ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে আমাদের কেন প্রয়োজন

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী করোনাকালে একজন সাহসী যোদ্ধা। তাঁর প্রতি এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় চিকিৎসকদের যুক্তিহীন যে ক্ষোভ ছিল, এখন তা নেই। বরং এ সময়ে তাঁর প্রতি রয়েছে গভীর শ্রদ্ধা। আমিও তাঁকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি। কোভিড-১৯ বাংলাদেশে মহামারিরূপে দেখা দেওয়ার আগে থেকেই তিনি বিভিন্ন মিডিয়ায় করোনাযুদ্ধে শামিল হওয়ার আকুতি জানাতে শুরু করেন। করোনা কিট উদ্ভাবনে প্রতিশ্রুতিশীল গবেষণা বিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য স্বল্পমূল্যে টেস্ট করার জন্য করোনা কিট উদ্ভাবন করেছে।

গণস্বাস্থ্যের করোনা কিট উদ্ভাবনের বিষয়ে প্রথম দিকে দেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। বিশেষ করে সরকারের কাছে তার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। তিনি নাগরিক ঐক্যের ব্যানারে যেভাবে তৎপর থেকেছেন, তাতে সরকারের ওই রকম দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বলে অনেকের ধারণা।

তারপরও মনে হয়েছে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব দেশের এই দুর্যোগময় মুহূর্তে গণস্বাস্থ্যের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। তাদের উদ্ভাবিত করোনা কিটের পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা উৎপাদনে কাঁচামাল সংগ্রহের ধাপকে এগিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরে কিট গ্রহণ ও তার অনুমোদনে একধরনের ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়। সরকারের ভেতরের কেউ কেউ গণস্বাস্থ্যর উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছেন। কিন্তু জাফরুল্লাহ চৌধুরীর লক্ষ্য অর্জনের দৃঢ়তায় বিলম্ব হলেও সেই বাধা অনেকটাই কেটে গেছে।

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ সৃষ্টির মূলে ছিল গণস্বাস্থ্যের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার অঙ্গীকার ও আন্তরিক কর্মতৎপরতা। তিনি বাংলাদেশের ওষুধনীতিতে মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন। যুগোপযোগী স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ণেও তিনি ছিলেন উদ্যোগী রূপকার। তবে তাঁর তৎকালীন স্বাস্থ্যনীতির প্রতি চিকিৎসক সমাজের সমর্থন ছিল না। বিশেষ করে চিকিৎসকনেতারা ওই স্বাস্থ্যনীতি প্রত্যাখ্যানের আন্দোলন শুরু করেছিলেন।

দেশের অধিকাংশ চিকিৎসকনেতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে স্বাস্থ্যনীতির কারণে পছন্দ করতেন না। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে সাভারে বিভিন্ন সময়ে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার পুরোটাই তাঁকে সামাল দিতে হয়েছে। চিকিৎসক সংগঠনগুলোর কোনো একটিও তাদের পাশে দাঁড়ায়নি।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র জনগণের জন্য স্বল্প মূল্যে কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা করে আবার নজরে আসে। এই প্রতিষ্ঠানের ডায়ালাইসিস সেবার মান নিয়ে চিকিৎসকদের উন্নাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ তা আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করে নেয়। স্বল্প মূল্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বজায় রেখে ডায়ালাইসিসের এমন সুযোগ অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে নেই। হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিসের জন্য সেখানে সম্পূর্ণ পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিদিন যে সংখ্যক রোগীর ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা এ প্রতিষ্ঠানে হয়, তা বিস্ময়কর।

ডায়ালাইসিসের সুবিধা তৈরিতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা নিয়ে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো সমর্থন জুগিয়েছে। ব্যাপক পরিসরে ডায়ালাইসিস চালুর পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসকদের দৃষ্টিভঙ্গিও অনেকটাই বদলে গেছে।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজেও কিডনি রোগী, তাঁকেও নিয়মিত ডায়ালাইসিস সেবা নিতে হয়। তিনি চাইলে কেবিনে, এমনকি নিজের বাড়িতেও ডায়ালাইসিসের সুবিধা নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। রোগীদের ওয়ার্ডে সাধারণ বিছানায় নিজে ডায়ালাইসিস করান। ওয়ার্ডের কোনো এক পাশেও নয়, আলাদা মনোযোগের পরিবেশেও নয়। ডায়ালাইসিস নেওয়ার সময় অফিসের কাজ করেন। তাঁর অবস্থান, মনের জোর অসাধারণ। তিনি কাজ ও বিশ্বাসের মিল রেখে চলেন। গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে একজন জুনিয়র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের হাতে তিনি ভারতীয় লেন্স সংযোজনের ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে তাঁর চোখের ছানি অপারেশন করিয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানে চোখের রোগীদের যে চিকিৎসা দেওয়া হতো, তিনি তা-ই নিয়েছেন।

