প্রবাসী আয় ধরে রাখতে যা করতে হবে

বাংলাদেশের এক কোটির বেশি অভিবাসী ২০১৯ সালে ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রবাসী আয় দেশে পাঠিয়েছেন। অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে অভিবাসীদের পাঠানো ওই অর্থের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের জিডিপির মোট ৭ শতাংশ আসে প্রবাসী আয় থেকে। কিন্তু কোভিড-১৯ বাংলাদেশের অভিবাসীদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। যে দেশগুলোতে বাংলাদেশের অভিবাসীরা কাজ করেন, সেই দেশগুলো কঠোর লকডাউনের আওতায় রয়েছে। কোভিড-১৯–এর পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তেলের দাম একেবারে তলানিতে নেমে যাওয়ায় বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের সংকটটাকে আরও জটিল করে তুলেছে। আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই বাংলাদেশের বেশি লোকজন কাজ করেন।

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় ১৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ কম। এতে করে কয়েক লাখ পরিবারের আয় উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। প্রতি মাসে অভিবাসীদের পরিবারগুলোর গড়ে আয় হতো তিন থেকে ছয় শ ডলার।

আলোচনার উদ্যোগ দরকার

দেশে প্রবাসী আয়ের নিম্নমুখী গতি বন্ধ করতে হলে অভিবাসন নিয়ে অবশ্যই আলোচনা শুরু করতে হবে। বাংলাদেশের কর্মীদের বেশির ভাগই কাজ করেন পর্যটন, সেবা আর নির্মাণ খাতে। মধ্যপ্রাচ্যে অনেক অভিবাসী কাজ হারিয়েছেন আর তাঁদের কাজের ক্ষেত্রও সংকুচিত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পাশাপাশি সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর দেখা গেছে, অতিমারি বেশি ছড়িয়েছে অভিবাসীদের মধ্যে। গাদাগাদি করে ডরমিটরিতে থাকার ফলে তাঁদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিটা বেশি। ফলে বাহরাইন, কুয়েত, মালদ্বীপ, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত অভিবাসীদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে। জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকিকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ওই চাপ মেনে নিতে দ্বিধায় ভুগছে। চলাচলে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর নতুন করে বেকার হয়ে পড়া লোকজন দেশে ফিরলে তা অর্থনীতির ব্যাপক চাপ তৈরি করবে।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের অভিবাসনের বিষয়ে সহযোগিতা নিয়ে এখনই আলোচনা শুরু করা উচিত। মনে রাখতে হবে, এই দর-কষাকষি শুধু এখনকার জন্য করলে চলবে না। কোভিড-১৯ পরবর্তী পরিস্থিতিতে অভিবাসনের প্রক্রিয়া কেমন হবে, সেটা নিয়েও তঁাদের আলোচনা করতে হবে।

নীতিগত কিছু পদক্ষেপ 

অভ্যন্তরীণ উদ্যোক্তাদের উৎসাহ জোগাতে সরকার এরই মধ্যে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। বৈধ চ্যানেলে অভিবাসীদের টাকা পাঠানোকে উৎসাহিত করতে এই বাজেটে সরকারের ৩৬১ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ আশাব্যঞ্জক। কোনো কোনো ব্যাংক অভিবাসীদের বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোকে আরও উৎসাহিত করতে তঁাদের পরিবারের সদস্যদের প্রবাসী আয়ের ওপর বাড়তি ১ শতাংশ প্রণোদনা হিসেবে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবাসী আয় প্রেরণকারী অভিবাসীদের ২ শতাংশ হারে ক্যাশ ব্যাকের পদক্ষেপটি প্রশংসনীয়।

গতবারের বাজেটে চালু করা সরকারের এই প্রণোদনা কর্মসূচির সাফল্য মূল্যায়ন করে তা অব্যাহত রাখা উচিত। বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের মূল উৎস অর্থাৎ মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রে আর্থিক প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করা জরুরি।  

ডিজিটাল লেনদেন

আধুনিক অনেক সেবা চালুর পরও এজেন্টের মাধ্যমে নগদ টাকা পাঠানোই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম। যদিও অতিমারির ফলে ওই মাধ্যমে টাকা পাঠানো ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

জাতিসংঘের পুঁজি উন্নয়ন তহবিলের (ইউএনসিডিএফ) সহায়তায় প্রবাসী আয়ের সেবার সঙ্গে জড়িত বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব মানি ট্রান্সফার নেটওয়ার্কস (আইএএমটিএন) মার্চ মাসের সমীক্ষা অনুযায়ী সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে বিভিন্ন দেশে প্রবাসী আয় পাঠানোর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। সাধারণত বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের প্রায় অর্ধেকেই ওই দেশগুলো থেকে আসে। কাজেই ডিজিটাল উপায়ে প্রবাসী আয় পাঠানো অব্যাহত রাখার স্বার্থে বাংলাদেশ এবং ওই দেশগুলোতে অভিবাসীদের পরিবারের যোগাযোগের সুযোগটা নিশ্চিত রাখতে হবে।  

সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আর প্রবাসী আয়ে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বিত উপায়ে প্রবাসী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের কাছে গিয়ে ব্যাংক হিসাব খোলা আর ডিজিটাল পদ্ধতিতে লেনদেনের সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে হবে। মোবাইলে আর্থিক সেবা দিয়ে থাকে এমন প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে একে অন্যের সঙ্গে লেনদেন করতে পারে, এই লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি মোবাইল ওয়ালটের মাধ্যমে ব্যাংক হিসাবে প্রবাসী আয় পাঠানোর ক্ষেত্রে ফি মওকুফ করতে হবে।

সরকার ব্যাংক, প্রবাসী আয়ে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, মুঠোফোন অপারেটর এবং অন্যান্য অংশীজনকে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার স্বার্থে প্রণোদনা দিতে পারে। বাংলাদেশি অভিবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য নিজেদের সেবার মান আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে প্রবাসী আয়ে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও সঞ্চয়, ঋণ, বিমা এবং অন্যান্য আর্থিক সেবা চালু করতে পারে। ডিজিটাল ওয়ালেটের মাধ্যমে প্রবাসী আয় পাঠিয়ে ক্যাশ আউটে যে প্রণোদনা দেওয়া হয়, তা যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে স্থানীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অংশীদারত্বের ফলে প্রবাসীরা অনলাইন, মোবাইল ওয়ালেট ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে দেশে যে টাকা পাঠিয়েছেন, তাতে ২০২০ সালের এপ্রিলে প্রতিদিনের লেনদেন ১৫০ ভাগ বেড়েছে।  

এখন যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেটা অভিবাসীদের আয় আর প্রবাসী আয়ের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে ভালোভাবে মানিয়ে নেওয়া এবং নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য মুদ্রার প্রবাহ ঠিক রাখতে হলে ডিজিটাল লেনদেনে উন্নতি করার কোনো বিকল্প নেই।

সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ

কোভিড-১৯–এর প্রভাব মোকাবিলায় অন্য খাতগুলোর মতো প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রেও সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এরই মধ্যে গত ২২ মে ইউএনসিডিএফ ও ইউএনডিপি যৌথভাবে উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্বকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে যে প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে থাকছে সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য সরকার। ‘দ্য রেমিট্যান্স ইন ক্রাইসিস-হাউ টু কিপ দেম ফ্লোইং’ ওই সাড়াদান কর্মসূচিতে সহায়তা করছে কেএনওএমডি, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং আইএএমটিএন।  

ইউএনসিডিএফ ও ইউএনডিপির যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, সব অভিবাসীর জন্য ডিজিটাল সমাধান নিশ্চিত করতে একটি সহায়ক নিয়ন্ত্রক ও নীতিগত পরিবেশ, সৃজনশীল উপায়ে ডিজিটাল লেনদেনের প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সরকার ও বেসরকারি খাতকে ইউএনসিডিএফ ও ইউএনডিপি সহায়তা করতে চায়। যাতে করে তাঁরা প্রবাসী আয়ের প্রবাহ নিজেদের দেশে অব্যাহত রাখতে পারেন এবং করোনাভাইরাসের ফলে মারাত্মকভাবে পর্যুদস্ত অভিবাসী পরিবারগুলোকে সহায়তা করতে পারেন। বাংলাদেশের অভিবাসী ও তাঁদের পরিবারের সহায়তায় অনেক কিছু করার আছে, যাঁরা দেশে ও দেশের বাইরে বিরাট অবদান রাখছেন।

আমিল আনেজা জাতিসংঘের পুঁজি উন্নয়ন তহবিলের (ইউএনসিডিএফ) অভিবাসী ও প্রবাসী আয়বিষয়ক প্রধান বিশেষজ্ঞ

শেখ তানজীব ইসলাম বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিইইএফ) এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক অ্যাজেন্ডাবিষয়ক প্রধান