সৈয়দ আবদুর রবকে আমরা ভুলে গেলাম!

সৈয়দ আবদুর রব
সৈয়দ আবদুর রব

অবিভক্ত বাংলার নিঃস্বার্থ ও নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবক সৈয়দ আবদুর রবের (১৯০৩-১৯৬৯) কথা বর্তমান প্রজন্মের অনেকই জানেন না। আজ ১৭ জুন তাঁর ১১৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে তাঁর জীবন ও কর্মের কিছু দিক আপনাদের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করছি।

সমাজের দুস্থ-অসহায়ের দুঃখ, মানবতার অবমাননা তাঁকে ব্যথিত করেছিল, যা তাঁর ভবিষ্যতের জীবনদর্শন ও কর্মপ্রচেষ্টা প্রতিষ্ঠা করতেও উৎসাহিত করে। এর অঙ্কুর হিসেবে তিনি ১৯২৮ সালে ফরিদপুর শহরে পৈতৃক বাসভবনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঐতিহাসিক খাদেমুল এনসান মিশন। ‘খাদেমুল এনসান’ অর্থাৎ মানুষের সেবক। পরে ব্যাপক পরিসরে কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য কলকাতায় মিশনের কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।

মিশনের সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হতো বাংলা, বিহার, ওডিশা ও আসামের বিভিন্ন স্থানে বন্যা, সাইক্লোন, ভূমিকম্প, মহামারি ইত্যাদি দুর্যোগে। কিন্তু সমাজের সমস্যা বিশেষত অশিক্ষা, কুসংস্কার, দুর্নীতি এবং সর্ববিধ দৈন্য সৈয়দ আবদুর রবকে বিচলিত করত। ফলে, মিশন তাঁর কার্যক্রম শুধু আর্তের সেবাতেই সীমাবদ্ধ রাখেনি, দৃষ্টি সম্প্রসারণ করেছিল সামাজিক সংস্কার সাধন ও পুনর্গঠনে; জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় খাদেমুল এনসান মিশন সে সময়ে বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলে বিদ্যালয়, নৈশ বিদ্যালয়, পাঠাগার, এতিমখানা, ধর্মগোলা, সালিশি বোর্ড প্রভৃতি। আর এভাবেই বাংলা, বিহার, ওডিশা ও আসামের বিভিন্ন জায়গায় ৩২৮টি শাখা অফিস, ২১৩টি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং ১১৫টি শিক্ষা ও সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমিতি কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রয়োজনীয় অর্থ, নিঃস্বার্থ কর্মীর অভাব, কিছু সমাজনেতা ও রক্ষণশীলশীল মানুষের বিরোধিতা সমিতির কার্যক্রমকে বিঘ্নিত করেছে পদে পদে। তবে থেমে থাকেনি মানবসেবা।

সৈয়দ আবদুর রব ছিলেন এক অনন্যসাধারণ কর্মী, চিন্তাবিদ। মিশনের উদ্দেশ্য ও কর্মপরিধির বিস্তৃতি ও ব্যাপকতার সঙ্গে সঙ্গে এর মুখপত্ররূপে ১৯২৮ সালে তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক ‘মোয়াজ্জিন’। পরে এটি মাসিক পত্রিকা হিসেবে বেরোতে থাকে। তাঁর সম্পাদনায় ১৯৩৬ সালের জানুয়ারি মাস থেকে প্রকাশিত হতে থাকে আরেকটি পত্রিকা ‘সার্ভেন্ট অব হিউম্যানিটি’।

তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন সময়ে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা দুটিকে যাঁরা লেখা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন, তাঁদের তালিকায় রয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সরোজিনী নাইডু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বেগম সামসুন্নাহার, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, এয়াকুব আলী চৌধুরী, ড. মুহম্মদ লুৎফর রহমান, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, কবি গোলাম মোস্তফা, প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়, বন্দেআলী মিয়া, ড. এনামুল হক, হুমায়ূন করীর চৌধুরী, অধ্যাপক আবুল ফজল, কাজী মোতাহার হোসেন, আহসান হাবীব, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

সৈয়দ আবদুর রবের জীবনদর্শন ছিল মানবতার আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে। তাঁর খাদেমুল এনসান মিশন ছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বড়লাট ১৯৩৭ সালে তাঁকে তাঁর অসাধারণ কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি দিয়ে স্বর্ণপদকে ভূষিত করেন। তিনি ছিলেন ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অগ্রসর চিন্তাধারার অধিকারী। কিন্তু তাঁর সেই চিন্তা ও উপলব্ধি গ্রহণ করার মতো উপযুক্ত মানুষ ও পরিবেশ উভয়েরই অভাব ছিল। তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায় ‘মোয়াজ্জিন’ একাদশ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যায় (জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৬) সৈয়দ আবদুর লিখিত ‘মনুষ্যত্বের ব্যর্থতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে। তিনি লিখছেন, ‘ধর্মের সঙ্গে মানুষের ধৃষ্টতা, ন্যায়ের সঙ্গে মানুষের নিমকহারামি এবং সত্যের সঙ্গে মানুষের শয়তানি ক্রমশঃই বৃদ্ধি পাইতেছে। ...মানুষ-সমাজে ধর্মের নামে অধর্মের প্রবল স্রোতই প্রবাহিত হইতেছে। ধর্ম জীবনে আজ প্রবঞ্চনাই উচ্চস্থান লাভ করিয়াছে। মানুষ স্ব স্ব ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব ও বৈশিষ্ট্যের ব্যর্থ বড়াই লইয়াই বিরোধে প্রমত্ত। ...মানুষের বেদনায় অশ্রুপাত যেন সেখানে হারাম। মানুষ ও মনুষ্যত্বের সঙ্গে সেখানে দারুণ প্রবঞ্চনা...তাই বঞ্চিত মনুষ্যত্বের বিক্ষুব্দের ক্রন্দনে স্রষ্টা ও সৃষ্টি আজ অতিষ্ঠ। পুরাতন একঘেয়ে পথ চলিতে চলিতে মানুষ নতুন ধারণা, উদার চিন্তা, উন্নত রুচি, মুক্তবুদ্ধি ও নতুন পথ চলার আনন্দের সন্ধান এ মহান মানব জীবনে লাভ করিতে পারিল না; এমনই দুর্ভাগ্য তাহার।’

তাঁর বলিষ্ঠ, গতিশীল নেতৃত্ব ও বিস্ময়কর কর্মপ্রচেষ্টায় মিশনের সাফল্য যখন ইতিহাসে পরিণত হবার প্রক্রিয়ায়, ঠিক সে সময়েই বেজে উঠেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। যুদ্ধ থামতেই শুরু হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশ ভাঙার জোর আন্দোলন। এই দাঙ্গায় সৈয়দ আবদুর রব গুরুতর আহত হয়েছিলেন, মিশন অফিসও লুণ্ঠিত হয়েছিল। প্রাণ নিয়ে তিনি ফিরে এসেছিলেন পিত্রালয় ফরিদপুর শহরের পূর্ব খাবাসপুরে। অনেক সাধনা আর শ্রমে গড়া প্রতিষ্ঠান যেন এক কুটিল, নিকৃষ্ট চক্রান্তে বিনষ্ট হয়ে গেল।

জীবদ্দশার শেষ দুই দশক সমাজের কাছ থেকে প্রাপ্য সমাদর ও স্বীকৃতি পাননি তিনি। তবে ২০০২ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত জীবনী গ্রন্থমালায় আবুল আহসান চৌধুরী লিখিত সৈয়দ আবদুর রবের জীবনী অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ প্রকাশিত বাংলা পিডিয়ার বাংলা এবং ইংরেজি সংস্করণে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউট তাঁর জীবন ও কর্মকাণ্ড পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করেছে। ফরিদপুর পৌরসভা তাঁর বাড়ির সামনের সড়কটির নামকরণ করেছে তাঁরই নামানুসারে।

সৈয়দা ইসরাত নাজিয়া: সৈয়দ আবদুর রবের পৌত্রী এবং সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়