন নিজ উদ্যোগে বা কোনো দরখাস্তের ভিত্তিতে সরকারের কাছে প্রতিবেদন চাইতে পারবে।’ তাঁরা এর ব্যাখ্যা করেছেন, এর ফলে তাঁরা পুলিশ-র‌্যাবের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে পারেন না।

তাঁর ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারিনি। কারণ, দীর্ঘদিন আমরা জেনেছি, কমিশনের লোকবল নেই। তাই তারা তদন্ত করতে পারছে না। এখন সাত কমিশনার ছাড়াও লোকবল ২৮ জন। দুই কোটি ৪০ লাখ টাকার বার্ষিক বাজেট বেড়ে এবারে তিন কোটি ৪০ লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে। ৩৫ জন মানুষ যদি গত সাড়ে চার বছরে আট কোটি টাকা খরচ করে তাহলে গড় মাথাপিছু ব্যয় পড়ে ২২ লাখ টাকার বেশি। তাহলে নিজেরা তদন্ত না করে সরকারকে তদন্ত করতে প্রতিটি ‘অনুরোধ’ জানানোর খরচ দাঁড়ায় সাত লাখ টাকার বেশি। তাই প্রশ্ন, কেবল সরকারের কাছে প্রতিবেদন চাওয়ার জন্য আমাদের তথাকথিত স্বাধীন কমিশন রাখার দরকার কী? আইন বলেছে, প্রতিবেদন পেয়ে কমিশন যদি ‘সন্তুষ্ট’ হয়, তাহলে সেখানেই খেল খতম। না হলে সরকারকে তার ‘করণীয়’ জানাবে। এ পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দু-চারটে ঘটনায় সরকারি প্রতিবেদন সেনাসদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। কিন্তু তাতে তাদের কার কী এসে গেছে, তা কমিশনের জানা নেই। 

জানতে চাইলাম লিমনের ব্যাপারে কবে প্রতিবেদন চাইলেন? সন্তুষ্ট হয়েছেন কি? বললেন, লিমনের বিষয়ে তো চাইতেই পারিনি। এখানেও তো আমাদের হাত-পা বাঁধা। বললাম, এইমাত্র বললেন তদন্ত করতে হাত-পা বাঁধা। কিন্তু প্রতিবেদন চাইতে তো মানা নেই। উত্তরে তিনি আইনের ১২ ধারার ২ উপধারার ক দফা দেখান। এই বিধান বলেছে, ‘আদালতে বিচারাধীন মামলার কোনো বিষয়ে’ কমিশনের কার্যাবলি বা দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হবে না। লিমনের বিষয়ে মামলা হয়েছিল যে। তাই তাদের কিছু করার নেই। 

লিমনের প্রতি ড. মিজানের উথালপাতাল দরদ থাকলেও তিনি কী করবেন, তাঁর হাত যে আইনে বাঁধা। আইন যদি আইনের লোককে বাঁধাছাদা করে তাহলে কার কী করার থাকে। কিন্তু রহস্য হলো, মামলা বিচারাধীন থাকতে এবার কী করে কমিশন মধ্যস্থতার কথা মুখে আনতে পারল। তাই লিমন ও তাঁর মাকে কমিশনে এ জন্য ডাকাডাকি করা এখতিয়ারবহির্ভূত এবং মার্জনার অযোগ্য। আইনে মধ্যস্থতাসংক্রান্ত যেসব বিধান রয়েছে, তা লিমনের ক্ষেত্রে একদম প্রযোজ্য নয়। আইনের অপব্যাখ্যা করেছেন মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি। আইনের ১২ ধারার উপদফা বলেছে, ‘কোনো অভিযোগের ওপর তদন্ত ও অনুসন্ধান করে মধ্যস্থতা ও সমঝোতার মাধ্যমে অভিযোগ নিষ্পত্তি করা যাবে।’ অথচ লিমনের বিষয়ে কমিশন তদন্ত কিংবা অনুসন্ধান না করেই মধ্যস্থতা করতে চাইছে। তাঁর দাবি, মধ্যস্থতার অধিকার কমিশনের আছে এবং সেটা করতে পারা হবে তাদের সাফল্য।

এখন আমরা দেখব কী প্রক্রিয়ায় ড. মিজানের সাত সদস্যের কমিশনটি পুনর্গঠিত হলো। আইনে আছে, ‘রাষ্ট্রপতি বাছাই কমিটির সুপারিশক্রমে কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ দেবেন।’ সাত সদস্যের কমিশন গঠনে সাত সদস্যের বাছাই কমিটি। স্পিকার এর প্রধান। অন্যূন চার সদস্যে কোরাম হয়। আর সাতজনের মধ্যে চারজন হলেন সরকারের খাস লোক—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সরকারদলীয় একজন সাংসদ। অন্যরা হলেন স্পিকার, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় একজন সাংসদ। দুই সাংসদকে মনোনয়ন দেন স্পিকার।

 ড. মিজান আরও তিন বছর মেয়াদে নিয়োগ পেলেন। আইনে আছে, বাছাই কমিটি প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুটি করে নাম সুপারিশ করবে। তাহলে সাত সদস্যের কমিশন গঠনের জন্য আমাদের ১৪টি নাম জানার কথা। কিন্তু বাছাই কমিটির সদস্য বললেন, আইনে দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগের সুযোগ আছে, তাই আমরা এবার কেবল একটি শূন্য পদের বিপরীতে দুটি নাম পাঠাই। বাকি ছয়জনই আগের কমিটির। ড. নিরুমা এক-এগারোর কমিটিতেও ছিলেন। তাই তিনি বাদ পড়লেন। ছয়টি আধা সাংবিধানিক পদে ‘পাইকারি’ নবায়ন ঘটল। আর শূন্য একটি পদে নিয়োগ পেলেন ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহফুজা খানম, যিনি আইনমন্ত্রীর স্ত্রী।

 দুটি করে নাম না পাঠানোর ফলে আইনের ৬(১) এবং ৭(৪) ধারা লঙ্ঘিত হয়েছে। আইনে কোনো সদস্যকে চুক্তিভিত্তিক বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়োগ নবায়নের সুযোগ রাখেনি। প্রতিটি শূন্য পদে নতুন নিয়োগ। প্রতিটি নিয়োগে রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টই চূড়ান্ত, স্পিকার তাতে ভাগ বসাতে পারবেন না। কিন্তু স্পিকার ভাগ বসিয়েছেন। তিনি ড. মিজানসহ ছয়জনের জন্য একটি করে নাম পাঠিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টি স্পিকারের সন্তুষ্টিতে পরিণত হয়েছে। সন্দেহাতীতভাবে আইনের লঙ্ঘন ঘটেছে। দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য কারও নাম সুপারিশ করা বাছাই কমিটির এখতিয়ারমাত্র। তেমন সুপারিশ করলেই রাষ্ট্রপতি তা মানতে বাধ্য নন। আর এখানে তো দুটি নাম সুপারিশই করা হয়নি। তাই বর্তমান কমিশনের বৈধতা নেই।

 আইনের ৭(৪) ধারা বলেছে, ‘বাছাই কমিটি, চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ নিয়োগে সুপারিশ প্রদানের উদ্দেশ্যে সভায় উপস্থিত সদস্যগণের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুজন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে।’ আইনে এটা বলা নেই যে কারও পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে এই বিধান মানতে হবে না। এই কমিশনের বৈধতা রিটে চ্যালেঞ্জযোগ্য। কারণ, তা যথাযথভাবে গঠিত নয়।

সেলিনা হোসেনের কাছে ফোন করি। আপনি কি দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ চেয়েছিলেন? বললেন, না। ২২ জুন মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। ১৮ জুন মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাই। তাতে পুনর্নিয়োগের খবর জানলাম।

ড. মিজান ও তাঁর পুরো কমিশন এখন বলতে পারে, আমরা কী জানি। এটা তো স্পিকারের বাছাই কমিটি জানবে। আমরা সে কারণেই সংসদে এর ওপর একটা আলোচনা চাই। বিএনপির উচিত অশালীন বক্তব্য পরিহার করে কমিশন গঠন প্রশ্ন সংসদে তোলা। আমরা তখন হয়তো স্পিকারের একটি রুলিংও পেতে পারি। নিজেদের ভুল হলে শুধরে নিতে পারবেন।

 ড. মিজানের অনেক সুবচন আমাদের অনুপ্রাণিতও করেছে। ১ জুলাই নতুন কমিশনের বৈঠক। আইনের ৬ ধারায় দেখলাম, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে আদালতে বিচারাধীন কোনো মামলায় বা আইনগত কার্যধারার পক্ষ হইয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিবার অধিকার কমিশনের থাকিবে।’ সামরিক আমলাতন্ত্রের রক্তচক্ষুর বিরুদ্ধে নির্ভীক হোন। লিমনের মামলায় পক্ষ নিন। চেয়ারম্যানকে বাদ দিয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে এই সিদ্ধান্ত হতে পারে। দ্বিতীয় মেয়াদে ছয়জনের নতুন করে নিয়োগের সঙ্গে ‘র‌্যাববিদ্ধ’ লিমন যে ঘুঁটি হিসেবে (প্রতীয়মান হওয়া অর্থে) ব্যবহূত হননি, তা প্রমাণের দ্বার অবারিত। আমরা কমিশনের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রইলাম।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।