করোনা–আক্রান্ত দেশে জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাঁর প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত কিট জনসেবায় ব্যবহার করার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দৌড়াদৌড়ি করেছেন। সংবাদমাধ্যমে কথা বলেছেন। স্বল্প সময়ে স্বল্প ব্যয়ে পরীক্ষা করানোর সুযোগ জনগণের হাতে তুলে দিতে চেয়েছেন। তাঁদের কিটের মাধ্যমে পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে কোনো কোনো মহল উন্নাসিকতা দেখিয়েছে। নেতিবাচক ধারণা দিতে চেয়েছে। সব মিলিয়ে এই করোনা পরীক্ষার কিট নিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে একধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ধৈর্যের সঙ্গে সেই চ্যালেঞ্জ অতিক্রমের চেষ্টা করেছেন।

কোভিড–আক্রান্ত রোগীদের প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসার পর্যায়টি অত্যন্ত করুণ। মানুষ টেস্ট করাতে গিয়ে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে দৌড়াতে হচ্ছে। পরীক্ষা করানোর ক্ষেত্রেও উপেক্ষার শিকার হচ্ছেন। হাসপাতাল সেবার ক্ষেত্রেও রয়েছে চরম দুর্ভোগ। বিশেষ করে যেসব রোগী ঝুঁকিতে রয়েছেন (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি, ক্যানসার), তাঁদের বিড়ম্বনা অন্তহীন। চিকিৎসা বিড়ম্বনায় অনেক রোগীকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়েছে।

কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিসের জায়গাটাও খুবই সীমিত। কোভিড রোগীদের জন্য ডায়ালাইসিস ইউনিট নেই। স্বাস্থ্য প্রশাসনের এ–সংক্রান্ত তথ্য ত্রুটিপূর্ণ। যেসব কোভিড নির্ধারিত হাসপাতাল রয়েছে, সেগুলোতে ডায়ালাইসিসের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নেই, যন্ত্রপাতি নেই। রোগীদের নাম লিখিয়ে প্রতীক্ষার দীর্ঘ প্রহর গুনতে হয়। শুধু মুগদা হাসপাতাল সীমিত পরিসরে ডায়ালাইসিস সেবা দিচ্ছে।

এই অবস্থায় ভরসার জায়গা হতে পারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। তারা যেভাবে ডায়ালাইসিস চালু করে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, সেভাবেই কোভিড–আক্রান্ত কিডনি রোগীদের পাশে দাঁড়াতে পারে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তা-ই চেয়েছিলেন। তিনি অসুস্থ হওয়ার তিন দিন আগে আমি কথা বলেছিলাম তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেছিলেন, ডায়ালাইসিসের রোগীদের দুর্ভোগের বিষয় তিনি জানেন। দুর্ভোগ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে তাঁর প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ নেবে। তিনি সরকারের কাছে করোনাকালের জন্য পাঁচ হাজার বর্গফুট জায়গার সংস্থান চান। নগর হাসপাতালের পাশেই তিনি তা গড়ে তুলতে চান।

বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার জন্য, সার্বিক জনস্বাস্থ্যের জনমুখী বিকাশের জন্য ডা. জাফরুল্লাহর সুস্থ হয়ে ওঠা অত্যন্ত জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে জন্ম নেওয়া গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিকাশের জন্যও তাঁর সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকা প্রয়োজন। তিনি গত মাসে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং ইতিমধ্যে সেরে উঠেছেন। তবে তিনি এখনো কিছু শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। আমরা সবাই তাঁর দ্রুত আরোগ্য ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি।

অধ্যাপক ডা. মো. শফিকুল ইসলাম চক্ষু বিশেষজ্ঞ