ট্রাম্পের চোখে ফ্যাসিবাদবিরোধীরা সন্ত্রাসী

যুক্তরাষ্ট্রের ‘অ্যান্টিফা’ আন্দোলনকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করবেন বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাতে এটি নিশ্চিত প্রমাণিত হয়, শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণপন্থী উগ্র সহিংসতার বিরুদ্ধে ওঠা জনমতের বিরুদ্ধে তিনি অবস্থান নিয়েছেন। আরও প্রমাণিত হয়, তাঁর রাজনৈতিক বিরুদ্ধ শক্তিকে দমিয়ে দেওয়াই তাঁর মূল উদ্দেশ্য। 

‘অ্যান্টিফা’ কথাটি ‘অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট’ বা ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী’ কথাটিরই সংক্ষিপ্ত রূপ। কট্টর বাম মতাদর্শের এই আন্দোলন তীব্রভাবে ফ্যাসিবাদ, নব্য নাৎসিবাদ ও কট্টর দক্ষিণপন্থী গ্রুপগুলোর প্রকাশ্য বিরোধিতায় সোচ্চার থাকে। আমেরিকায় ছোট ছোট গ্রুপে এরা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকলেও কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো নেতৃত্ব আন্দোলনটিকে সমন্বয় করে না। 

এ আন্দোলনের অনুসারীরা সাধারণত ছেঁড়া ছেঁড়াভাবে অসহিংস মিছিল–সমাবেশ, বক্তৃতা–বিবৃতি ও পোস্টার সাঁটার মতো কর্মকাণ্ডের মধ্যে থাকে। তবে মাঝেমধ্যে তাঁরা পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার মতো সাহসীও হয়ে ওঠে। 

মোটা দাগে অ্যান্টিফার অনুসারীদের বেশির ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ। তাঁরা সাধারণত মুখোশ পরে আন্দোলনে নামেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী যেকোনো সহিংস আন্দোলনকে তাঁরা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক তৎপরতা হিসেবে অনুসমর্থন দিয়ে থাকেন। ফলে তাঁদের কোনো কোনো আন্দোলনের সময় কিছু সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং বিরোধী শিবিরের ওপর কিছু হামলাও হয়। তবে এ পর্যন্ত তাঁদের দ্বারা কোনো খুনখারাবির ঘটনা ঘটেনি। 

অন্যদিকে, কট্টর দক্ষিণপন্থী শ্বেতাঙ্গ আন্দোলনকর্মীদের হাতে ২০০১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ১০৬ জন নিহত হয়েছে। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের প্রথম বছরে এই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের সহিংস হামলায় কমপক্ষে ৩১ জন নিহত হয়েছে। 

এ ধরনের প্রায় এক হাজার দক্ষিণপন্থী গ্রুপ আমেরিকায় আছে। কিন্তু তাদের তাণ্ডবের বিষয়ে ট্রাম্প এখনো একটি কথাও বলেননি। 

ট্রাম্পের এই দ্বিচারিতার পূর্ণ প্রকাশ দেখা গেছে ২০১৭ সালে। ওই বছর ভার্জিনিয়ার শার্লটসভিলে শহরে ডানপন্থী ‘ইউনাইট দ্য রাইট’ আন্দোলনের নেতা হিদার হিয়ার নিহত হওয়ার দায় ট্রাম্প অ্যান্টিফার ঘাড়ে চাপিয়েছিলেন। ওই ঘটনায় ডানপন্থী শ্বেতাঙ্গরা একটি সমাবেশ করছিলেন। সেখানে নব্য নাৎসিবাদী হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করা এক ব্যক্তি গাড়ি চালিয়ে দেন। সে ঘটনায় হিয়ার মারা যান। 

শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা ওই সমাবেশের আয়োজন করেছে—এই বিষয়কে চেপে গিয়ে ট্রাম্প সরাসরি বলে দেন, ‘উভয় পক্ষে খুব সদাশয় লোকজন ছিলেন।’ সেই তথাকথিত সদাশয় লোকজনের মধ্যে যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন ‘ক্ল্যানসমেন’, ‘অ্যাল্ট-নাইটস’ এবং ‘প্রাউড বয়েস’ গ্রুপের সদস্য। এই তিন গ্রুপই বর্ণবাদী লড়াই শুরু করার চেষ্টা চালিয়ে থাকে। 

এ ছাড়া মুসলমানদের ট্রাম্প প্রথম থেকেই ‘সন্ত্রাসী’ বলে আসছেন। ২০১৫ সাল থেকে তিনি ইসলামকে একটি সহিংস ধর্ম হিসেবে বলে আসছেন। তিনি ‘যুক্তরাষ্ট্রের সব মুসলমানের ডেটাবেস’ তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুসলমানদের নিষিদ্ধ পর্যন্ত করেছেন। বুশ ও ওবামা প্রশাসন যেভাবে মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোর উৎস হিসেবে গণ্য করে তাদের ওপর নজরদারি শুরু করেছিল, ট্রাম্প সেই তৎপরতা বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে মুসলিমদের ট্রাম্প কোণঠাসা করে রেখেছেন। এখন তিনি দক্ষিণপন্থীদের উজ্জীবিত ও বামপন্থীদের নিষ্ক্রিয় করার অভিযানে নেমেছেন। 

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আমেরিকা ভিন্ন দেশের কোনো সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে ঘোষণা দিতে পারে। কিন্তু দেশটির আইন অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ কোনো সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দেওয়া যাবে না। এটি করতে হলে কংগ্রেসে নতুন আইন পাস করতে হবে। সেখানে দেখাতে হবে ওই সংগঠনটি রাষ্ট্রের ও জনগণের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। অ্যান্টিফা মাঝেমধ্যে ভাঙচুর করার মতো বিক্ষোভ করলেও তা রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হওয়ার মতো কিছু, এমনটি কেউ মনে করে না। তাঁদের যদি এখন সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া হয় এবং নব্য নাৎসিদের ‘ভালো মানুষ’ বলে ট্রাম্প সাফাই দিতে থাকেন, তাহলে আমেরিকায় বর্ণবাদী সংঘাত অবধারিত হয়ে পড়বে। 

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

শাহার আজিজ যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার অন সিকিউরিটি, রেস অ্যান্ড রাইটস-এর পরিচালক