চিকিৎসাসেবা: আমাদের রক্তক্ষরণ বন্ধ করুন

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

২০০৪ সালের অক্টোবরের কথা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল সেন্টারের (স্থানীয় নাম মিশন হাসপাতাল) চিফ মেডিকেল অফিসারের পাঠ চুকিয়ে ঢাকায় তৎকালীন আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালের দায়িত্ব নিলাম। ৫০ শয্যাবিশিষ্ট সেই হাসপাতাল এখন আপনাদের আস্থার ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এখন এর শয্যাসংখ্যা ২৫০; আরও ১২৫টি শয্যার কাজ নির্মাণাধীন। ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি কোয়াটারনারি কেয়ার বা উচ্চতর চিকিৎসাসেবা-সংবলিত হাসপাতাল নির্মাণের উদ্বোধনী পর্বও শেষ হয়েছে, যার নাম হবে ‘ইউনিভার্সেল মেডিসিটি’।

সেই ২০০৪ সালের শেষ দিকে আমাদের হাসপাতালের বিপরীতে অবস্থিত অভিজাত এলাকা (মহাখালী ডিওএইচএস) থেকে একজন মুমূর্ষু রোগী এলেন। তাঁর সঙ্গে এলেন তাঁর স্বজন তৎকালীন বিটিআরসির চেয়ারম্যান সৈয়দ মারগুব মোর্শেদ। আমরা রোগীর অবস্থা দেখে বুঝতে পারি, তাঁর আইসিইউ সেবা প্রয়োজন, কিন্তু সে সময় আমাদের হাসপাতালে আইসিইউ ছিল না। তাই আমরা তাঁকে অন্যত্র রেফার করি। তখন জনাব মারগুব মোর্শেদ ইংরেজিতে বলেন, আপনারা যদি ঢাকায় হাসপাতাল চালাতে চান, তাহলে আপনাদের অবশ্যই আইসিইউ ব্যবস্থা থাকা উচিত। আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ; কারণ, তিনিই প্রথম এই আধুনিক জীবন রক্ষাকারী ইউনিট সম্পর্কে আমার তৃতীয় চক্ষুর উন্মোচন ঘটালেন।

২০০৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের আইসিইউ বিশেষজ্ঞ বা ইন্টেনসিভিস্ট প্রফেসর ডা. ওমর ফারুকের তত্ত্বাবধানে আমরা আমাদের হাসপাতালে প্রাপ্তবয়স্ক রোগীদের জন্য চার শয্যার আইসিইউ ব্যবস্থা স্থাপন করি। তখন ডা. বেগ, ডা. আন্দালিবসহ একঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ তরুণ চিকিৎসকের আন্তরিক চেষ্টায় খুব অল্প সময়েই আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতাল বাংলাদেশের আইসিইউ সেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ২০০৯ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী আমাদের হাসপাতালকে ‘বেস্ট ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করেন। এখন এই হাসপাতালের অ্যাডাল্ট আইসিইউ, পিআইসিইউ, এনআইসিইউ, সিসিইউ, সিআইসিইউ, এইচডিইউ, স্ট্রোক সেন্টার, আইসোলেশন আইসিইউ মিলিয়ে মোট শয্যাসংখ্যা ৮০। সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে জটিল মুমূর্ষু রোগীরা এই হাসপাতালের আইসিইউতে রেফার্ড হয়ে আসেন। যাঁরা ঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন, তাঁদের অনেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। যাঁরা যথাযথ সময়ে রেফার্ড হন না, তাঁদের অনেকে পথিমধ্যে মারা যান।

মনে হতে পারে আমি আমার হাসপাতালের গুণগান করছি। বিষয়টি আসলে তা নয়। আইসিইউ সম্পর্কে এ সমাজে যে বিভ্রান্তিকর, নেতিবাচক ও ভুল ধারণা আছে, সে বিষয়ে কিছু আলোকপাত করাই এই লেখার উদ্দেশ্য।

উন্নত বিশ্বে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের (সিসিইউ) প্রচলন অনেক আগেই হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে। তারপর থেকে এই খাতে বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে ঢাকাসহ সারা দেশে আইসিইউর সংখ্যা বাড়ে, মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসার সুযোগও বাড়ে। একসময় শুধু আইসিইউর অভাবে অস্ত্রোপচার-পরবর্তী জটিলতায় অনেক রোগী মারা যেতেন। কিন্তু ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিনের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর হার কমতে থাকে, এখন মৃত্যুর হার বেশ কম। দেশে এ বিষয়ে চালু হয়েছে উচ্চতর ডিগ্রি (এমডি-সিসিএম)। এগুলো আশা ও সম্ভাবনার কথা। স্বপ্নের বাস্তবায়নের কথা।

পরিতাপের বিষয়, মানুষের জীবন বাঁচানোর এই বিশেষায়িত ইউনিটকে নিয়ে আছে অজস্র ভুলে ভরা গল্প। যেমন বেসরকারি হাসপাতালগুলো টাকার জন্য মৃত রোগীকে আইসিইউতে ভেন্টিলেটরে বাঁচিয়ে রাখে। চায়ের টেবিলে গল্প চলে: আইসিইউ মানে ব্যবসা, আইসিইউ মানে ধান্দাবাজি, আইসিইউ মানে টাকা রোজগারের ফন্দি। ফেসবুকে এই সব ভিত্তিহীন গল্পগুজবের পক্ষে শত শত লাইক, কমেন্ট, শেয়ার হয়। সংবাদমাধ্যমের একাংশে একতরফা নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন করা হয়। অথচ এক অদৃশ্য ভাইরাস এই জাতির জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত করেছে। কোভিড সংক্রমণের এই দুঃসময়ে আইসিইউ-প্রাপ্তি নিয়ে হাহাকার উঠেছে। সাধারণ মানুষ থেকে ভিভিআইপি পর্যন্ত ভেন্টিলেটর নামক যন্ত্রের অভাবে মারা যাচ্ছেন। আইসিইউ এখন সোনার হরিণ! কোনো দামদর নেই, যেকোনো মূল্যে একটি আইসিইউ বেড চাই! অথচ কদিন আগেও আইসিইউর বিরুদ্ধে ফেসবুক ব্যবহারকারী দায়িত্বহীন মানুষেরা উসকানিমূলক পোস্ট দিয়েছেন।

সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, কোভিড মহামারির এই দুঃসময়েও থেমে নেই মানুষের রূঢ় আচরণ। চিকিৎসক-নার্স লাঞ্ছনা, হাসপাতাল ভাঙচুর ও সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন এখনো থেমে নেই। কোভিড দুঃসময়ে রোগীর স্বজনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, চিকিৎসক-নার্সের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ, অনুমতিহীন জোরপূর্বক ভিডিও ধারণ, ফেসবুক লাইভ করে মনগড়া ভিডিও ভাইরালসহ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এখনো বন্ধ হয়নি। এ দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই দুঃসময়ে প্রণোদনার পরিবর্তে এ ধরনের আচরণ আমাদের স্তব্ধ করছে। যেখানে হাজার হাজার চিকিৎসক-নার্স করোনায় আক্রান্ত হয়ে, জীবন দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মানুষের জীবন বাঁচাতে, সেখানে এ ধরনে আচরণ ও ঘটনা আমাদের চিকিৎসক হৃদয়কে রক্তাক্ত করছে আবারও। আমরা কী বিচার চাইব?

স্বাস্থ্য খাতের অনেক অব্যবস্থাপনা, মানুষের তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনোভাব, অবজ্ঞা, দুর্বৃত্তায়ন, সেবা খাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করাসহ সব অপপ্রচার বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করছি। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সামনে নতুন কোনো মহামারি এলে কোনো প্রণোদনায়ও এ দেশে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামনের লড়াইয়ে পাওয়া যাবে না। কারণ, আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এই রক্তক্ষরণ সম্মানের, আত্মমর্যাদার, এই রক্তক্ষরণ বন্ধ করা জরুরি।

ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী: ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (সাবেক আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতাল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক।