সংকট উত্তরণে সময়োচিত কর্মপরিকল্পনা নেই

>
সালেহউদ্দিন আহমেদ
সালেহউদ্দিন আহমেদ
সালেহউদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

প্রথম আলো: এবারের বাজেটকে কীভাবে দেখছেন?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: আশা করেছিলাম এবারের বাজেট গতানুগতিক হবে না। করোনা সংকটের কারণে অর্থনীতি প্রচণ্ড চাপে আছে। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন ধরে একধরনের অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এ ছাড়া বিশ্বমন্দার বিষয় তো আছেই। এই প্রেক্ষাপটে সংকট উত্তরণে আমরা একটা কর্মপরিকল্পনা বা অ্যাকশন প্ল্যান আশা করেছিলাম। সেটি পাইনি। সে ক্ষেত্রে বলব, আশাহতই হয়েছি।

প্রথম আলো: কী ধরনের কর্মপরিকল্পনা আশা করেছিলেন?

সালেহউদ্দিন: আমরা আশা করেছিলাম এবারের বাজেট আয়-ব্যয়ের গতানুগতিক হিসাবের মধ্যে আটকে থাকবে না। বর্তমানে অর্থনীতির কোথায় দুর্বলতা, ব্যবস্থাপনায় কী সমস্যা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা কী হবে, সেগুলো চিহ্নিত করে আর্থিক খাতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় শেয়ারবাজার নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। এগুলো অনেক দিন ধরে শুনে আসছি। কিন্তু লাভজনক সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন শেয়ারবাজারে আনা গেল না, সেই প্রশ্নের উত্তর নেই। ব্যাংকিং খাত সংস্কারের কথা নেই।

প্রথম আলো: সরকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এটি সম্ভব হবে বলে মনে করেন?

সালেহউদ্দিন: কী করে সম্ভব হবে? সরকার নতুন করদাতা খুঁজে বের করার চেষ্টা নেয়নি। কর আদায় পদ্ধতিও চলছে পুরোনো কায়দায়। জেলা পর্যায়ের অনেক ব্যবসায়ী এখনো করের বাইরে আছেন। কর-জাল বাড়াতে হবে। কর আদায় পুরোপুরি অনলাইনে করা উচিত। করদাতা ও আদায়কারী মুখোমুখি হলেই নানা সমস্যা তৈরি হয়।

প্রথম আলো: বিভিন্ন মহল থেকে স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়ার দাবি উঠেছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দের বাইরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ খুব বাড়েনি।

সালেহউদ্দিন: বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, এর সদ্ব্যবহার করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের কোথায় কী সমস্যা, সেগুলো চিহ্নিত করে সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। সংস্কারকাজ হয়তো এক বছরে শেষ হবে না। কিন্তু শুরুটা তো করা যেত। সাধারণ মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো যায়নি। স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মতো বিষয়গুলোতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। করোনা সংকট মোকাবিলায় কেরালা যে সফল হলো, তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়েই। বিকেন্দ্রীকরণ না হলে সমতাভিত্তিক উন্নয়ন অসম্ভব। 

প্রথম আলো: করোনা সংকটের কারণে নতুন করে বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। আগে যা ২০ শতাংশ ছিল, তা এখন বেড়েছে। বাজেটে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কোনো পদক্ষেপ দেখছেন কি?

সালেহউদ্দিন: প্রবৃদ্ধির পেছনে ছুটে আমরা ভুল করেছি। এখন দেখতে হবে, করোনা সংকটে কারা কাজ হারিয়েছেন, কারা নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন। সরকার তাঁদের একবার আড়াই হাজার টাকা করে দিয়েছে। কিন্তু সেটি তো টেকসই ব্যবস্থা নয়। এই মানুষগুলো নিজেরা কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিলে সরকারের উচিত তাঁদের সহায়তা করা। আর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত জোরদার করেই সেটি সম্ভব। বর্তমান পরিস্থিতিতে ১ হাজার লোকের কোনো কারখানা চালানো কঠিন। অনেক পুঁজি ও অবকাঠামো দরকার। কিন্তু ৫০–১০০ লোকের ছোট বা মাঝারি কারখানা চালানো সহজ। উন্নয়ন কৌশল এমনভাবে করতে হবে, যাতে বৈষম্য না বাড়ে।

প্রথম আলো: এবারের সংকটে দেখা গেল কৃষিই অর্থনীতির ধাক্কাটা সামাল দিয়েছে। কিন্তু কৃষিতে সরকারের সহায়তা যথেষ্ট বলে মনে করেন কি?

সালেহউদ্দিন: প্রবৃদ্ধিতে কৃষির অবদান আগের চেয়ে কমে এলেও মনে রাখতে হবে এই খাতে বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষ কাজ করছেন। কিন্তু বাজেটে কৃষি খাত খুব বেশি মনোযোগ পায় না। কৃষিভিত্তিক শিল্প ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও আমরা কর্মসংস্থান বাড়াতে পারি। কৃষককে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম দিতে হবে। অর্থমন্ত্রী অনলাইনে কৃষিপণ্য বিক্রির যে উদ্যোগের কথা বলেছেন, সেটি ভালো। এতে ক্রেতা ও উৎপাদকের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ হবে। ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য কমবে। কৃষকও তাঁর পণ্যের ন্যায্য দাম পাবেন।

প্রথম আলো: এবারের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। সংকট মোচনে কতটা কার্যকর হবে বলে মনে করেন?

সালেহউদ্দিন: সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে যে বরাদ্দ, তার মধ্যে পেনশনভোগীরাও আছেন। গরিব ও দুস্থ মানুষের জন্য যে বরাদ্দ থাকে, তারা সবটা পায় না। অপচয় ও দুর্নীতি হয়। দুর্নীতি বন্ধে উপজেলা পর্যস্ত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) যে খানা জরিপ আছে, তা বিবেচনায় নিয়ে প্রকৃত অভাবীদের খুঁজে বের করা যেতে পারে। প্রত্যেকের জাতীয় পরিচয়পত্র ও সেলফোন আছে। সরকার সরাসরি তাদের সহায়তা করতে পারে। অর্থমন্ত্রী ১০০ দরিদ্রপ্রবণ উপজেলায় বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলেছেন। আমি মনে করি, সবখানেই হওয়া উচিত। শহরাঞ্চলের গরিব মানুষ আরও খারাপ অবস্থায় আছে।

প্রথম আলো: করোনা সংকটের কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী শ্রমিকেরা ফেরত আসছেন। তাঁদের জন্য বাজেটে কিছু নেই?

সালেহউদ্দিন: আমি মনে করি, এটি বাজেটের আরেকটি দুর্বলতা। প্রবাসী শ্রমিকেরা বিদেশ থেকে যে অর্থ পাঠাতেন, তার ওপরই তাঁদের পরিবার চলত। ১০ লাখের মতো শ্রমিক ফিরে আসতে পারেন। এঁরা এখানে যাতে আত্মকর্মসংস্থান করতে পারেন, সে জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।

প্রথম আলো: বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত অগ্রাধিকার পেয়েছে। মোট বরাদ্দ ৮৫ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা।

সালেহউদ্দিন: শিক্ষা খাতে আমাদের যে বরাদ্দ, তার প্রায় পুরোটাই ব্যয় হয় বেতন-ভাতা ও অবকাঠামো উন্নয়নে। শিক্ষা উপকরণ, প্রযুক্তি উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের বিষয়টি উপেক্ষিত।

প্রথম আলো: ব্যাংকিং খাতে কী ধরনের চাপ পড়বে বলে মনে করেন?

সালেহউদ্দিন: সরকারের ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়ার প্রভাব চলতি অর্থবছরে তেমন পড়েনি। আগামী অর্থবছরে মূলধনের ওপর চাপ পড়বে। তাই আমি মনে করি, ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের বেশি ঋণ নেওয়া ঠিক হবে না। বরং আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সহজ কিস্তির ঋণ (সফট লোন) নিতে পারে। কিন্তু সাপ্লাই-ক্রেডিট ঋণ নেওয়া ঠিক হবে না।

প্রথম আলো: আগে সরকারের ঋণের অন্যতম উৎস ছিল সঞ্চয়পত্র। সুদ কমিয়ে দেওয়ায় মানুষ সঞ্চয়পত্রে আগ্রহ হারাচ্ছে। সরকারের এই নীতি কি সঠিক মনে করেন?

সালেহউদ্দিন: আমি আগে থেকেই বলে আসছি, এটি ভুল সিদ্ধান্ত। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো ঠিক হয়নি। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কিছুটা বেশি হলে তা থেকে তো মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও অবসরভোগীরাই বেশি উপকৃত হবেন।  

প্রথম আলো: এবারের বাজেটের ইতিবাচক দিকগুলো কী কী?

সালেহউদ্দিন: ইতিবাচক দিক হলো সরকার করপোরেট ট্যাক্স কমিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ও অগ্রিম ট্যাক্সও কমানো হয়েছে। এতে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা উৎসাহিত হবেন। কিন্তু ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে কালো বা অপ্রদর্শিত টাকা সাদা করার যে বিধান রাখা হয়েছে, সেটি নৈতিকতাবিরোধী। এর মাধ্যমে সৎ ব্যবসায়ী, যাঁরা নিয়মিত কর দেন, তাঁদের শাস্তি দেওয়া হলো।

প্রথম আলো: সংকট উত্তরণে বাজেটে কোন দিকটির প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন?

সালেহউদ্দিন: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূল ও চরাঞ্চলে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের সহায়তা দেওয়া। সম্প্রতি আম্পানে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় বহু মানুষের ঘরবাড়ি ও ফসল ডুবে গেছে। তাই উপকূল ও চরাঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থানে ও দুর্যোগ থেকে রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন ছিল। টেকসই উন্নয়নের জন্য সেটি জরুরি। এবারও প্রমাণিত হলো সুন্দরবনই আমাদের রক্ষাব্যূহ। অতএব সুন্দরবনকে বাঁচাতে হবে। আমার শেষ কথা হলো অতি আশাবাদী না হয়ে অর্থনীতিকে সচল করার জন্য বাস্তবমুখী পরিকল্পনা নিতে হবে। মানুষের জীবনকে সুস্থ ও সবল রাখতে হবে। এটি আমাদের বড় পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় পাস করতে হলে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, এনজিও সবাইকে সঙ্গে নিয়েই এগোতে হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

সালেহউদ্দিন: আপনাকেও ধন্যবাদ।