করোনার টেকসই শিক্ষা

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

যখন কোনো মহামারি আসে তখন তা ক্ষতি করার পাশাপাশি অনেক শিক্ষাও দিয়ে যায়। যায় বলছি এ কারণে, সব মহামারিরই শেষ আছে। সেটি হতে পারে টিকা আবিষ্কারের মাধ্যমে কিংবা জীবাণুর জীবন চক্র শেষ হওয়ার কারণে। তবে তার শিক্ষাটি থেকে যায়। করোনা পুরো বিশ্বকে দেখাল কী অসহায় এখনো আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। পুঁজিনির্ভর অর্থনীতিতে মুনাফাই চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হলেও জীবন সেখানে বিপন্ন। পৃথিবীর ১০ ভাগ মানুষের হাতে ৯০ ভাগ সম্পদ থাকলেও চূড়ার মানুষেরা নিরাপদ নয়। এ কারণেই সব সময় সবার যৌক্তিক উন্নয়নের কথা আলোচিত হয়েছে।

বাংলাদেশের অতিধনী ও উঠতি বিত্তবানেরা নাক থেকে দুফোঁটা জল ঝরলেই অন্য মুলুকে পাড়ি দিতেন চিকিৎসার জন্য। কখনো কেউ ভাবতেও পারেননি যে এমন সময় আসতে পারে, যখন এ জল ঝরানো ভাইরাস বাধ্য করবে স্বেচ্ছাবন্দিত্ব বরণে। অথচ এ দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি নিয়ে গভীরভাবে মাথা ঘামাননি কেউ। কথা ছিল, এ দেশের অতিদারিদ্র্য নির্মূল হয়ে যাবে ২০৩০ সালের মধ্যেই; সাধারণ দরিদ্রের সংখ্যাও নেমে আসবে অর্ধেকের কমে। সে পথেই ঠিকভাবে এগিয়ে যেতে অনেক কার্যক্রম ও পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই আম্পানের চেয়েও দ্রুতগতিতে আঘাত হানল করোনা। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নানামুখী বৈশ্বিক স্থবিরতা দেখা দিল। বার্ষিক প্রবৃদ্ধি নেমে গেল স্মরণকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বেই বেকার হয়ে পড়ল কোটি কোটি মানুষ। শুধু সংখ্যা নয়, মারা গেল লাখো মানুষ।

এত মৃত্যু, এত বিপর্যয় আর এত অসহায়ত্ব কী শেখাল আমাদের? আমরা তো নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও মাতৃমৃত্যু-শিশুমৃত্যুর হার অনেক কমিয়ে এনেছিলাম, মানুষের গড় আয়ু বেড়ে চলছিল। পাশাপাশি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার যে উদার বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে, তাতে মনোযোগের ঘাটতি ছিল। না হলে গত তিন মাসে স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের হার কেন ৯০ ভাগ; যা অন্য সময়ে অনেকটা ব্যবসায়িক কারণে প্রায় সবাইকেই সিজারিয়ান প্রসবে বাধ্য করা হতো! সরকার এত দিনে দেশের প্রত্যেক জেলায় আইসিইউ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার ঢাকা-নির্ভরতা এতে হয়তো অনেকটা কমবে। তবে সবার আগে বন্ধ করতে হবে প্রতিবছর স্বাস্থ্যসামগ্রী কেনার নামে লুটোৎসব। মনোযোগ দিতে হবে জনগণের প্রতিটি টাকার যথাযথ ব্যবহারের দিকে।

অভূতপূর্ব উন্নয়নের জাঁতাকলে পিষ্ট আমাদের পরিবেশ। মাত্র তিন মাসের আক্রমণমুক্ত প্রতিবেশে প্রকৃতি স্বরূপে ফিরে আসার বার্তা দিয়েছে। এর ফলে মানুষও রক্ষা পেয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক রোগ থেকে। জলজ ও স্থলভাগের জীবনে এসেছে বৈচিত্র্য। মানুষকে প্রকৃতির অপরিহার্য অংশ বিবেচনা করে রক্ষা করতে হবে পরিবেশকে। অন্যথায় মানুষ ও প্রকৃতি দুটোর অস্তিত্বই যে বিপন্ন হয়ে পড়ে, তা কারও অজানা নয়। করোনাকালের পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত এ অভিজ্ঞতা ভুলে গেলে চলবে না।

সবচেয়ে বড় যে শিক্ষা করোনাকাল শেখাল, তা হচ্ছে বৈষম্যের অবসান। কাউকে পেছনে ফেলে, বঞ্চিত রেখে এগিয়ে যাওয়াটা আর যা-ই হোক, উন্নয়ন নয়। উন্নত হতে হলে সবাইকে নিয়ে এগোতে হবে। কিছু মানুষ অঢেল সম্পদের মালিক হলে সমাজে-রাষ্ট্রে-জীবনে যে বিপর্যয় নেমে আসে, তার অনেক উদাহরণ দেখা গেল এ করোনাকালে। আপনি হয়তো বিপুল বিত্তের মালিক; কিন্তু যদি আপনার গৃহকর্মী, ড্রাইভার, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নাপিত কিংবা মালি যদি আপনার মতো স্বাস্থ্যসচেতন না হন অথবা তাঁদের যদি সচেতন থাকার মতো আর্থিক সামর্থ্য না থাকে, তবে আপনি যে অসহায় সেটি আজ প্রমাণিত। তাই উন্নতি মানে আজ আর নিজের উন্নতি নয়; সবাইকে নিয়ে সামর্থ্যবান থাকার নাম উন্নতি। উন্নয়ন শুধু অর্থনীতির একটি সূচক নয়, বরং সবার মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জীবনের সার্বিক নিশ্চয়তার নাম উন্নয়ন।

শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি অভূতপূর্ব বাস্তবতার মুখোমুখি বাংলাদেশ। এ দেশে এত দিন অনলাইন শিক্ষার বা সনদের কোনো স্বীকৃতি ছিল না; এখনো কোনো আইনি কাঠামো তৈরি হয়নি। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর যে অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তা প্রশংসনীয়। নিকট ভবিষ্যতেই তাদের মূল্যায়নসহ সব কার্যক্রম অনলাইনে চালানোর অনুমতি দেওয়া প্রয়োজন। ভবিষ্যতে বিরাট বিরাট অবকাঠামো নিয়ে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকবে বলে মনে হয় না। এ জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করে অনলাইন শিক্ষাকে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন।

করোনার করাল গ্রাসে বেকার হয়ে পড়ছেন অনেকেই। সীমিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেকারত্বের হার বাড়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিগত তিন মাসে অনলাইনভিত্তিক পেশাগুলোর চাহিদা বেড়েছে এবং এ সেবাদাতা কোম্পানিগুলো বিপুল আয় করেছে। তাই নতুন বেকার জনগোষ্ঠীকে নতুন দক্ষতায় প্রশিক্ষিত করা গেলে এ বিপর্যয় সামলানো যাবে। এ জন্য ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নেওয়া দরকার যাতে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের হার বাড়ানো যায়।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে আমাদের সবকিছু এখন নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশের সব পেশা, বৃত্তি, সম্প্রদায় ও পিছিয়ে রাখা জনগোষ্ঠীকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিবেশিক সব সূচকে নতুন করে উন্নয়ন চিন্তার কাঠামো বদলে দিতে পারে নতুন জীবনের নতুন বিশ্বকে।

মাহফুজুল ইসলাম উপ-মহাব্যবস্থাপক (এসডিজি) পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)
myshamim 2006 @gmail. com