ভূমধ্যসাগরে তুরস্কবিরোধী জোটের বিপদ

সমালোচকরা বলছেন লিবিয়ার প্রায় এক দশকের গৃহযুদ্ধের আসল লক্ষ্য লিবিয়া এবং ভূমধ্যসাগরের তেল-গ্যাস। ছবি: রয়টার্স
সমালোচকরা বলছেন লিবিয়ার প্রায় এক দশকের গৃহযুদ্ধের আসল লক্ষ্য লিবিয়া এবং ভূমধ্যসাগরের তেল-গ্যাস। ছবি: রয়টার্স

ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত তুরস্কবিরোধী জোটের প্রত্যক্ষ আত্মপ্রকাশ হয়েছে গত ১১ মে। মিসর, ফ্রান্স, আরব আমিরাত, গ্রিস, গ্রিক সাইপ্রাস নতুন এই জোটের সদস্য। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে লিবিয়া এবং ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের সব কার্যক্রমকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে নতুন এই জোট। বিজ্ঞপ্তিতে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ত্রিপলির জাতীয় ঐকমত্যের সরকার ও তুরস্কের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমুদ্র চুক্তিকেও অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন এই জোটের আগে পূর্ব লিবিয়ার কিছু অঞ্চল নিয়ন্ত্রণকারী যুদ্ধবাজ নেতা হিসেবে পরিচিত খলিফা হাফতারও এই চুক্তিকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন।

ত্রিপলির জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের সঙ্গে তুরস্কের স্বাক্ষরিত এই চুক্তি ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোর ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির পথ বন্ধ করে দিয়েছে। তাই পশ্চিমা দেশগুলো লিবিয়ায় হাফতারকে ক্ষমতায় বসিয়ে এই চুক্তি বাতিল করে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের তেল-গ্যাস ইউরোপে নিতে চায়। সমালোচকেরা বলছেন, লিবিয়ার প্রায় এক দশকের গৃহযুদ্ধের আসল লক্ষ্য লিবিয়া ও ভূমধ্যসাগরের তেল-গ্যাস। পূর্ব ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশ না হওয়া সত্ত্বেও আরব আমিরাত ও ফ্রান্স এই জোটভুক্ত হয়েছে।
নতুন এই জোটের প্রধান কারিগরেরা মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। প্রকাশ্যে রয়েছে ফ্রান্স ও মিসর এবং পর্দার আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ছে সৌদি আরব। সিসির নেতৃত্বে মুরসি সরকারের উৎখাতের সাত বছর পেরিয়ে গেলেও আঙ্কারা-কায়রো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি। জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের সব দেশ সিসিকে লালগালিচা সংবর্ধনা দিলেও আঙ্কারা সিসির অবৈধতা নিয়ে সব সময় সোচ্চার ছিল এবং সিসিকে স্বৈরাচার হিসেবে সব আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরেছে।
আরব দুনিয়ায় তুরস্ক-কাতার বলয়ের বিপক্ষ শক্তিকে এক করে সিরিয়া ও লিবিয়ায় তুরস্কের বিরুদ্ধে যৌথ সামরিক শক্তি গড়ে তুলেছে কায়রো। কায়রোর মধ্যস্থতায় হাফতার ও আসাদ তুরস্ক-কাতার বলয়কে মোকাবিলার জন্য বেনগাজি ও দামেস্কে অফিস খুলেছেন। ইরানের সহযোগিতায় আসাদ সৈন্য পাঠিয়েছেন হাফতারকে রক্ষার জন্য। সৌদি-ইরানের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করলেও লিবিয়ায় দুই দেশ সম্মিলিত হয়েছে হাফতারকে রক্ষার জন্য।
লিবিয়ার যুদ্ধে আঙ্কারা-দোহার সামরিকসংশ্লিষ্টতা লিবিয়ায় ফরাসি কোম্পানিগুলোর, বিশেষ করে টোটালের বিরাট আর্থিক ক্ষতি করেছে। অর্থনৈতিক ক্ষতি ও ঔপনিবেশিক প্রভাব ফিরে পেতেই আফ্রিকায় ফরাসিরা যুদ্ধে নেমেছে চীন ও তুরস্কের বিরুদ্ধে। ভূ-অর্থনীতির এই মারপ্যাঁচ ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশ না হওয়া সত্ত্বেও আরব আমিরাত ও ফ্রান্সকে জোটভুক্ত করেছে এবং সৌদি ইরানকে মিত্র করেছে লিবিয়ায়।
মিসর ও ফ্রান্সের নেতৃত্বে এই জোট গঠনের পেছনে রয়েছে ইউরোপের আগামী দিনের জ্বালানিনিরাপত্তার ও আরবদের আঞ্চলিক রাজনীতির হিসাব। আগ্রহী পাঠকেরা হয়তো ইউরোপের এই হিসাব-নিকাশের মধ্যেই আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের মৃত্যু এবং জার্মানিসহ পশ্চিমের নানান দেশে সিসির লালগালিচা অভ্যর্থনার কারণ খুঁজে পেতে পারেন।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক সংস্থা (ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে) ইউএস পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ব্যারেল তেল এবং প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন কিউবিক মিটার প্রাকৃতিক গ্যাস মজুতের কথা বলছে। তুরস্কের অধীনে থাকা অঞ্চল, যা এই জরিপের অন্তর্ভুক্ত নয়, সেখানে সমপরিমাণ তেল-গ্যাস মজুত রয়েছে বলে মনে করা হয়। পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো পূর্ব ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলো; গ্রিস, মিসর, লেবানন ও গ্রিক সাইপ্রাসকে প্রযুক্তিগত সাহায্য প্রদান করে ভূমধ্যসাগরে অর্ধশতাধিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। যার মধ্যে শুধু মিসরেই ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৪৩টি তেল ও ১৮টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে।
ইসরায়েল ও লেবাননের সমুদ্র উপকূলেও আবিষ্কৃত হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র। গ্রিস ও গ্রিক সাইপ্রাসে ইতালির এনি এবং মার্কিনি এক্সন মবিল এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের গ্যাস খুঁজে পেয়েছে। অনুমান করা হয়, প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের তেল-গ্যাস মজুত রয়েছে গ্রিস ও গ্রিক সাইপ্রাসের অধীনে। এনি, এক্সন মবিলসহ অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এই গ্যাস ইউরোপে আমদানি করতে চায়। ইউরোপের বর্তমান জ্বালানির মোট চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ সরবরাহ করে রাশিয়া। তাই রাশিয়ার ওপর জ্বালানিনির্ভরতা হ্রাসে এই গ্যাসে সীমাহীন আগ্রহ ইউরোপের। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইউরোপের জ্বালানিনির্ভরতা নিশ্চিত করতেই ভূমধ্যসাগরে তুরস্কবিরোধী এই নতুন জোটের পত্তন হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের জোটবদ্ধ রাজনীতি নতুন কিছু নয় এবং যার প্রধান নিয়ামক ভয়ের সংস্কৃতি। ভয়ের সংস্কৃতি তৈরিতে মার্কিনদের জুড়ি নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কমিউনিজম, ৯/১১-এর পর ইসলাম এবং এখন করোনা মহামারি নিয়ে চীন-ভীতি ও বিদ্বেষ তৈরি করেছে মার্কিনরা। এভাবে ভীতি ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে, গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের নামে মার্কিনরা পৃথিবীর নানা প্রান্তের প্রাকৃতিক সম্পদ দখলের দুর্বৃত্তায়ন জারি রেখেছে। মোটাদাগে মধ্যপ্রাচ্যে এই ভয়ের রাজনীতি শুরু হয়েছিল ইরানি বিপ্লবের পর। ইরান-ভীতি ছড়িয়ে শিয়া ও সুন্নিতে আরবদের বিভক্ত করে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্ররোচিত করেছিল। সাদ্দাম হোসেনের চাপিয়ে দেওয়া আট বছরব্যাপী যুদ্ধ তথাকথিত শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বকে যে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষত দিয়েছিল, তা থেকে আরব বিশ্ব এখন পর্যন্ত বের হতে পারেনি।
ইরানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের মধ্যেই পশ্চিমা গণমাধ্যম এবং এস্টাব্লিশমেন্ট নতুন সাদ্দাম-ভীতি ও বিদ্বেষ তৈরি করেছিল। সাদ্দাম-ভীতি ছড়িয়ে আরব দেশগুলোকে নিরাপত্তা দেওয়ার নামে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের সামরিক চুক্তি করেছিল মার্কিনরা এবং সৌদি, কুয়েতসহ নানান দেশে মার্কিন স্থায়ী সেনাচৌকি স্থাপন করা হয়। আর ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই ইউরোপে তুর্কি-ভীতি ও বিদ্বেষ বিদ্যমান। তবে পুরোনো তুর্কি বিদ্বেষকে নতুন করে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে, যার ব্যবহার ব্রেক্সিট, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও ইউরোপের বহু দেশের নির্বাচন ও জনপরিসরে হরহামেশাই দেখা যায়।
তথাকথিত ‘আরব বসন্তের’ পর ইরান-ভীতির মতো করেই আরব বিশ্বে তুর্কি-ভীতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। একে ব্যবহার করে রাজনৈতিকভাবে আসাদ, হাফতার আর সিসির সব সন্ত্রাসের বৈধতা দেওয়া হয়েছে। আর অর্থনৈতিকভাবে তুর্কি-ভীতি ব্যবহার করে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী সব দেশকে এনি, এক্সন মবিলসহ নানান বহুজাতিক কোম্পানির হাতে নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদ তুলে দিতে বাধ্য করা হয়েছে। তুর্কিদের, বিশেষ করে এরদোয়ানের ব্যক্তিগত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক উচ্চবিলাস পশ্চিমাদের তুর্কি-ভীতি ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে।
ভয়ের সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করে মার্কিনদের তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনবরত যুদ্ধযাত্রা প্রচলিত যুদ্ধের ব্যাকরণকে বদল করে দিয়েছে। যুদ্ধযাত্রা এখন ভূরাজনৈতিক স্বার্থ থেকে ভূ-অর্থনৈতিক স্বার্থে রূপান্তরিত হয়েছে। সেই হিসেবে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের সমাধান রয়েছে ভূমধ্যসাগরের তেল-গ্যাসের মধ্যে, লিবিয়ার মানুষের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা নয়। আপাতদৃষ্টিতে ত্রিপলির জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের পতন এবং তুরস্কের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমুদ্র চুক্তি বাতিলের মধ্যেই লিবিয়ার যুদ্ধের সমাপ্তি নিহিত।
সময় হিসেবেও এই নতুন জোটের আবির্ভাব গুরুত্বপূর্ণ। যখন নতুন এই জোটের ঘোষণা এল, তখন ইসরায়েল পশ্চিম তীর দখল করার পরিকল্পনা করেছে। যার দরুন ভূমিচ্যুত হবে প্রায় ১০ লাখ ফিলিস্তিনি। আরবরা যখন ইরান, তুরস্ক ও ভূমধ্যসাগরে প্রভাব বিস্তার নিয়ে মগ্ন থাকবে, তখন ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি থেকে উৎখাত করবে, ভূমিহীন হবে লাখো মানুষ।

রাহুল আনজুম: গবেষক