মহামারি ও সুশাসন

গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে চীনে কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে প্রথম কোভিড শনাক্ত হওয়ার দিন পর্যন্ত আমরা সময় পেয়েছি তিন মাসের বেশি। মহামারি চীনের বাইরে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়াতে শুরু করলে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে বারবার বলা হচ্ছিল, এই বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলার জন্য যে প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। কিন্তু সরকারি তরফ থেকে দীর্ঘ সময় ধরে একই কথার পুনরাবৃত্তি চলেছে: সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। 

সরকারের এই বক্তব্যের যথার্থতার প্রমাণ মেলেনি। এ দেশের কোভিড সংক্রমণের শততম দিনে এসে দেখা গেল, একই সময়ে সংক্রমণের হার আমাদের প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় অনেক বেশি। শুধু তা–ই নয়, কোভিড মোকাবিলা করতে গিয়ে পুরো জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে; দেশের ৫৩ শতাংশ হাসপাতালে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার সংকট জটিল আকার ধারণ করেছে। ৭১ শতাংশ হাসপাতালে নিম্নমানের পিপিই সরবরাহ করার ফলে চিকিৎসকসহ এক হাজারের বেশি চিকিৎসাকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন; ৩৫ জন চিকিৎসক ইতিমধ্যে মারা গেছেন।

সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা যখন অব্যাহত রয়েছে, তখন পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখা উচিত, আমরা কোন কোন ক্ষেত্রে কী কী ভুল করেছি; কোন কাজটি কেন সময়মতো শুরু করতে পারিনি; সীমাবদ্ধতাগুলো কী ছিল। 

কোভিড মহামারি বৈশ্বিক রূপ ধারণ করার পরেও আমরা নিজেদের প্রস্তুতি শুরু করতে সময় ক্ষেপণ করেছি সম্ভবত এই কারণে যে আমাদের সরকারি নীতিনির্ধারক মহলে যেকোনো সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা কাজ করে। অনেক সময় নষ্ট হওয়ার পর যখন সরকার মহামারি মোকাবিলায় জোরালোভাবে উদ্যোগী হয়, তখন ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনের ঘাটতি প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এ বিষয়ে গবেষণা করে ‘করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে, সরকারের নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রমে পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের ঘাটতি এবং বিভ্রান্তিকর ও পরস্পরবিরোধী নানা কর্মকাণ্ডের ফলে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করেছে।

অর্থাৎ, প্রায় ৯৫ হাজার কোভিড রোগীর চিকিৎসা (এই সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে তিন হাজারের বেশি করে বাড়ছে), কোভিডে আক্রান্ত নন এমন সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা; নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো, সংক্রমণের আরও বিস্তার রোধের লক্ষ্যে এলাকাভিত্তিক লকডাউন বাস্তবায়নসহ জনসাধারণের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে আজ আমরা যে জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, তার প্রাথমিক ও মৌলিক কারণ আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনা সংস্কৃতিতে সুশাসনের ঘাটতি। সুশাসনের ঘাটতির কারণে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিমুক্ত যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, কোভিড মহামারি এসে তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। বিষয়টি এতই হতাশাব্যঞ্জক যে মহামারির বিপন্ন অবস্থায়ও স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হয়নি।

সুশাসনের ঘাটতি দূর না হলে জাতি হিসেবে আমাদের অগ্রগতি ঘটবে না। এ মুহূর্তে কোভিড মহামারি মোকাবিলায় সুশাসন ও ব্যবস্থাপনার মান বাড়ানোর লক্ষ্যে টিআইবি ১৫ দফা সুপারিশ পেশ করেছে। সেসবের মধ্যে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিদ্যমান যন্ত্রপাতি ও লোকবলের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষার সুবিধা জেলা পর্যায়েও সম্প্রসারণ করা; পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো; স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো ইত্যাদি। কোভিড মোকাবিলায় টিআইবির সুপারিশমালা সহায়ক হবে। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার গতানুগতিকভাবে টিআইবির প্রতিবেদনটি প্রত্যাখ্যান না করে তাদের সুপারিশগুলো বিবেচনায় নিয়ে সুশাসন, ব্যবস্থাপনা ও কর্ম সমন্বয় উন্নয়নে উদ্যোগী হবে।