হার্ড ইমিউনিটি, এরপর কে মুখ থুবড়ে পড়বে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আর্থিক কারণে করোনার চিকিৎসা সম্পন্ন না করেই একটি বেসরকারি হাসপাতাল ছেড়ে গিয়েছেন মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। করোনা প্রকোপের শুরু থেকেই খোরশেদ স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে মৃতদেহ দাফন ও সৎকারে মাঠে নামেন। এ পর্যন্ত তাঁর দল ৭১টি মৃতদেহ দাফন ও সৎকার করেছে। মানবতার ফেরিওয়ালা, করোনাযোদ্ধা, সুপার হিরো নানা বিশেষণে অভিহিত খোরশেদ এখন নিজেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা ব্যয় বহনে ধুঁকছেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর, হাসপাতালে জায়গা পেয়েছিলেন তদবির করে। কিন্তু ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে চিকিৎসা অব্যাহত রাখতে পারেননি। ওদিকে বাবুবাজারের আল আমীনের হাসপাতালে জায়গা মিলেছে কি না, আমরা জানি না। তাঁর জন্য কেউ হয়তো তদবির করেনি। তাই তাঁর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকার ছবি আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি। ছবি প্রকাশের পর আল আমীন হাসপাতালে জায়গা পেতেও পারেন। কিন্তু সার্বিকভাবে খোরশেদ বা আল আমীন সারা দেশেরই প্রতিচ্ছবি।

করোনা নিয়ে সবার মধ্যেই ভয়, আতঙ্ক কাজ করছে। কারও সঙ্গে কথা হলে আলাপের শুরুতেই জানায়, এখনো সুস্থ আছি। যেন অসুস্থ হয়ে পড়াটাই এখন ভবিতব্যের পরবর্তী পরিণতি। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমন্বিত ও গোছানো কোনো পরিকল্পনা নজরে আসেনি। অগোছালো, দায়িত্বহীন কথাবার্তা ও বাগাড়ম্বরের প্রতিযোগিতা চলছে সর্বত্র। একদিকে জনসাধারণ কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না। ওদিকে শুরুতেই চিকিৎসকদের পিপিই ও মাস্ক নিয়ে নানা নাটক ও তামাশা। অপর দিকে করোনার ত্রাণ চুরির মহোৎসব। এই হচ্ছে দেশের করোনা পরিস্থিতি।

প্রথমে রোগীর দুর্দশার প্রসঙ্গে আসি। শুরু থেকেই দিনের পর দিন ঘুরেও করোনার পরীক্ষা করানো যাচ্ছে না। ভর্তির জন্য তদবির করতে হয়। এতেও অনেকে ভর্তি হতে পারছেন না। সকালে পরীক্ষা করাতে গিয়ে অপেক্ষার লাইনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন এক রোগী। সাধারণ রোগেরও চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে না। করোনা সনদ ছাড়া রোগী ভর্তি করতে চাইছে না বেসরকারি হাসপাতালগুলো। স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে চরম ভোগান্তির মধ্যে রয়েছেন সাধারণ নাগরিকেরা। শুধু সাধারণ মানুষই নন, উচ্চপদস্থ আমলারাও এই ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না।

করোনা মোকাবিলা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একধরনের দ্বিধা, সমন্বয়হীনতা, অদক্ষতা ও পরিকল্পনার অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। যেকোনো ধরনের মহামরি মোকাবিলায় সাপ্রেশন অথবা কনটেইনমেন্ট পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। এই সাপ্রেশন সবাইকে রীতিমতো আবদ্ধ বা লকডাউন করে রোগকে মোকাবিলা করা হয়। এই পদ্ধতি অবলম্বন করে চীন, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স বা ভিয়েতনাম সুফল পাচ্ছে। এসব দেশে মৃত্যু ও আক্রান্তের হার কমে আসছে। অপর দিকে কনটেইনমেন্ট পদ্ধতিতে হার্ড ইমিউনিটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এই পদ্ধতিতে টিকা প্রয়োগে অথবা রোগ ছড়াতে দিয়ে মানবদেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করা হয়।

দেশে কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে তা সরাসরি বলা মুশকিল। কখনো মনে হবে সাপ্রেশন, কখনো মনে হবে কনটেইনমেন্ট অথবা দুইয়ের মিশ্র পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। কার্যত সারা দেশে কখনোই একযোগ লকডাউন করা হয়নি। বিভিন্ন এলাকা লকডাউন করা হয়েছে। যেমন নারায়ণগঞ্জের বন্দরে এক মহিলার মৃত্যুর পর ওই এলাকা লকডাউন করা হয়। শহরের তল্লা ও পাঠানঠুলি এলাকা থেকে তাঁর আত্মীয়রা দাফনে অংশ নিয়েছেন। এটা শুনে প্রশাসন তল্লা ও পাঠানঠুলি এলাকা লকডাউন করে। ততক্ষণে ওই মহিলার এক আত্মীয় আবার তল্লা থেকে লামাপাড়ায় ছেলের বাড়িতে চলে যান। এবার লামাপাড়া লকডাউন করা হয়। এভাবেই লকডাউন সন্দেহভাজনের পিছু পিছু দৌড়ায়।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে অমুক এলাকা লকডাউন করা হয়েছে। কিন্তু আসলে তো লকডাউন করা হযনি। বরং বলা যায় সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এই ছুটিতে দলে দলে মানুষ গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে। কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছে। আবার পোশাককর্মীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। তাঁরা মরিয়া হয়ে ঢাকায় ফিরেছেন। ফেরার পর শুনেছেন ছুটি বহাল আছে। আবার গ্রামে ফিরে যাও। ফের গার্মেন্টস খোলা হলো। এই যে কয়েকবার করে মানুষ রাজধানী ও গ্রামে আসা–যাওয়া করল, এতে তো ঝুঁকির মাত্রা আরও বেড়েছে।

পুরো দেশ একযোগে লকডাউন করা হয়নি। কারণ এতে আর্থিক ও খাদ্যসহায়তার প্রশ্ন চলে আসে। দেশে ত্রাণ কার্যক্রম শুরুও হয়েছিল। কিন্তু খুব একটা লাভ হয়নি। দলে দলে সরকারদলীয় স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা ত্রাণসহ আটক হতে থাকেন। সরকার চাইলেই কড়া লকডাউন দিয়ে এক–দেড় মাস জনসাধারণকে ঘরে আটকে রাখতে পারত। রোগের বিস্তার প্রথম ধাক্কাতেই আটকে ফেলা যেত। নিম্নবিত্ত ও অতিদরিদ্রদের খাদ্যসহায়তা দিলেই এটা সম্ভব ছিল। মানুষ ঘর থেকে বের হতো না। সরকারের এই কিছুদিন খাদ্যসহায়তা দেওয়ার সক্ষমতা আছে। জাতীয় পরিচয়পত্র ধরে ধরে ত্রাণ বিতরণ করলে অনেকটাই স্বচ্ছ ও সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণ সম্ভব।

সরকার সাপ্রেশনের পথে না গিয়ে কনটেইনমেন্টের পথ অনুসরণ করছে। এখনো যেহেতু টিকা আবিষ্কার হয়নি, তাই বেশির ভাগকে আক্রান্ত করাই হার্ড ইমিউনিটির একমাত্র পথ। হার্ড ইমিউনিটি পদ্ধতি এর আগেও গুটিবসন্ত ও হামের প্রতিরোধে পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রয়োগ করা হয়েছে। হার্ড ইমিউনিটি প্রয়োগ করার আগে বিবেচনা করতে হবে সংশ্লিষ্ট দেশের আর্থিক, প্রযুক্তি ও অবকাঠামোগত দক্ষতা ও সুবিধা আছে কি না উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য। একই সঙ্গে অনেকেই আক্রান্ত হলে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করার বিষয়গুলোও ভাবতে হবে।

করোনা নিয়ে মুশকিল হচ্ছে এর সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য বিজ্ঞানীদের কাছে নেই। প্রতিদিনই কমবেশি নতুন নতুন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। নিয়মিতই ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের কথা শোনা যাচ্ছে। টোটকা চিকিৎসাও খুব পিছিয়ে নেই। গরম পানি পান করলে করোনা হয় না এমন ধারণা থেকে অনেকেই অতিরিক্ত গরম পানি পান করে মুখ পুড়িয়ে ফেলছেন। এখন করোনা নিয়ে নানা তথ্যের বিস্তার চলছে। প্রথমে বলা হলো এই ভাইরাস মূলত বয়স্কদের আক্রান্ত করে। এখন দেখা যাচ্ছে মধ্যবয়সীসহ শিশু–কিশোরেরাও আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। শুরুর দিকে বিজ্ঞানীরা জানালেন, ফুসফুসের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয় এই ভাইরাস। তাই শ্বাসকষ্টে রোগী মারা যায়। পরে আবার গবেষকেরা বলছেন, রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার কারণে ফুসফুসে অক্সিজেন যেতে পারছে না। আমজনতার পক্ষে এসব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। এরা চায় রোগের উপশম, মহামারির অবসান।

আমরা কি পুরোপুরি লকডাউনে যাব, না হার্ড ইমিউনিটিতে যাব, তার সঠিক নির্দেশনা ছিল না। যে কারণে জনসাধারণও নিজেদের কৌশল ঠিক করতে পারেননি। কেউ কেউ ঘরেই বন্দী থেকেছেন। কেউ কেউ দিব্যি বাজারে গিয়েছেন, ঘুরে বেড়িয়েছেন, জামাতে নামাজ পড়েছেন। এখন মহামারির কাল। পবিত্র মক্কা ও মদিনাতেও জামাতে নামাজ বন্ধ করা হয়েছে। সেখানে কারফিউ পর্যন্ত জারি করা হয়েছে। দেশে জুমার নামাজ পড়া হবে কি না, তারাবির জামাত হবে কি না, এই সিদ্ধান্ত নিতে অযথাই বিলম্ব করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য খাতে আমাদের প্রযুক্তিগত ও অবকাঠমোগত সুবিধা খুব বেশি খারাপ নয়। বিদ্যমান সুবিধা দিয়ে আরও ভালোভাবে করোনা মোকাবিলা করা যেত। কিন্তু সরকারের কৌশলী আচরণ ও নানা ক্ষেত্রে যথাযথ সিদ্ধান্তের অভাব বা সিদ্ধান্তহীনতা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়েছে এবং সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। আচরণে মনে হচ্ছে হার্ড ইমিউনিটি পদ্ধতি অনুসরণ করছে সরকার। কিন্তু হার্ড ইমিউনিটির ধাক্কা সওয়ার মতো সক্ষমতা কি আমাদের আছে?

এ নিয়ে সরকারকে কেউ সরাসরি দায় দিতে পারবে না। সরকার দাবি করবে আমরা ছুটি দিয়েছি। ত্রাণও দিয়েছি। ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিয়েছি। দরিদ্রদের নগদ আর্থিক সহায়তা দিয়েছি। নতুন চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছি এই মহামারির সময়। গার্মেন্টস খুলে দিয়েছি। সীমিত পরিসরে পরিবহন ব্যবস্থা চালু করেছি। এতে সব পক্ষই কিছু না কিছু পেয়েছে। কিন্তু সাধারণ জনগণ এসবের কোনো সুফল পাচ্ছেন না। শ্রমিকেরা বেতন পাননি। বেসরকারি খাতের অনেকের বেতন বন্ধ। কেউ কেউ অর্ধেক বা এরও কম বেতন পাচ্ছেন।

কার্যত করোনা মোকাবিলা নিয়ে এক ধোঁয়াশা তৈরি করা হয়েছে। এই ধোঁয়াশার মধ্যেই জ্বর নিয়ে বাবুবাজারের আল আমীন মুগদা হাসপাতালের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে যান। হার্ড ইমিউনিটির কালে এখন সম্ভবত সবাইকে এই অপেক্ষায় থাকতে হবে, কে মুখ থুবড়ে পড়বে।

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক