তেলের দামের পতন ওলট-পালট করে দিচ্ছে সব

রয়টার্স ফাইল ছবি।
রয়টার্স ফাইল ছবি।

বিদ্যমান কোভিড-১৯ মহামারি নানাভাবে ভূরাজনীতিকে জটিল করে তুলেছে। তেল ব্যবসাভিত্তিক ভূরাজনীতি তার মধ্যে অন্যতম। বিশেষত তেলের দাম তলানিতে এসে ঠেকার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মহাদুর্যোগ নেমে এসেছে। তেলের মূল্যপতনের কারণে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর অভিজাতরাই বেকায়দায় পড়েছে। 

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যাঁরা নির্বাচন করার জন্য পয়সাকড়ি দিয়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় জ্বালানি কোম্পানির মালিক অথবা সেসব কোম্পানির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত। এখন তাঁরা তেল ও গ্যাসের চাহিদার আকস্মিক তীব্র পতনের আশঙ্কায় আছেন। ক্রমে নিচের দিকে ধাবমান বাজারের গতি ‘হোয়াইটিং পেট্রোলিয়াম’ নামের একটি বড় কোম্পানিকে ইতিমধ্যে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণার আরজি জানাতে বাধ্য করেছে। 

এ ছাড়া ‘চেসাপিক এনার্জি’ নামের আরেকটি কোম্পানিও একইভাবে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে খবর বেরিয়েছে। এর বাইরে আরও অনেক কোম্পানি তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব কোম্পানির অনেকগুলোই ফ্র্যাকিং পদ্ধতিতে তেল উত্তোলন করে, যা খুবই ব্যয়সাপেক্ষ। এমনিতেই তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় কোম্পানিগুলো চাপে ছিল। এখন করোনাভাইরাসের কারণে দেনায় ডুবে গেছে। ২০০৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আমেরিকার ১৬টি অয়েল কোম্পানির ব্যালান্সশিটে দেনার পরিমাণ আট হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বাণিজ্য সাময়িকী কোয়ার্টজ বলেছে, আমেরিকায় বর্তমানে ১০০টি ফ্র্যাকিং অপারেশন (বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাটির তলদেশের পাথর চূর্ণ করে গ্যাস বের করে আনা) হলে তার মধ্যে একটিও লাভ করতে পারছে না। অবাক হওয়ার কিছু নেই, এসব কোম্পানি নিজেদের বাঁচাতে এখন ট্রাম্পের বর্ণবাদী ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ স্লোগানের একাত্মতা প্রকাশ করেছে। 

দ্য আমেরিকান লেজিসলেটিভ এক্সচেঞ্জ কাউন্সিল (ট্রাম্পের কট্টর সমর্থক হিসেবে পরিচিত ধনকুবের কোচ পরিবার এটিকে নিয়ন্ত্রণ করে) এবং মিশিগান ফ্রিডম ফান্ড (এটিও ট্রাম্পের সমর্থক ডিভোস পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন) বিভিন্ন রাজ্যে লকডাউন খুলে দেওয়ার দাবিতে আয়োজিত সশস্ত্র বিক্ষোভে পয়সা ঢেলেছে। লাখো মানুষ করোনায় মারা গেলেও এই কোম্পানিগুলো দ্রুত স্থানীয় অর্থনীতিকে খুলে দেওয়ার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে। 

ভারী অস্ত্র নিয়ে স্বস্তিকা, ফাঁস ও কনফেডারেট পতাকা হাতে কট্টর ডানপন্থীরা লকডাউন খুলে দেওয়ার যে দাবি জানিয়েছে, তা অস্বস্তিকর। তাদের পাশাপাশি উদারপন্থী ডেমোক্র্যাটরাও কিন্তু একই দাবি জানাচ্ছে। এই দুই পক্ষকেই বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো অর্থ দিচ্ছে, যাতে তারা সবকিছু খুলে দেওয়ার জন্য জোর দাবি তোলে। নিজেদের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের কথা ভেবে তারা ‘এক্সওনমবিল’–এর মতো কোম্পানির কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নিচ্ছে। তবে তেলের দামের পতনের জন্য শুধু করোনাভাইরাসকে দায়ী করা যাবে না। লক্ষ করলে দেখা যাবে, গত মার্চে যখন বিশ্ব অর্থনীতি স্বাভাবিকতার ধারায় যাচ্ছিল, ঠিক তখনই সৌদি আরব ও রাশিয়া কে কত কম দামে তেল বেচতে পারে, সেই প্রতিযোগিতা শুরু করল। চাহিদার চেয়েও বেশি কোটি কোটি ব্যারেল তেল তারা বাজারে ছাড়ল। রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ বলেছেন, সৌদি আরব মার্কিন শেল অয়েল কোম্পানিগুলোকে বাজার থেকে বের করে দেওয়ার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অতিরিক্ত তেল বাজারে ছেড়েছিল। 

সন্দেহ নেই, ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক বিষয়াদি থেকে গুটিয়ে নেওয়ার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব অনেকখানি হারিয়ে ফেলেছে। এমনকি তার মিত্র ইসরায়েল ও সৌদি আরবের ওপর তার আগের মতো নিয়ন্ত্রণ নেই। এখন আশঙ্কার বিষয় হলো যুক্তরাষ্ট্রের এই নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়ার বিষয়টি নতুন করে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতির সুযোগে সেখানে চীন ও রাশিয়ার উপস্থিতি বাড়ছে। এতে মধ্যপ্রাচ্যে আগের চেয়ে বেশি অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। রাশিয়ার তেল কেনার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর রাশিয়াকে বাধ্য হয়ে বিকল্প পথে হাঁটতে হয়েছে। সে কম দামে তেল বিক্রি শুরু করেছে। 

এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে চীন। তারা কম দামে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল নিয়েছে। রাশিয়ার পক্ষে যত কম দামে তেল বিক্রি সম্ভব হবে, যুক্তরাষ্ট্রের শেল অয়েল কোম্পানিগুলোর পক্ষে সেই দামে জ্বালানি দেওয়া সম্ভব হবে না। ফলে রাশিয়ার ওপর তেল অবরোধ করে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই নিজের ক্ষতি করেছে। মার্কিন তেল কোম্পানিগুলো পথে বসে যাচ্ছে আর অন্যদিকে চীন কম দামে জ্বালানি কিনে অর্থনীতিকে গতিশীল করছে। এতে পুরো ভূরাজনীতির আদলই বদলে যাচ্ছে। 

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
হায়দার এ খান ইউনিভার্সিটি অব ডেনভারের অর্থনীতির অধ্যাপক