সেই রামশীল, নিখিলের মৃত্যু ও ৫ লাখ টাকার 'ব্যর্থ সমঝোতা'

নিহত  নিখিল তালুকদার।
নিহত নিখিল তালুকদার।

সেই রামশীল আবার পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার সংখ্যালঘু–অধ্যুষিত ইউনিয়ন। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর দেশের বিভিন্ন স্থান, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হলে তাদের অনেকে রামশীলে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। রামশীল তখন বিশ্ব গণমাধ্যমেও জায়গা করে নিয়েছিল। সংখ্যালঘুরা রামশীলকে নিরাপদ ভেবেছিল। এবার সেই রামশীল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন মানুষ নিখিল তালুকদার (৩২) পুলিশের নির্যাতনে মারা গেছেন বলে অভিযোগ আছে। তিনি পেশায় একজন কৃষক ছিলেন।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার রামশীল বাজারের কাছে সেতুর পাশে নিখিল তিন সহযোগীকে নিয়ে তাস খেলছিলেন। খবর পেয়ে কোটালীপাড়া থানার এএসআই শামীম উদ্দিন দুই যুবকসহ সেখানে যান এবং মোবাইলে তাঁদের ছবি তোলেন। ঘটনা টের পেয়ে চারজন সেখান থেকে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। অপর তিনজন পালিয়ে যেতে পারলেও নিখিলকে ধরে ফেলেন এএসআই। এরপর তাঁর ওপর নির্মম নির্যাতন করা হয় এবং এতে তাঁর মেরুদণ্ডের তিনটি হাড় ভেঙে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় নিখিলকে প্রথমে বরিশালের শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বুধবার বিকেলে তিনি মারা যান।

নিখিল তালুকদারের স্ত্রী ইতি তালুকদার অভিযোগ করেছেন, ‘আমার স্বামীকে এএসআই শামীম ধরে মারধর করেন। একপর্যায়ে হাঁটু দিয়ে পিঠে আঘাত করা হয়। এতে আমার স্বামীর মেরুদণ্ডের তিনটি হাড় ভেঙে যায়।’ (সমকাল, ৭ জুন ২০২০)

এই অভিযোগের জবাব দেননি এএসআই শামীম। তিনি বলেছেন, ওসি স্যার সব জানেন। ওসি স্যার মানে কোটালীপাড়া থানার ওসি শেখ লুৎফর রহমান। তিনি অদ্ভুত এক তত্ত্ব হাজির করেছেন। তাঁর দাবি নিখিলকে পুলিশ মারধর করেনি। তিনি দৌড়ে পালানোর সময় গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়ে কোমরে ব্যথা পেয়েছেন।

কিন্তু সংবাদমাধ্যমে আরও খবর এসেছে, নিখিল মারা যাওয়ার পর শনিবার কোটালীপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে সমঝোতা বৈঠক হয়, যাতে উপস্থিতি ছিলেন কোটালীপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান বিমল কৃষ্ণ বিশ্বাস, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান, সাবেক পৌর মেয়র এইচ এম অহিদুল ইসলাম, রামশীল ইউপি চেয়ারম্যান খোকন বালা, কোটালীপাড়া থানার ওসি শেখ লুৎফর রহমান প্রমুখ। বৈঠকে আপস–মীমাংসায় নিখিলের পরিবারকে নগদ দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে আরও তিন লাখ টাকা দেওয়া এবং নিখিলের স্ত্রী ও ছোট ভাইকে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়।

নিখিলের ছোট ভাই শঙ্কর তালুকদার বলেছেন, ‘পরিবারের কথা ভেবে ও পরিবারের সবাই ভালো থাকতে পারে, সে জন্য মীমাংসায় সম্মত হয়েছি। দুই লাখ টাকা দিয়েছে। বাকি তিন লাখ টাকা পাঁচ–ছয় দিনের মধ্যে দেবে। পরিবারের দুজনকে চাকরি দেওয়ার কথা বলেছে।’

বৈঠকে উপস্থিত রামশীল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান খোকন বালাও স্বীকার করেছেন, পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে পুরো ঘটনা মিটিয়ে ফেলা হয়েছে। নিখিলের স্মরণে আয়োজিত শোকসভায় ওসি উপস্থিত ছিলেন।

কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। গত রোববার রাতে এএসআই শামীমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে শনিবার তাঁকে কোটালীপাড়া থানা থেকে প্রত্যাহার করে গোপালগঞ্জ জেলা পুলিশ দপ্তরে ক্লোজড করা হয়েছিল। অভিযানে শামীমের সহযোগী রেজাউল ইসলামও গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই তথ্য দিয়েছেন কোটালীপাড়ার ওসি লুৎফর রহমান। (ডেইলি স্টার, ৮ জুন ২০২০)

অথচ এর আগে তিনি দাবি করেছিলেন পুলিশ নিখিলকে মারধর করেনি। গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গিয়ে কোমরে ব্যথা পেয়েছেন। ওসির ভাষ্য অনুযায়ী পুলিশ যদি নিখিলকে পিটিয়ে না থাকে, তাহলে তাঁর মেরুদণ্ডের তিনটি হাড় ভাঙল কীভাবে? পালানোর সময় গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে কারও মেরুদণ্ডের হাড় ভাঙতে পারে—এটা অবিশ্বাস্য। মেরুদণ্ড মানুষের সামনে থাকে না, পেছনে থাকে। একজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করেছেন, ‘নিখিলের মেরুদণ্ড ছিল বলেই হাড় ভেঙেছে। আমাদের অনেকের মেরুদণ্ডই নেই।’

নিখিলের স্ত্রীর অভিযোগ, তাঁর স্বামীর পিঠে হাঁটু দিয়ে আঘাত করা হয়েছ এবং এতে তাঁর পিঠের তিনটি হাড় ভেঙে গেছে। তাঁর এই অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের মেনিয়াপোলিস শহরে পুলিশের হাতে নিহত জর্জ ফ্লয়েডের কথা মনে করিয়ে দেয়। ডেরেক শোভিন নামের এক বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যা করেছেন হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে। আগে জানতাম পুলিশের লাঠিতে জোর। এখন দেখা যাচ্ছে, লাঠির দরকার নেই। হাঁটুই লাঠির কাজ করে দিচ্ছে।

নিখিলের মৃত্যুর ঘটনায় ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানানোর পর অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হলেন। তাঁরা বলেছেন, নিখিলের মেরুদণ্ডে মারাত্মক আঘাতজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে, যা হত্যাকাণ্ড।

এই ঘটনায় গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আসলাম খানকে প্রধান করে শুক্রবার তিন সদস্যের বিভাগীয় কমিশন গঠন করেছেন। আসলাম খানকে সাংবাদিকেরা সমঝোতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, কে কোথায় সমঝোতা করেছে, সেটি তাঁদের দেখার বিষয় নয়। তাঁরা তদন্ত করে দেখবেন নিখিলের মৃত্যুর ঘটনার কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না। অপরাধ সংঘটিত হলে আইনানুযায়ী বিচার হবে।

আমরাও আশা করতে চাই, তদন্ত কমিটির প্রধানের কথা ও কাজে মিল থাকবে। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্তের দায়িত্ব যখন পুলিশকে দেওয়া হয়, তখন এর পরিণতি নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় তদন্ত সুষ্ঠু হয় না। অপরাধীকে আড়াল করার চেষ্টা চলে। নিখিলের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে সেটি যেন না হয়।

নিখিলের মৃত্যুর খবরটি নিয়ে যখন নানা মহলে আলোচনা হচ্ছে, তখনই আরেকটি পিলে চমকানো খবর দিয়েছে ডেইলি স্টার। আইজিপি বেনজীর আহমেদ বরাবর ঢাকার পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম একটি চিঠি তাঁরই দপ্তরের একজন যুগ্ম কমিশনারকে অবিলম্বে বদলি করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। ডিএমপির প্রধান যুগ্ম কমিশনার (লজিস্টিক) মোহাম্মদ ইমাম হোসেনকে অবিলম্বে অন্যত্র বদলি করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি নাকি কেনাকাটা থেকে কমিশনারকে ভাগ (পার্সেন্টেজ) নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। (ডেইলি স্টার, ৭ জুন, ২০২০)

ডিএমপি কমিশনার যদি মনে করেন, তাঁর যুগ্ম কমিশনার দুর্নীতিবাজ তাহলে তো বদলি সমাধান হতে পারে না। তাঁর অভিযোগ সত্য হলে ওই যুগ্ম কমিশনারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

কোটালীপাড়ার এএসআই শামীমের অপরাধের দায় পুলিশ বিভাগ নিতে চায়নি বলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার ইমাম হোসেনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, সে ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের ব্যাখ্যা জানতে চাই।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]