প্রতিদিনের ব্রিফিংয়ে সঠিক অবস্থার প্রতিফলন নেই

>অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন করোনা সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: করোনা সংক্রমিত হয়ে মৃতের সংখ্যা এক হাজার ছাড়াল। বাংলাদেশ যাচ্ছে কোথায়? 

বেনজির আহমেদ: রোগী বৃদ্ধির প্রবণতা ৫ এপ্রিল থেকেই চলছে। লকডাউন, কোয়ারেন্টিন বা টেস্ট আমরা যত পদক্ষেপ নিলাম, তার প্রভাব পড়ল না কেন? ৫ এপ্রিল আমরা ছিলাম বিশ্বে ১১৭তম। সেই র‍্যাঙ্কিংয়ে এখন আমরা ২০তম। তার মানে আমাদের চেয়ে মাঝখানের দেশগুলো সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পেরেছে বলেই তারা আমাদের পেছনে পড়েছে। 

প্রথম আলো: হাসপাতালগুলো সংক্রমণের বড় উৎস কিনা? চিকিৎসকেরা কেন নিজেদের রক্ষা করতে পারছেন না? সুরক্ষাসামগ্রীতে গলদ? 

বেনজির আহমেদ: আমাদের সংক্রমণের অনেকটাই পুলিশ ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ সেবাদানকারী জায়গাগুলো থেকে ঘটেছে। স্কয়ারের একজন পরিচালকসহ অনেক জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক ভুক্তভোগী হয়েছেন। এটা প্রমাণ করে যে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে কার্যকর নেই। ২০০৫ সালে যখন বার্ড ফ্লু হলো, তখন আমি আইইডিসিআরে কর্মরত। আমরা পিপিই নিয়ে আসি। মাস্ক, গ্লাভস পরতে বলায় তখন আমরা বাধা পাই। চিকিৎসক, নার্সরা বললেন, এসব পরে কাজ করা যাবে না। এ ছাড়া হাসপাতালগুলোতে সংক্রমণ মোকাবিলার যে চর্চা থাকা দরকার, সেটাও ছিল না। হাসপাতালগুলোতে, বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালগুলোতে এ জন্য যেসব সুরক্ষাসামগ্রী দরকার, সেটা কখনো সেভাবে ছিল না। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় পরামর্শের জন্য ফেব্রুয়ারির শেষে আমি এক আলোচনায় আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। গিয়ে শুনি ৫০০ থেকে ৭০০ পিপিই আছে, সর্বস্তরের স্বাস্থ্যকর্মী মিলিয়ে তখনই একটি করে ধরলে দরকার ছিল পাঁচ লাখ। এই রোগ আসবে না বলে প্রস্তুতি ছিল ঢিলেঢালা। পরে অবশ্যই উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তা কতটা পর্যাপ্ত ও মানসম্মত, সেই প্রশ্ন রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এফডিও যেভাবে মাস্কের মান পরীক্ষা করে সনদ দিতে পারে, সেই সক্ষমতা ডিজিডিএর নেই। সেবাদানকারীদের প্রশিক্ষণ না দেওয়া এবং এ–সংক্রান্ত গাইডলাইন অনুসরণ না করাও সংক্রমণ বিস্তারের অন্যতম কারণ। কোথাও কোথাও কেবল পিপিইর ঘাটতির কারণেই চিকিৎসক, নার্সরা আক্রান্ত হন। 

 প্রথম আলো: লাল–সবুজের জোনিং কার্যকর হবে? 

বেনজির আহমেদ: ট্রেন মিস তো অনেকবার ঘটল। বিমান বন্ধ করা, বিদেশ প্রত্যাগতদের আটকানো, সফল কোয়ারেন্টিন না করতে পারায় জনপদে ছড়িয়েছে। যখন ছড়াল, তখন তাঁদের বিচ্ছিন্ন করতে পারলাম না। লকডাউন নিশ্চিত করা গেলে, ঈদে মানুষকে স্থির রাখতে পারলে এবং দোকানপাট এত দ্রুত না খুললে এতটা ছড়াত না। এখন জোনিং যেটা চলছে, এর কোনো বিকল্প নেই। এখন আক্রান্তের সংখ্যা ১০ লাখ ধরলেও সাড়ে ষোলো কোটি সংক্রমণের বাইরে রয়েছে। জনপদের হিসাবে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ অসংক্রমিত। এটা ধরে রাখতে পারলে তা হবে বিশাল অর্জন। ১ থেকে দেড় হাজার জায়গায় এলাকাভিত্তিক জোনিং করতে হবে। ধরুন, একটি জোনে ৪০ জন আক্রান্ত। তখন তাঁর নিকটাত্মীয়দের উচ্চ ঝুঁকি গণ্য করে তঁাদের টেস্ট এবং কোয়ারেন্টিন লাগবে। এ সময়টায় সংশ্লিষ্ট জোনে চলাচল ও যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করুন। এর লক্ষ থাকবে আক্রান্ত ব্যক্তি যাতে বাইরে না যেতে পারে। এভাবে চললে রেড জোনগুলো ইয়েলো হতে পারে। দুই মাসের মধ্যে আমাদের অর্জনের চূড়াটা স্পষ্ট হতে পারে। কিন্তু তা না করে কেবল লকডাউন পালন করা হবে ভুল। 

প্রথম আলো: বিএমএ মহাসচিব বলছেন, ল্যাব বসাতে অনেক বিলম্ব ঘটেছে। এখন চড়া দামে ২০০৯ সালের মডেলের ল্যাব কিনছে। ৬৪ জেলায় ৬৪টি ল্যাব বসানোর সিদ্ধান্ত মার্চে হলো না কেন? মেডিকেল কলেজগুলো এত দেরিতে শুরু করল কেন? 

বেনজির আহমেদ: ঢাকা মেডিকেল, স্যার সলিমুল্লাহসহ দেশের দু–তিনটি মেডিকেলে পিসিআর টেস্ট হতো। হ্যাঁ, ঢাকা মেডিকেলের আগেই উচিত ছিল। শুধু আইইডিসিআর, সিডিসি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মিলেই এটা মোকাবিলা করতে চেয়েছিল। এই পরিকল্পনা দেখে আমি বলেছি, এটা ভুল। এটা হতে পারে না। ৬৪টি জেলা ও ৪৯৪টি উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে যুক্ত করতে হবে। একটি ঘটনার কথা বলি, এক আলোচনায় আমি একটির পরিবর্তে দ্রুত ১০টি ল্যাব চালুর সুপারিশ করেছিলাম। সেই আলোচনায় আইইডিসিআরের মীরজাদী সেব্রিনা, ড. আলমগীর, সিএসও তাহমিনা শিরীন ছিলেন। পরে শুনি তা গ্রহণ করা হয়নি। আমি সংশোধিত পরিকল্পনা যাচাই করে দেখলাম তাঁরা একটি ল্যাব দিয়ে পরীক্ষার সিদ্ধান্তে স্থির রয়েছেন। তখনই যে তঁারা দ্রুত বেশি ল্যাব চালু করার সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না, সেটা তঁাদের একটা বিরাট ভুল ছিল। এর খেসারত আমাদের এখনো দিতে হচ্ছে। ওই ঘটনায় আমি খুবই মনঃক্ষুণ্ন এবং ক্ষুব্ধ হই। আমি তাঁদের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখিনি। জনমত গঠনে ফেসবুকেও লিখতে শুরু করি। 

প্রথম আলো: আরও টেস্ট বাড়ানোর ভিত্তি কী হতে পারে? 

বেনজির আহমেদ: প্রথমত কল সেন্টারের মাধ্যমে টেস্ট করাতে আগ্রহীদের একটি তালিকা, চিকিৎসকদের পরামর্শে একটি তালিকা, রোগী, স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ও তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের তালিকা, এসবের ভিত্তিতে একটি সম্ভাব্য তালিকা হতে পারে। তখন যদি দেখা যায় আমাদের প্রতিদিন ২৫ হাজার টেস্ট লাগবে, তখন বলতে পারব এখন ১৫ হাজার হচ্ছে, আরও ১০ হাজার বাড়াতে হবে। কিন্তু সেটা না করে কত ল্যাবে কত টেস্ট লাগবে, সেই আলোচনা করা কিংবা টেস্ট কম হচ্ছে, সেটা বলতে আমি রাজি নই। আবার হঠাৎ সংখ্যা বাড়ালে গুণগত মান রাখা না গেলে সেই টেস্টের দরকার নেই। সেটা বাড়ানোর চেয়ে না বাড়ানোই ভালো। আর সংক্রমণের পরে অনেকটা সময় কেটেছে, তাই আমরা অ্যান্টিবডি টেস্ট করাতে পারি। আবার সন্দেহভাজন প্রত্যেককে আমরা আইসোলেশনে নিয়ে চিকিৎসা দিতে পারি। 

প্রথম আলো: বর্তমানে ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের যে পরিসংখ্যান ব্রিফিংয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা কতটা সঠিক? 

বেনজির আহমেদ: অনেক অসংগতি আছে। কারণ, অনেক ধরনের টেস্ট হচ্ছে। অধ্যাপক এম এ ফয়েজের সঙ্গে আমি একমত যে সামাজিক কারণে অনেক টেস্ট হচ্ছে। আবার একজনের পজিটিভ হওয়ার পর সাত দিন পর আবার তাঁর টেস্ট হলো। পজিটিভ এল। তখনো তঁাকে নতুন শনাক্ত হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আমরা শুনছি যে আজ এতসংখ্যক রোগী। তাঁদের অনেকেই গত ২৪ ঘণ্টার রোগী নন। তাই ব্রিফিং থেকে সঠিক তথ্য আসছে না। অন্তত এতটুকু বলা উচিত, যাঁদের শনাক্ত বলছি, তঁাদের মধ্যে আগে থেকে কতজন শনাক্ত হওয়া রোগী ছিলেন। যাঁদের সন্দেহ করা হয়েছিল, তার মধ্য থেকে কতজন নেগেটিভ এবং যাঁরা আগে পজিটিভ ছিলেন, তাঁদের মধ্য থেকে কতজন চিকিৎসার পরে নেগেটিভ এসেছেন। ডব্লিউএইচওর গাইডলাইন অনুযায়ী, প্রথমে তথ্য দেওয়া উচিত গত ২৪ ঘণ্টায় সন্দেহভাজন কত রোগী এসেছেন। কিন্তু এভাবে তথ্য তারা কখনোই প্রকাশ করছে না। এখন ব্রিফিং হওয়া উচিত, ২৪ ঘণ্টায় আমাদের সন্দেহভাজন রোগী কত এবং সন্দেহভাজন কতজন মারা গেছেন। পরিস্থিতি মূল্যায়নে এটা জানা খুব দরকার। কারণ, আর টি পিসিআরের টেস্ট খুব নিখুঁতভাবে হলেও ২০ ভাগ ফলস নেগেটিভ দেবেই। তার মানে প্রতি ১ হাজার টেস্টে আমরা ২০০ রোগীর প্রকৃত অবস্থা মিস করে চলেছি। 

প্রথম আলো: নির্দিষ্ট সুপারিশ রাখুন। 

বেনজির আহমেদ: প্রথমত রোগী খুঁজে তাঁদের আইসোলেট করা। তাঁদের স্বজনদের টেস্ট করে ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুন সংক্রমণ রোধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভাইরাসবাহী কেউ যাতে সবুজ জোনে না যেতে পারেন। হলুদ জোন একটু শিথিল থাকবে। নির্দিষ্ট দু–তিনটি বাড়িকে আমরা লকডাউন করতে পারি। এ রকম প্রতিটি এলাকায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের নেতৃত্বে মাঠে টিম থাকবে। নিয়ন্ত্রণ না হওয়া পর্যন্ত তঁারা এলাকা ত্যাগ করবেন না। ১৪, ২৮ বা ৪২ দিনের মধ্যে তাঁদের এটা পারতেই হবে, এমন লক্ষ্য বেঁধে দিতে হবে। সারা দেশের অনাক্রান্ত এলাকায় আক্রান্ত এলাকার বা বিদেশ থেকে আসা লোকের প্রবেশে একটা বাধানিষেধ কার্যকর করতে হবে। এ রকম একটি মডেল সক্রিয় করতে কমিউনিটির সম্পৃক্ততা লাগবে। 

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ। 

বেনজির আহমেদ: ধন্যবাদ।