করোনাকালের বাজেট আর কেমন ভালো হতে পারত

মাননীয় অর্থমন্ত্রী ১১ জুন সংসদে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার ব্যয়, ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার আয়, ২ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন ও ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির এবং সেই ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যাংক খাত, সঞ্চয়পত্র এবং সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশন ফান্ড থেকে কত ধারদেনা করবেন, সেই পরিকল্পনাসহ বাজেট পেশ করেছেন। বাজেটে করোনা অভিঘাত বিবেচনায় ২০২০ সালের প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি সংশোধন করে ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ আর ২০২১ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলিত হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ।

এবার করোনার কারণে যদিও সংশ্লিষ্টজনদের সঙ্গে মার্চের মাঝামাঝির পর অনলাইনে সীমিত বার্তা লেনদেন ছাড়া প্রত্যক্ষ কোনো আলোচনা হয়নি তবে গত কয়েক বছরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় আমরা রাজস্ব ভিত্তি বাড়ানো, সামাজিক খাতে অধিক বরাদ্দ, প্রবৃদ্ধি চাঙা করে এমন প্রকল্প নির্বাচন ও যথাসময়ে তা বাস্তবায়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, বিতর্কের ঊর্ধ্বে ক্রয় প্রক্রিয়া, বাজেট প্রণয়ন ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পৃক্ততা বাড়ানো এবং বাজেটারি বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ বাড়ানোসহ প্রভৃতি বিষয়ে কথা বলে আসছি।

সেই সঙ্গে কিছু কিছু আলাপচারিতা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার গুণগত উন্নয়নের জন্য জাতীয় অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল গঠন, জেলা বাজেট সম্প্রসারণ, গ্রামাঞ্চলে হেলথ কার্ড প্রবর্তন, কৃষি ফসলের ইন্স্যুরেন্স এবং জাতীয় পেনশন ফান্ড চালুর বিষয়েও। বিপরীতে, অন্য দেশ কী করছে বা প্রত্যাশিত সুফল অর্জনে কার্যকর বাজেট বরাদ্দ ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া নিশ্চিতে কী করা যায়, তাতে কমই মনোযোগ দেওয়া গেছে। খুবই কম আলোচনা হয়েছে সত্যিকারের রাজস্ব সংস্কার নিয়েও। তবে এই করোনাকালে সবকিছু ছাপিয়ে উচ্চকিত হয়ে দাঁড়ায় জীবন ও জীবিকা রক্ষার বিষয়টি। দিন দিন যেহেতু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে তাই সমাজবিদ, অর্থনীতিবিদ এমনকি রাজনীতিবিদেরাও দাবি করছেন বা নিদেনপক্ষে আশা করেছেন বাজেটের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত করোনার সব অভিঘাত থেকে আমাদের মুক্তি।

অনেক অনেক দিন আগে এক বাজেট আলোচনায় ‘অ্যাবিলিটি টু পে অ্যাপ্রোচ’ বা কর পরিশোধের সক্ষমতা নিয়ে একটু বেশি বলে ফেলায় বৈঠকে উপস্থিত আমাদের এক প্রিয় শিক্ষক আমাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে বললেন, তুমি দেখি মাসগ্রেভের পাবলিক ফাইন্যান্স বই মুখস্থ করে ফেলেছ। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ‘বাংলাদেশে উন্নয়ন পরিকল্পনা’ নিয়ে আমার অভিসন্দর্ভেরও সুপারভাইজার ছিলেন সেই শিক্ষক। এই কথাটি এখানে টেনে আনার কারণ, আমাদের বুঝতে হবে বাজেট দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনার একটি অনুশীলন মাত্র, সর্ব রোগহর দাওয়াই নয়। তাই আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, করোনাকালের বাজেটের রকমফের কী হওয়া উচিত ছিল, আমার কাছে কোনো চটজলদি ও তৈরি উত্তর নেই। এ নিয়ে হয়তো আবার মাসগ্রেভ বা রঘুরাম রাজন বা বেন বার্নানকের বই খুলে বসতে হবে।

অন্য একটি উত্তর হতে পারত, অন্য সবাই টেলিভিশনে গিয়ে যেমন ভঙ্গুর স্বাস্থ্যসেবার প্রতি আঙুল তুলেছেন, তাঁদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাজেটের সব টাকা দিয়ে হাসপাতাল নির্মাণ, জরুরি চিকিৎসাসামগ্রী আমদানি আর ডাক্তার আর নার্স নিয়োগ আর বেতন বৃদ্ধিতে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। তবে অর্থনীতির ছাত্ররা তখন প্রশ্ন করতেন, বাজেট বানানো অর্থ বিভাগের কাজ, হাসপাতাল নির্মাণ নয়।

আমি যখন এই নাতিদীর্ঘ লেখা লিখছি তখন টেবিলে পড়ে রয়েছে পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক প্রদানকৃত ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মোটা দলিলটি। আপনারা কেউ কেউ এটি দেখে থাকলে জানবেন, এতে ২০১৯-২০–এর সংশোধিত বাজেট এমনকি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চূড়ান্ত ব্যয়ের খতিয়ানও রয়েছে। সেটি প্রমাণ করেছে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ে এগিয়ে আছেন পুলিশ, সেনাবাহিনী ও ইঞ্জিনিয়ার ভাইয়েরা, আর পিছিয়ে আছেন স্বাস্থ্য আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাইয়েরা। স্বাস্থ্যসেবা খাতে দুর্নীতি নিয়ে এত আলোচনা থাকলেও শেষমেশ বরাদ্দের পুরো টাকা ব্যবহারের মুরোদও তাঁদের নেই, বাকি থাকল নতুন প্রকল্প গ্রহণ বা বাস্তবায়ন কিংবা ভালো ব্যবস্থাপনার কথা।

আপদকালে তাঁরা কত দ্রুত চলতে পারেন তার নমুনাও আমরা দেখেছি। সংগত কারণেই এবারের বাজেট নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা এবং প্রান্তিক, অবহেলিত ও সাময়িক কর্মহীন জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, আকাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জ এবং কালোটাকা সাদা করার উদ্যোগের নৈতিক গ্লানি ও চূড়ান্ত সাফল্য সম্ভাবনায় সন্দেহ নিয়ে।

করোনার আগেই আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির বেশ কিছু খাতে আমরা কিছুটা নিম্নমুখী বা স্বল্প প্রবৃদ্ধি লক্ষ করছিলাম। করোনাকালে বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়ায় বহির্বাণিজ্য এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবসায়ও বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আমাদের আমদানি ও রপ্তানি বেশ কমে যায়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত ও দৈনিক শ্রমজীবীরা। সেই সঙ্গে কিছু জেলায় সাইক্লোন আম্পানও বেশ ক্ষতি করে। করোনাজনিত ক্ষতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিবেচনায় বাজেটের দর্শন নির্বাচন তাই সঠিক বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে।

জিডিপির প্রবৃদ্ধি এমনকি ২ দশমিক ৫ কিংবা ৩ শতাংশ হলেও আগামী অর্থবছরে করোনা, সম্ভাব্য বৈশ্বিক মন্দা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা ও জাতীয় পুঁজি সংবর্ধন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ন্যূনতম কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনও খুব কঠিন নয়। তবে প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা উন্নত না করতে পারলে তা আবার খুব চ্যালেঞ্জিংও হয়ে যেতে পারে। কিছু কিছু মহলে ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক সংস্কারের কথাও বিরাটভাবে আলোচিত। সেই সঙ্গে রয়েছে রাজস্ব আদায় কাঠামোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং কর ফাঁকি রোধ ও কর খাত সম্প্রসারণে সর্বোচ্চ মনোযোগের বিষয়গুলোও।

বাংলাদেশের বাজেটের আকার বাড়ছে। ফলে আলোচ্য বাজেট সামলানো ও বাস্তবায়ন সক্ষমতা বাড়ানোর চাপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের অবশ্যই বাজেট বরাদ্দে দক্ষতা উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, বাজেট বাস্তবায়নে যথাযথ পরিবীক্ষণ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যোগাযোগ ও লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সমঝোতা বৃদ্ধি, ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা, অন্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ ও ব্যক্তি খাত, এনজিও, পেশাজীবী এমনকি উন্নয়ন সহযোগী—সবাই এক জোট হয়ে কাজ করতে পারলে করোনাকালেও দেশকে এগিয়ে নিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বৈকি।

মনে রাখতে হবে করোনাকালের বাজেট বলতে কিছু নেই। এটি ভালোভাবে মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন সমন্বিত ও ত্বরিত পদক্ষেপ, ঘোষিত প্রণোদনার টাকা সঠিকভাবে বিতরণ এবং ন্যূনতম স্বাস্থ্য-নিয়মানুবর্তিতা বজায় রেখে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করা।

তবে দেশকে দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে ‘উল্লম্ফনে’ নিয়ে যেতে হলে আমাদের আর্থিক পরিকল্পনায় অভিনবত্ব ও উদ্ভাবনী চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতেই হবে। এটা না করা গেলে আমাদের বাজেট একটি ‘বেস্ট ব্যুরোক্রেটিক এক্সারসাইজ’ হিসেবেই থেকে যাবে কিংবা বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের অনেকটা ‘কমন রেসিপি’। অনেক সময় তাড়াহুড়োয় হয়তো প্রমাণ মিলবে ‘গোঁজামিলেরও’।

এটা নিয়ে গোয়ার্তুমিরও সুযোগ নেই। বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে বা তথ্য অধিকারের এই সময়ে বাজেট শুধু গুটিকতকের ডায়েরির বিষয় হতে পারে না। করোনা যেমন আমাদের জুম, গুগল হ্যাংগআউট, ট্রিমস কিংবা স্ট্রিমইয়ার্ডের মতো অনেক অনলাইন যোগাযোগমাধ্যম সামনে এনে দিয়েছে তেমনি আমাদেরও একই গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য নতুন নতুন পথের সন্ধান করতে হবে। এমনকি চলতে হতে পারে স্বল্প মাড়ানো পথেও।

মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক।