শিশুর অনলাইন স্কুল ও কর্মজীবী মা-বাবার বিড়ম্বনা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

করোনা পরিস্থিতি বিশ্বের শিশুদের নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। গৃহবন্দীত্বের বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে আমরা বড়রাই যেখানে হিমশিম খাচ্ছি সেখানে দিনের পর দিন চারদেয়ালে বন্দী থেকে আমাদের শিশুগুলো একদম ভালো নেই। শুধু তাই নয়, করোনা বাস্তবতায় হুমকির মুখে তাদের শিক্ষাজীবন। শিশুদের শিক্ষা অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। থেমে নেই স্কুলগুলো। করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী শিশুরা পরিচিত হচ্ছে অনলাইন স্কুলের সঙ্গে। অনলাইন স্কুলের ধারণাটি যদিও নতুন নয়, তবে আমাদের দেশে শিশুদের কখনো তেমনভাবে প্রয়োজন হয়নি এই ধারণার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার।

ছোট ছোট শিশুগুলো অনলাইন স্কুল সম্পর্কে তেমন কিছু বোঝার আগেই রোজ ইন্টারনেটে সংযুক্ত হচ্ছে স্কুলের সঙ্গে। বেসরকারি কিছু স্কুল, কিন্ডারগার্টেন আর ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়া শিশুরাই আপাতত অনলাইনে স্কুলে যুক্ত হচ্ছে। ক্লাস করছে নিয়মিত। তবে শিক্ষার্থী, অভিভাবক কিংবা স্কুল কর্তৃপক্ষ কারুরই বিষয়টি সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় তৈরি হচ্ছে সমন্বয়হীনতা ও জটিলতা।

কোনো একদিন বাসাও যে হঠাৎ স্কুলে পরিণত হতে পারে, এ ছিল আমাদের শিশুদের কল্পনার অতীত। করোনা লকডাউনে বাসার চারদেয়ালে বন্দী শিশুগুলো এমনিতেই নিদারুণ বৈচিত্র্যহীন জীবন-যাপনে হাঁসফাঁস করছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ল্যাপটপ কিংবা অ্যান্ড্রয়েড ফোন বন্দী স্কুলের নতুন ধারণার সঙ্গে মানিয়ে নেবার যুদ্ধ। তারা বুঝতে চেষ্টা করছে নতুন এই শিক্ষাদান পদ্ধতি। তবে এই যুদ্ধ কিন্তু শিশুদের একার যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধ শিক্ষার্থীদের যতখানি, তার চাইতে কয়েকগুণ বেশি তাদের মা-বাবার।

করোনা লকডাউনের মাঝে হঠাৎ একদিন স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনলাইনে ক্লাস শুরু হওয়ার নোটিশ আসে মা-বাবার কাছে। যেন বাজ পড়ে মা-বাবার মাথায়। স্কুল শুরু করার আগে কর্তৃপক্ষ একবারও ভেবে দেখেনি শিক্ষার্থীর পরিবারে বাড়তি কোনো ল্যাপটপ কিংবা অ্যান্ড্রয়েড ফোন আছে কি না, বাসায় ইন্টারনেট সংযুক্তি আছে কি না কিংবা সংযোগ থাকলেও ইন্টারনেটের স্পিড অনলাইন ক্লাস করার উপযুক্ত কি না!

বেশি বিড়ম্বনায় পড়েছে সেই পরিবারগুলো যাদের সন্তানসংখ্যা দুই বা তার অধিক। নোটিশ পেয়ে শুরু হয় মা-বাবার অস্থিরতা। এই দুর্যোগে তারা কোথায় ল্যাপটপ পাবেন আর কোথায় পাবেন ফোন! বাড়তি ডিভাইস না পেয়ে শেষ পর্যন্ত নিজের ডিভাইসটিই বাড়িয়ে দিয়েছেন অনেকে সন্তানের পড়াশোনার স্বার্থে। এই পরিস্থিতিতেই আবার অনেক স্কুলেই চলছে অনলাইনে পরীক্ষা।

লকডাউনের দিনগুলোতে সন্তানের অনলাইন স্কুল নিয়ে কর্মজীবী মা-বাবার ভোগান্তি ছিল অনেক বেশি। অধিকাংশ স্কুলের সময় এবং বড়দের অফিস সময় কিন্তু এক। সন্তানের স্কুলের সময়টি বড়দের অফিস সময়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় মা-বাবা পড়েছেন এক ধরনের বিড়ম্বনায়। বাড়িতে বাড়তি ল্যাপটপ কিংবা অ্যান্ড্রয়েড ফোন না থাকায় মা-বাবাকে রীতিমতো সিদ্ধান্তে আসতে হচ্ছে, ডিভাইসগুলো সন্তানের জন্য ব্যবহৃত হবে নাকি নিজেদের প্রয়োজনে।

হুট করে এসব ডিভাইস কেনার মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতা সকলের থাকে না। এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে আছেন অনেকেই। অন্যদিকে অনলাইন ক্লাসের সঙ্গে শিশুদের অভ্যস্ততা না থাকায় স্কুল চলাকালীন শিশুদের প্রতি বাড়তি মনোযোগ ও সময় দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। কিন্তু শিশুর স্কুল চলাকালে অফিসের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং কিংবা কাজ রেখে সন্তানের প্রতি নজর দেওয়ার বাস্তব পরিস্থিতি অনেকেরই থাকে না।

তুলনামূলকভাবে বয়সে বড় শিশুদের মা-বাবার সহযোগিতা খুব বেশি প্রয়োজন না হলেও ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে সর্বক্ষণ মা-বাবার উপস্থিতি প্রয়োজন হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব শিশুর বয়স দশ বছরের মধ্যে, তাদের নিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে মা-বাবার। অনলাইন ক্লাসের প্রযুক্তি এবং শিক্ষকের গতির সঙ্গে অনেক শিশুই তাল মিলাতে পারছে না। ফলে পড়া বুঝে উঠতে তাদের ভোগান্তি হচ্ছে। অনেক শিশু হতাশ হয়ে পড়ছে, কান্নাকাটি করছে।

লকডাউনে তবু একরকম চলছিল। সম্প্রতি সীমিত আকারে অফিসসহ অনেক প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ায় দেখা দিয়েছে আরেক বিড়ম্বনা! মা-বাবা কিংবা অভিভাবক অফিসে থাকাকালীন অনলাইন ক্লাসে শিশুরা কীভাবে যোগ দেবে তা নিয়ে ভাবার কেউ নেই। মা-বাবার সহযোগিতা ছাড়া ছোট ছোট শিশুগুলো অনলাইন স্কুলে যোগ দিতে অসহায় এক পরিস্থিতিতে পড়ে গেছে। সন্তানের অসহায়ত্বে অসহায় মা-বাবা হতাশায় ভুগছেন। সন্তানের প্রতি দায়িত্ব এড়িয়ে কাজে যোগ দিয়ে তাঁরাও এক ধরনের অপরাধবোধে ভুগছেন।

শিশুর জন্য অনলাইন স্কুল শুরু করার পূর্বেই প্রয়োজন শিক্ষার্থী ও তার বাড়ির পরিস্থিতি সম্পর্কে স্কুল কর্তৃপক্ষের স্পষ্ট ধারণা থাকা। এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার আগে শিক্ষার্থীর বয়স ও যোগ্যতাকে মাথায় রেখে তাদের মা-বাবার সুবিধাজনক সময়টিও জেনে নেওয়া জরুরি। এই বিশেষ পরিস্থিতিতে অনলাইন স্কুলে অংশ নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ডিভাইস শিক্ষার্থীর পরিবারে আছে কি না সেই তথ্যটি জানা প্রয়োজন। বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীকে একযোগে সংযুক্ত না করে মা-বাবার সুবিধা অনুযায়ী কয়েকটি ভাগে পৃথক সময়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া যেতে পারে। সন্ধ্যার পর ক্লাস নিলে অনেক মা-বাবাই সন্তানকে সময় দিতে পারবেন।

এ ছাড়াও পাঠকে আনন্দদায়কভাবে উপস্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। পরিবর্তিত এই নতুন পরিস্থিতিতে সিলেবাসকে একটু নতুনভাবে ভাবা যেতে পারে। শিশুদের সৃজনশীল কাজকে উৎসাহিত করা যেতে পারে, অনলাইনে প্রচুর বই পড়তে দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া গৃহস্থালি কাজে শিশুদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা যেতে পারে।

এই সময়ে সবচেয়ে বেশি যেটি প্রয়োজন তা হলো, শিশুদের আনন্দে রাখা এবং তাদের মানসিকভাবে নির্ভার রাখা। পাশাপাশি ন্যূনতম লেখাপড়ার মাধ্যমে তাদের অভ্যস্ততা ধরে রাখাও জরুরি। অন্যদিকে এই সব আয়োজন করতে গিয়ে কোনো শিশু যেন বৈষম্যের শিকার না হয়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। শিশুদের মা-বাবাসহ অভিভাবকরাও এই পরিস্থিতিতে নানামুখী হতাশা আর চাপের মধ্যে রয়েছেন। তাই তাদের মানসিক অবস্থা আর সীমাবদ্ধতার প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। দুর্যোগে শিশুর শিক্ষা হতে হবে আরও মানবিক।

*নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক