আমরা আরও খারাপ পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছি

>স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক শাহ মনির হোসেন দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন জুমের মাধ্যমে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: করোনাকালের চতুর্থ মাসে পড়তে সব থেকে বেশি মৃত্যু ও শনাক্তের সংখ্যা কী নির্দেশ করছে? 

শাহ মনির হোসেন: কোনো সন্দেহ নেই এটা দিক নির্দেশ করছে যে আমরা আরও খারাপ পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। প্রশ্ন হলো আজকে কেন এই অবস্থা? যেসব স্বাস্থ্যবিধি জনগণের মানা উচিত, সেগুলো মানা হয়নি। জীবন ও জীবিকার তাগিদের কথা এসেছে। বাংলাদেশে লকডাউন সার্বিকভাবে কখনোই হয়নি। সরকারি অফিস-আদালত বন্ধ করা হয়েছিল, এরমধ্য ঈদ গেল। এই ৬৭ দিনেও তারা স্বাস্থ্যবিধি মানেনি। আমরা একটু দেরি করে গণপরিবহন খোলার কথা বলেছিলাম। কিন্তু একটু আগে খোলা হয়েছে। উপরন্তু আমরা এখনো স্বাস্থ্যবিধি মানছি না। সচেতন হচ্ছি না। 

প্রথম আলো: কমিটিতে থেকে আপনারা কী সুপারিশ রাখছেন এবং তা কতটা অবাস্তবায়িত থাকছে? 

শাহ মনির হোসেন: পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য হিসেবে আছি। আমরা যে কারিগরি পরামর্শ দিচ্ছি, তার মধ্যে হাসপাতালের সেবার মান উন্নয়ন, সংক্রমণ কীভাবে কমানো যায়, এসব রয়েছে। তবে যাঁরা নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা স্বাস্থ্য, সমাজ ও অর্থনীতি এই তিনটিকে ব্লেন্ড করে সিদ্ধান্ত নেন। আমরা যা পরামর্শ দিচ্ছি, সরকার মোটামুটিভাবে তা অনুসরণ করছে না, তা নয়। 

প্রথম আলো: হাসপাতালের সেবা উন্নয়নে কী সুপারিশ ছিল আর কী বাস্তবায়ন হয়েছে? 

শাহ মনির হোসেন: উপজেলা থেকে মহানগর পর্যন্ত সব স্তরের হাসপাতালে আইসোলেটেড শয্যাসংখ্যা বাড়ানো। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নির্দেশনাও দিয়েছে। 

প্রথম আলো: এতে সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে বলে বিএমএ মহাসচিব আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। 

শাহ মনির হোসেন: কোনো সন্দেহ নেই যে আমরা যদি সঠিকভাবে ইনফেকশন কন্ট্রোল প্রোগ্রাম রক্ষা করতে না পারি, তাহলে অবশ্যই হাসপাতাল থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে। আমরাও তাঁর সঙ্গে একমত। 

প্রথম আলো: বেশি টেস্ট, বেশি রোগী। কত দূর যাওয়া উচিত? কতটা সম্ভব? 

শাহ মনির হোসেন: যত বেশি টেস্ট, তত বেশি রোগী শনাক্ত, তত বেশি কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করতে পারব। যত বেশি কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, তত কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশনে নিতে পারব। সংক্রমণ কমে আসবে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন হলো টেস্ট করার সক্ষমতা আমাদের কতটা আছে? যদি উচিতের কথা বলেন, তাহলে আমরা বলব সমগ্র জনসংখ্যার করা উচিত। কিন্তু সেটা তো বাস্তবসম্মত নয়। এখন ১৫ হাজার চলছে, ২০ হাজারে যেতে একটু সময় লাগবে। 

প্রথম আলো: প্রতিদিন ৩০ হাজার টেস্টের সামর্থ্য বাড়ানোর পর আর সম্ভব হলো না। অথচ দরকার পড়ল। তখন আমরা নিয়তিনির্ভর হয়ে পড়ব কি না? 

শাহ মনির হোসেন: তখন আমরা উপসর্গ দেখে টেস্টে যাব। বিশ্বে এখন নতুন নতুন কতগুলো টেস্ট করার ডিভাইস তৈরি হয়ে গেছে। এ রকমের কিছু কিছু ডিভাইস যদি আনা যায়, তাহলে হয়তোবা আরও বেশি টেস্ট করা যাবে। কিন্তু সেসব ডিভাইস এখনই সহজলভ্য নয়। 

প্রথম আলো: অ্যান্টিবডি বা অ্যান্টিজেন টেস্ট? 

শাহ মনির হোসেন: আমরা অ্যান্টিজেন টেস্টের কথা বলছি। বর্তমানের আরটি পিসিআর দিয়ে ৩ ঘণ্টা লাগে, কিন্তু এসব ডিভাইস দিয়ে ১০ থেকে ৪৫ মিনিটে সম্ভব। শুরুতে অ্যান্টিবডি টেস্টের দরকার পড়েনি। কিন্তু এখন তা চালু করতে পারি।

প্রথম আলো: বিএসএমএমইউর উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া ১১ জুন প্রথম আলোকে বলেন, আগামী তিন–চার দিনের মধ্যে গণস্বাস্থ্যের কিটের ফল মিলবে। তা ছাড়া অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট সরকার বা বেসরকারি খাত আনছে না কেন? 

শাহ মনির হোসেন: অ্যান্টিবডি কিন্তু ডায়াগনসিস টেস্ট নয়। এটা সার্ভিল্যান্স করার জন্য দরকার। আগে দরকার ছিল না। কারণ, আমাদের শরীরে যদি অ্যান্টিবডি না আসে, তাহলে টেস্ট করে কী লাভ হবে? এখন অ্যান্টিবডি টেস্ট করলে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি জানা যাবে। তাই বলব, এখন বোধ হয় সরকারের উচিত হবে অ্যান্টিবডি টেস্টের জন্য পদক্ষেপ নিতে। তবে এ জন্য একটা নির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকা দরকার। 

প্রথম আলো: এখন পর্যন্ত মোট রোগীর ৭০ ভাগ ঢাকা বিভাগে বলে প্রায় সবকিছুই ঢাকাভিত্তিক। কিন্তু এটা যদি গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, তখন মোকাবিলা করার কী প্রস্তুতি নিতে আপনারা পরামর্শ দিয়েছেন? 

শাহ মনির হোসেন: প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় এর চিকিৎসা সম্প্রসারণ প্রয়োজন। ইতিমধ্যে কিছু জেলায় কোভিড সেবা সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে যদি এর আরও সম্প্রসারণ ঘটে, তবে সরকারকে তার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ঢাকার বাইরে চিকিৎসা সম্প্রসারণের সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিতে হবে। 

প্রথম আলো: ড. মুশতাক হোসেন প্রশ্ন তুলেছেন, রোগীরা কি হাসপাতালে শয্যা পাচ্ছে না, নাকি রোগীরা হাসপাতালে যেতে চাইছে না, নাকি বাড়িতে থাকা রোগীদের কেউ ফলোআপ করছে না, এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। 

শাহ মনির হোসেন: রোগীরা হাসপাতালে শয্যা পাচ্ছে না এবং অনেকে লুকিয়ে রাখছে—হয়তো দুটোই সত্য। আমরা মনে করি শয্যা পাচ্ছে না, তেমন পরিস্থিতি এখনো হয়নি। এখনো হাসপাতালের শয্যা নিঃশেষ হয়ে যায়নি, তবে হওয়ার আশঙ্কা আছে। 

প্রথম আলো: স্বাস্থ্য প্রশাসন সন্তোষজনকভাবে দায়িত্ব পালন করছে কি? 

শাহ মনির হোসেন: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গিয়ে দেখুন, শুক্র-শনি কোনো দিন তাঁদের বন্ধ নেই। তাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। হ্যাঁ, তাঁদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ রকমের একটা বৈশ্বিক অতিমারি, যা গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সারা বিশ্বের অত্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা সেটাও ভেঙেচুরে গেছে, যাদের স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা নিয়ে গর্ব করা হতো, সেসব ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। তাই আমাদের দেশে এত বড় একটা অতিমারিকে চট করে ম্যানেজ করা কঠিন। ঢাকা বিভাগের সিভিল সার্জনদের কাছ থকে দৈনিক রিপোর্ট পাই। সেবাটা জনগণের সন্তুষ্টি অনুযায়ী হচ্ছে না। কারণ, এত বড় একটা সংকট ম্যানেজ করার মতো স্বাস্থ্যব্যবস্থা আমাদের তৈরি ছিল না। 

প্রথম আলো: জিডিপির তুলনায় যাদের স্বাস্থ্য বাজেটে সরকারি ব্যয় ১৮ ভাগ, তাদের সঙ্গে জিডিপির তুলনায় স্বাস্থ্য ব্যয় ১ শতাংশের কম করা বাংলাদেশের ব্যর্থতাকে মিলিয়ে দেখা ঠিক কি না? 

শাহ মনির হোসেন: তা নয়। এটা আমি তর্কের খাতিরে বলেছি। এটা ব্যর্থ হওয়ার প্রশ্ন নয়। সবাইকে আমাদের যথা কাজ করতে হবে। আমি এটাই বলব যে এই বৈশ্বিক অতিমারি ১০০ বছর পর পৃথিবীতে এসেছে, এটা ধারণ করার জন্য উপযোগী শুধু আমরাই নই। বিশ্ব প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু সব রকম চেষ্টা চলছে। কেউ হাত গুটিয়ে বসে নেই। 

প্রথম আলো: স্বাস্থ্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। অগ্রাধিকার দেওয়ার জায়গাগুলো বলুন। 

শাহ মনির হোসেন: স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। বাংলাদেশের প্রতি দুই হাজার মানুষের জন্য একজন ডাক্তার। প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে আটটি শয্যা। এই দিয়ে তো আমি প্রত্যাশিত স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা দাঁড় করাতে পারব না। বিকেন্দ্রীকরণ লাগবে। এখন তো বরাদ্দকৃত বাজেটই বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে বলি, আমি ১০০ জন কর্মীর জন্য বাজেট দিচ্ছি। কিন্তু এর মধ্যে ২০ ভাগ পদ শূন্য। সুতরাং এই ২০ ভাগের জন্য বাজেটের বরাদ্দ খরচ করা যায় না। স্বাস্থ্য বিভাগে প্রচুর শূন্য পদ, সেই সঙ্গে আরও নতুন পদ সৃষ্টি করতে হবে। নতুন অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। অতীতে পদ সৃষ্টি করা ছাড়াই অনেক অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। 

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ 

শাহ মনির হোসেন: ধন্যবাদ।