যে যা বলিস ভাই, আমার প্রবৃদ্ধি চাই

১৯৭৩-এ প্রথম জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করে সন্ধ্যার আগে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ক্যাফেটেরিয়াতে যান চা খেতে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাউস থেকে তাঁর রুমে না গিয়ে ক্যাফেটেরিয়ায় আসেন। একটি আনন্দঘন পরিবেশে সাংবাদিকেরা দুই নেতাকে ঘিরে ধরেন। বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে তাজউদ্দীন সাহেবকে বলেন, ‘তাজউদ্দীন, তুমি যে বাজেট দিলা, কাল থেকে কত রকম সমালোচনা শুনবা। যদি বাঁচতে চাও, সাংবাদিকদের ভালো করে খাওয়াও।’ 

ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সির গোলাম রসুল মল্লিক বলেন, ‘কাচ্চি-বিরিয়ানি খাইতে চাই।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বাঙালির জন্য মাছ-ভাতই ভালো।’ অর্থমন্ত্রী আমাদের খাইয়েছিলেন। তিনি ভালো মাছের ব্যবস্থা করেছিলেন। ভোজনের আগে, খেতে খেতে এবং পরে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা নিয়ে তিনি আলোচনা করেন। 

১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরের বাজেট ছিল ৯৯৫ কোটি টাকার। ওই টাকার অঙ্ক নিয়ে সেদিন কোনো হাহাকার ছিল না। সংসদের বাইরের বিরোধী দলগুলো থেকে সামান্য সমালোচনা ছিল। সংসদের ভেতরে আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা আতাউর রহমান খান, আবদুল্লাহ সরকার, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বিভিন্ন প্রস্তাব রাখেন। তখন সংসদ কক্ষ ছিল ছোট (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়)। আতাউর রহমান খানের পিঠের কাছে ছিল আজাদ–এর সাংবাদিকদের জন্য নির্দিষ্ট আসন। 

জাতীয় বাজেটের একটি দিক হলো অ্যাকাউন্টেন্সি বা হিসাবসংক্রান্ত বা গাণিতিক বিষয়, বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব। আর একটি দিক হলো রাষ্ট্রের উন্নয়নসংক্রান্ত পরিকল্পনার রূপরেখা এবং বিদ্যমান সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ। প্রথম কাজটি একজন ভালো কেরানি বা অ্যাকাউন্ট্যান্ট করতে পারেন, দ্বিতীয়টি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিকের কাজ। একসময় চল্লিশ-পঞ্চাশ বা এক শ বছর আগে বাজেট নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ ও আলোচনা করতেন জননেতারা, এখন যে কেউ। যে জনগোষ্ঠীর হাতে যথেষ্ট কাজ নেই, তারা যেকোনো বিষয় নিয়ে মেতে উঠতে পারে। আমাদের সংবাদমাধ্যমও ছাইতে বাতাস দেয়। 

বাজেট ঘোষণার সময় থেকে দুই দিনব্যাপী টিভি চ্যানেলগুলোর স্ক্রলে ভেসে ওঠে পেঁয়াজ, মধু, স্যানিটারি ন্যাপকিন, ডায়াপারের দাম বাড়বে। পত্রিকা তার সঙ্গে যোগ করল জর্দা ও গুলের দামও বাড়ছে। টিভি স্ক্রলে সাধারণত সেদিনের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদই থাকে। মধু বাঙালির প্রধান খাদ্য নয়। পানের সঙ্গে জর্দা এখনো অনেকে খান। গুল জিনিসটি ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে কতজন খান, তা অর্থমন্ত্রী বলতে পারবেন, কিন্তু আমাদের ধারণা, গুল মারতে ওস্তাদ ৯৯ শতাংশ বঙ্গসন্তান। সুতরাং গুলের দাম বাড়ায় যাঁরা গুল খান এবং যাঁরা গুল মারেন, কারোরই খুব বড় রকমের ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা নেই। প্রশ্ন হলো পেঁয়াজ নিয়ে। ও বস্তুটি খেতেই হয়। মজুতদার ও ব্যবসায়ীরা কান খাড়াই রেখেছিলেন পেঁয়াজের দাম বাড়ার সুসংবাদ উচ্চারিত হওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে কেজিতে দাম বাড়ে ১০ টাকা। 

অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু জিনিসের দাম বাড়ার কারণেই রাস্তার পাশের গাছতলার চায়ের দোকান জমে ওঠে। অথচ বাজেট নিয়ে জমে ওঠার কথা সংসদকক্ষে রাজনীতিবিদদের। যে পদ্ধতিতে বাজেট ঘোষণা করা হয়, তা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের। দেশ ছিল পরাধীন, গণতন্ত্রের প্রশ্নই আসে না। তখনো মনোনীত সদস্যদের নিয়ে ছিল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি-বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদ। তখন সরকারি দল আর বিরোধী দল বলে কিছু ছিল না, সবাই সরকার মনোনীত। বিশ্বস্তদেরই সরকার মনোনয়ন দিত। কিন্তু তাঁরাও জনস্বার্থকে উপেক্ষা করতে পারতেন না। 

বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, ১৯১৬ সালে বাজেট বক্তৃতায় এ কে ফজলুল হক বাঙালি মুসলমানের শিক্ষার জন্য বেশি বরাদ্দ দাবি করেন। তিনি বিভিন্ন জেলা শহরে মুসলমান ছাত্রদের হোস্টেল নির্মাণের জন্য বরাদ্দ চান। শুধু তা-ই নয়, জয়নুল আবেদিনের যখন দুই বছর বয়স, তখন তিনি বলেছিলেন কলকাতায় আর্ট স্কুল আছে, পূর্ব বাংলার মুসলমান ছেলেদের শিল্পচর্চার কোনো স্কুল নেই, ঢাকায় একটি আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ বরাদ্দ চাই। প্রতিবার বাজেট আলোচনায় শেরেবাংলা কলকাতায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য বরাদ্দ দাবি করেই যাচ্ছিলেন। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামিয়া কলেজ, যে কলেজের ছাত্রনেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। 

এক শ দশ বছর আগে স্বল্পায়ু ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক পরিষদ’–এ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে বাজেট অধিবেশনে। চল্লিশের দশকে আসাম প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশনে মাওলানা ভাসানী বাঙালি কৃষকদের পুনর্বাসনের জন্য অর্থ বরাদ্দ চান। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম বাজেট অধিবেশনে ১৯৪৮ সালে ভাসানী দাবি করেন, পরিষদে বাংলায় বক্তব্য দিতে হবে, যেহেতু আমরা সবাই বাংলাভাষী। তিনি আরও বলেন, জাতীয় রাজস্বের ‘শতকরা ৭৫ ভাগ প্রদেশের জন্য রেখে বাকি অংশ সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টকে দেওয়া হোক।’ [পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার কার্যবিবরণী]

বাজেট প্রণয়ন ও সংসদে পেশ করা সরকারের সবচেয়ে গুরুদায়িত্ব। তা নিয়ে প্রাসঙ্গিক বিতর্ক ও জনস্বার্থে দাবি উত্থাপন বিরোধী দলের কর্তব্য। একবার অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের সময় স্টেনলেস ব্লেডের দাম বাড়ায় তা নিয়ে আলোচনা হয়। মানুষের জীবনে ব্লেড একটি অপরিহার্য বস্তু কিন্তু তার দাম যদি কিঞ্চিৎ বাড়ে, কী এমন ক্ষতি! মধু বা ডায়াপার, জর্দা বা গুলের দাম বাড়া নিয়ে মাথা ঘামানো এবং নানা রকম বায়বীয় আলোচনার ফলে জাতির স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় চাপা পড়ে যায়। 

বাজেট পেশের পূর্ববর্তী কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নেতারা যে পরামর্শ বিতরণ করতে থাকেন, তা অর্থমন্ত্রীর ওপর কিছুমাত্র প্রভাব বিস্তার করে তেমনটি গত ৪০-৪৫ বছরে দেখিনি। পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ কাজ পরামর্শ দেওয়া এবং সবচেয়ে কষ্টকর কাজ কারও পরামর্শ মূল্যায়ন করে যা গ্রহণযোগ্য তা গ্রহণ করা। কোনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ বাংলাদেশের কোনো সরকার শুনবে, তারা অত কাঁচা নয়। 

করোনার কারণে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার। অধিকাংশ কলকারখানা পূর্ণ উৎপাদনে যেতে পারছে না। রপ্তানি আয় কমে যাচ্ছে। পরিস্থিতির কারণেই এমনটি হয়েছে, সরকারকে দোষ দেওয়া যাবে না। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে সরকার প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাত না, কিন্তু প্রবৃদ্ধি ঠিকই হয়েছে। একালে সরকার মনে করে প্রবৃদ্ধির অঙ্কটা বাড়লে সেটা যারা বাড়ায় তাদের নয়, সরকারের বাহাদুরি। সরকারের মনোভাব এ রকম: তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার প্রবৃদ্ধি বাড়া চাই। 

সারা দুনিয়া বলছে প্রবৃদ্ধির চেয়ে বাঁচা বড়, আমরা বলছি বাঁচার চেয়ে প্রবৃদ্ধি বড়। বিশ্বব্যাংক বলছে, আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বলছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য ৮ দশমিক ২ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো, রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি মাইনাস হতে পারে। চীনের প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ এবং ভারতের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক, মাইনাস ৩ দশমিক ২ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। 

সব সময় সব ক্ষেত্রে মালকোঁচা মেরে নামলেই সফল হওয়া যায় না। বরং হাস্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। একটি বছর প্রবৃদ্ধি কম হলে কোনো দেশের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে না। বাজেট যাঁরা রচনা করেন এবং বাজেটের যাঁরা সমালোচনা করেন, উভয় পক্ষেরই সংযত হওয়া ভালো। বোকার মতো প্রশংসা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন সমালোচনা খুবই ক্ষতিকর। 

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক